
আজ আমাদের ভ্রমনের শেষ দিন। মনটা খারাপ লাগছে খুব। আবার ফিরে যেতে হবে নিয়মিত বাস্তব জীবনে। তাই আজ প্রান ভরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলাম সাগরের জলে।
বিকেলে আবার ফিরে এলাম সাগর তীরে সাগরকে বিদায় জানাবার জন্য। আসাধারন মিষ্টি বাতাস খেলা করছে সাগর সৈকতে , তার সাথে চলছে ঢেউয়ের খেলা। সাগরকে চিৎকার করে বললাম, তোমার সাথে আজই আমার শেষ দেখা। কাল থেকে তোমার কাছে আর আশা হবে না। তোমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরবো না। কত হাজার হাজার মানুষ আসে তোমার কাছে তোমাকে উপভোগ করতে। তোমাকে দেখে মুগ্ধ হতে। তোমাকে সবাই মনে রাখে কিন্তু তোমার প্রয়োজন নেই কাউকে মনে রাখার।
নীরব সাগর তীর। মানুষের কোলাহল নেই। অবাক হয়ে দেখলাম একটি মেয়েকে। মেয়েটি সাতার কেটে বহুদূর চলে গেছে। কখনো ডুব সাতার দিচ্ছে, কখনো উল্টো সাতার। বড় বড় ঢেউ মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। মেয়েটি আবার ভেসে উঠছে। মেয়েটি আমার দৃষ্টি থেকে ক্ষীন থেকে ক্ষীনতর হতে থাকলো। একটি বড় আকারের পাখি কুৎসিত ভাবে ডাকতে ডাকতে মেয়েটির মাথা উপর দিয়ে উড়ে গেলো। বেলা প্রায় শেষের দিকে। এখনি হালকা আধার নেমে আসবে। মেয়েটি এখনো কেনো ফিরে আসছে না? আমার কেমন জেনো একটা অজানা আতংক হতে লাগলো মেয়েটির জন্য। আমি মেয়েটির অপেক্ষাতে আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম সাগর তীরে। মেয়েটি আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলো। অন্ধকার নেমে আসছে খুব দ্রুত। তখনো মেয়েটি ফিরে এলো না। কিন্তু আমাকে ফিরতে হবে। ফিরার পথে সাগরকে অনুরোধ করে এলাম, সাগর তুমি মেয়েটিকে দেখো। ওর জেনো কোন ক্ষতি না হয়। মেয়েটিকে তুমি নিরাপদে পৌঁছে দিও তোমার তীরে।
সকালে নাস্তা খেয়ে রেসরটের বাসে করে রওয়ানা হলাম বিমান বন্দরের দিকে। নিজের বাসার ফিরে যাচ্ছি সে আনন্দের সাথে সাথে বুকের ভেতর একটা তির তির ব্যথা অনুভব করলাম এমন একটা সুন্দর জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছি বলে জানি আর কখনো ফিরে আসা হবে না এখানে। যে জায়গা থেকে ফিরে এসেছি সে জায়গাতে আর কখনো ফিরে যাওয়া হয়নি আমাদের । সব সময়ই খুঁজে নিয়েছি নতুন কোন জায়গা নতুন কোনো দেশ।
বাড়িতে ফিরে অন্য রকমের সস্থি অনুভব করলাম। যতো দেশ যতো জায়গাতেই ঘুরে আসিনা কেনো এবং আসার সময় মন খারাপ হলেও ঘরে ফিরে মনে হয় আহা আমার ঘর আমার বিছানা। Home sweet home. পরদিন ছেলে মেয়েরা দেখা করতে আসলো । মন দিয়ে শুনলো আমাদের ভ্রমন কাহিনী । আবার সবার ব্যস্ততা ।আমাদের ছেলে মেয়েদেও। সোম থেকে শুক্র জীবন চলে মেশিনের মতো । শুক্রবার রাত আসতে আসতে মেশিনের গতিটা থেমে আসে কিছুটা ।
সময় এমন একটা জিনিস তাকে কোনো ভাবেই ধরে রাখার উপায় নেই। চোখের পলকে সে ছুটে যায় বহুদুর। তাকে ধরে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় সময়টাকে যদি কোনো যাদু বলে একটা সময়ে ধরে রাখা যেতো কি আনন্দই না হতো । আমাদেরও এবেলা সেবেলা করে বহুবেলাই পার হয়ে গেলো । মানতে ইচ্ছে করে না কিন্তু না মেনেতো কনো উপায় নেই এটাইতো প্রকৃতির নিয়ম। আমরা এতো দিনে একটি ফুটফুটে পরী নাতনীর নানা নানী হয়ে গেলাম। জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হলো আমাদের। আমাদের আনন্দের শেষ নেই। ছেলের বিয়ে দিলাম। পরিবার বড় হলো কিন্তু একাকিত্ব বেড়ে গেলো। ছেলে মেয়েরা নিজেদের সংসার নিয়ে কাজ নিয়ে অনেকটাই ব্যস্থ হয়ে গেলো । যদিও বাবা মায়ের খোজ খবর নিতে তাদের কোনো কার্পণ্য নেই। আমরাও নাতনীর টানে বার বার ছুটে যাই নাতনীর কাছে।
আমার বাড়ীর সামনে শহরের সুন্দরয্য বৃদ্ধী এবং ছায়া সুনিবিড় ভাব আনার জন্য যে গাছটি রুপন করা হয়েছিলো, সে এখন শাখা প্রশাখা বিস্তার করে তারুন্যর দিকে এগিয়ে চলেছে। তাকে আমি আমার পুত্র গাছ বলে ডাকি । আমি রোজ আমার পুত্র গাছের সাথে অনেক কথা বলি। তাকে বলি ‘পুত্র তুই আমাকে ছেড়ে কোথাও চলে যাস না বাবা । আর তুই যাবি কোথায় ? তোর যে কোথাও যাবার জায়গাই নেই। শীতে পত্রহীন হয়ে নিজে কাঁদবি আর আমাকেও কাঁদাবি আর গ্রীষ্মে সবুজ পাতা ছড়িয়ে দিতে দিতে আনন্দে দুলতে থাকবি আর তোর আনন্দ দেখে আমারো আনন্দের শেষ থাকে না।
আমার ভাশুরের মেয়ে শীলা থাকে নর্থ ডেকোডা । ওদের বহু দিনের ইচ্ছে আমরা যাই বেড়াতে ওদের ওখানে । ছেলে মেয়েরাও আমাদের উৎসাহ দিতে লাগলো , যাও ঘুরে আসো শীলা আপুর ওখান থেকে । মনে মনে তৈরি হয়ে শীলাকে জানালাম আমরা আসছি।
ম্যাল্টন, কানাডা