0.6 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

নুতন করে লেখার প্রয়োজনটা

নুতন করে লেখার প্রয়োজনটা
নুতন করে লেখার প্রয়োজনটা

সংবিধানকে নুতন করে লেখার প্রয়োজনটা কেন হলো? উত্তরটা যদি এরকম হয় যে, সংবিধানকে আরো গনতান্ত্রিক এবং জনপ্রতিনিধিত্বশীল করে তোলার ব্যবস্হা করতে এবং ভবিষ্যৎ ফ্যাসিজম ও স্বৈরতন্ত্রকে রুখে দিতেই এটা করতে হবে। তাহলে সাংবাদিক নুরুল কবীরের প্রশ্নের যথাযথ উত্তরটা দরকার। তাহলো সংবিধান সংস্কার কমিটিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও উপজাতি বা অন্যান্য জাতি সত্তার মানুষের প্রতিনিধি নেয়া হলো না কেন? এই না থাকাটা শুরুতেই একটা প্রশ্নের উদ্রেক করে তা হলো সংবিধান রিরাইট করার আসল উদ্দেশ্য তাহলে অন্য কিছু নয় তো?

আরো যেসব বক্তব্য ও বিবৃতি নিয়ে ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে সন্দেহের উদয় হয়েছে তা হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার সবচেয়ে উজ্জীবিত দিন, যেদিনটিকেই অনেকে স্বাধীনতার ঘোষণার মহামন্ত্র পাঠের দিন বলে ধরে নিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চকে জাতীয় দিবসের তালিকা থেকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত।

- Advertisement -

আসলে ৭ই মার্চকে বুঝতে হলে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চেই ফিরে যেতে হবে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ শাসক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর যত বদনামই দেয়া হোক না কেন, যত ব্যর্থতাই থাকুক না কেন, যত ভুলই থাকুক না কেন, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে সম্ভবত শতকরা একজন লোকও ছিল না যিনি সেদিন বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে উজ্জীবিত হন নি, একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সামান্য বিরোধিতা করার কথা চিন্তা করতে পেরেছিলেন সেদিন।

১৯৬২ থেকে ১৯৭১ এর ৬ই মার্চ পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্যে যত ঘটনা ঘটেছে সব ঘটনার, সব উচ্ছাসের, সব স্রোতের এক মোহানায় মিলিত হবার দিন ছিল ৭ই মার্চ। এছাড়া আজ যারা বিএনপি করছেন এমনকি জামাতেরও দু চারজন আছেন যারা তখন বঙ্গবন্ধুর পক্ষে ছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন, ৭ই মার্চে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। একথা সত্য ছাত্র নেতাদের কেউ কেউ চেয়েছিলেন ৭ই মার্চেই স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হোক, কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা সংগত কারণেই না দেয়াতে অনেকে মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন। আজ যারা প্রশ্ন তোলেন বঙ্গবন্ধু কেন স্বেচ্ছায় পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হয়েছিলেন বা কেন ২৫ বা ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে গেলেন না, তাঁরাও ভাল করে জানেন যে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস বঙ্গবন্ধুর নামেই যুদ্ধটি হয়েছিল।

স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু প্রথম যে ভুলটা করেছিলেন সেটা হলো বিপ্লবী ছাত্র নেতাদের কাউকে সরকারের অংশ করেন নাই। জাতীয় সরকারের দাবীকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। ফলে জাসদের সৃষ্টি হয় এবং জাসদের কারণেই তিনটি বছর বঙ্গবন্ধুর দেশ শাসন ও নেতৃত্ব চ্যালেন্জের সম্মুখীন হয়। সম্ভবত ড. ইউনুস সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানের ছাত্র নেতা নাহিদ এবং আসিফকে মন্ত্রীসভা বা উপদেষ্টামন্ডলীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। যা খুবই সময়োপযোগী কাজ করেছেন বলে আমি মনে করি।

তবে এখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এত সমালোচনা এবং কিছু অগ্রহণযোগ্য অপ্রীতিকর অপমানজনক ঘটনার জন্যে মুলত দায়ী আওয়ামী লীগ এবং স্বয়ং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি তার শাসনামলের অধিকাংশ সময় যে ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিলেন সেটাকে টিকিয়ে রাখতে এবং দীর্ঘস্হায়ী করতে বঙ্গবন্ধু এবং মহান মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক ঢাল ও হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে প্রচন্ড অপপ্রয়াস চালিয়েছেন এবং অন্যায় করেছেন। তার একটা নমুনা হলো ৫ই আগষ্টের আগে ঢাকা এয়ারপোর্টে প্লেন থেকে বের হতেই সবার আগে যে ঢাউস সাইজের সাইনবোর্ড চোখে পড়তো সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ বড় অক্ষরে লেখা ছিল “ওয়েলকাম টু মুজিব ল্যান্ড”!

১৯৭৫ সালেও একটি শ্লোগান ব্যপক প্রচার করা হতো, “এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ”! অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আরো বহু মানুষের এমনসব অবদান রয়েছে যা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একজন ব্যক্তি যার নাম বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান যিনি পাকিস্তান থেকে যুদ্ধ বিমান নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। অপর একজন ছিলেন যুদ্ধাহত বীর উত্তম মুক্তিযোদ্ধা কর্ণেল তাহের যিনি পাকিস্তান থেকে আফগানিস্তান হয়ে পালিয়ে এসে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে গুলিতে একটি পা হারান। যার কারণে অনেকে তাকে বলতো ক্রাচের মুক্তিযোদ্ধা।

এখন এই কর্ণেল তাহেরের ৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ভুমিকা নিয়ে বা গণবাহিনী নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক, তাতে তাঁর ৭১ সালের বীরত্বকে কোনভাবেই খাটো করা যাবে না। যেমন বীর উত্তম জিয়াউর রহমান। যে পরিস্হিতিতেই হোক যার নামেই হোক তিনি স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেটার অবদান এবং মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান কোনভাবেই তাঁর স্বাধীনতা পরবর্তী সামরিক শাসনকালের সাথে এবং বেসামরিক শাসনকালে জাগদল এবং বিএনপি গঠন করে যা যা ঘটেছিল তার সাথে তুলনা করে খাটো করা যাবে না। তেমনীভাবে কর্ণেল ওসমানী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি। কেউ কেউ তাকে সর্বাধিনায়কও বলেন। কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সময়ে খোন্দকার মুশতাকের সময়ে এবং পরে তার জনতা লীগ গঠন ইত্যাদি রাজনৈতিক বিতর্ক দিয়ে তাঁকেও খাটো করা যাবে না। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুলের প্রবাসী সরকার, মাওলানা ভাসানীর অবদান স্বীকার করতেই হবে। ৭০ এর নির্বাচনে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর নামে নৌকায় ভোট চাওয়া হয় নি। আমার পরিস্কার মনে আছে কিছু শ্লোগানের কথা। জেগেছে জেগেছে বাঙালী জেগেছে, শেরে বাংলার বাংলা জেগেছে জেগেছে, সোহরাওয়ার্দীর বাংলা জেগেছে জেগেছে ইত্যাদি বহুল জনপ্রিয় শ্লোগান প্রমাণ করে নেতা শুধু একা বঙ্গবন্ধুই ছিলেন না।

এখন রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধুকে ব্যবহার করেন, আবার একই রাজনৈতিক কারণে তাকে খাটো করার চেষ্টা করেন। আমি বলবো, ২০২৪ এর গণ-অভ্যুত্থান দেশকে দুর্নীতি আর দুঃশাসনের অতীতকে রিসেট করে সংস্কারের মাধ্যমে নুতন বাংলাদেশ গড়ার যে ঐতিহাসিক সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে সেখানে আওয়ামী বয়ানের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়, বরং স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস থেকে শুরু করে ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ২রা মার্চের পতাকা উত্তোলন, ৩রা মার্চের ইশতেহার পাঠ, সর্বোপরি ৭ই মার্চের বজ্রকন্ঠের “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”এর ঐতিহাসিক ভাষন এবং ২৫শে মার্চের গণহত্যা ও ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ই ডিসেম্বরের বিজয় দিবসকে অন্তরে ধারণ করেই এগিয়ে নিতে হবে। এর অন্যথা হলে একদিকে যেমন স্বাধীনতার প্রকৃত শত্রুদের ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার সুযোগ তৈরী করে দেয়া হবে ফলে দেশে নুতন করে গণ-অসন্তোষ তৈরী হবে এবং সেই সুযোগে ২০২৪ এর পরাজিত ফ্যাসিবাদের দোসরদের ক্ষমতা ফিরে পাবার পথ প্রশস্ত করে দেয়ার মারাত্মক ভুল করা হবে। আর তাই যদি হয় দেশ চলে যাবে দীর্ঘ অমাবশ্যার অতল কালো অন্ধকারে।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles