0.6 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

নতুন জীবন লাভ মানে নতুন উদ্যমে কাজ করা

নতুন জীবন লাভ মানে নতুন উদ্যমে কাজ করা
নতুন জীবন লাভ মানে নতুন উদ্যমে কাজ করা

এমন কথা প্রায়শই আমরা শুনে থাকি নতুন জীবন লাভ করা। বিশেষ করে নতুন দেশে অভিবাসী হলে বা ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলে বা কোনো মরণব্যাধী থেকে মুক্তি মিললে এমন কথা আমাদের কানে আসতে শুরু করে। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে তিনবার। সেই ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় অভিবাসী হয়ে মনে হলো নতুন জীবন লাভ করলাম। ২০২২ সালে কঠিন এক গাড়ি এক্সিডেন্টের পরে মনে হয়েছিল নতুন জীবন পেলাম। আর গত ৯ অক্টোবর ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়ে বেঁচে গেলাম – সেটাও যেন নতুন জীবন লাভ। কিন্তু একটা বিষয় মনে হয়েছে জীবনকে নতুন করে লাভ করলেও নতুন জীবন  শুরু করা যায় না। কিন্তু কী করা যায়!

এবছরে দুর্গা পূজা শুরু হবার তারিখ ছিল ৯ অক্টোবর – সেদিন সপ্তমী। আমাদের শহরের বাংলাদেশি মালিকানাধীন মন্দিরগুলোতে ষষ্ঠীর দিনেও কিছু আয়োজন থাকে – প্রধানত সাংস্কৃতিক আয়োজন। এছাড়া যেহেতু ১০ অক্টোবর ওকাড বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে আমাদের প্যানেল আলোচনা ছিল, পরিকল্পনা করেছিলাম নবমীর আগে পূজা মণ্ডপে যাবো না। কিন্তু স্ত্রী নীলিমা ননদিনি-বন্ধু প্রতিমার সাথে প্লান করেছেন যাবেন ষষ্ঠীতে – অর্থাৎ ৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার। অন্যদিকে আমার বন্ধু ব্যারিস্টার সূর্য জানিয়ে রেখেছেন ও মঙ্গলবার ৮টায় থাকবেন দুর্গাবাড়িতে। নিজে যাবো না ভাবলেও মন উড়ুউড়ু। শেষে সন্ধায় নীলিমাকে নামাতে গিয়ে নিজেও মন্দিরে ঢুকলাম।

- Advertisement -

অনেকের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছিল – কিন্তু ভালো লাগাটা ততোটা ভালো লাগছিল না। কারণ আমার খুব শীত করছিল। শীতের বস্ত্র নেইনি – কেউই নেননি। চারপাশের দরোজাগুলো খোলা থাকাতে পাঞ্জাবি-কটিতে নিজেকে সামলাতে কষ্ট হচ্ছিল। সবারই এমন হচ্ছিল কি না জানি না। সূর্য এলেন। কথাও হলো। শেষে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে এলাম। কিছুতেই শীতকে সহ্য করতে পারছিলাম না আমি। রীতিমতো কাঁপছিলাম আমি।

ঘরে আসতেই শরীর স্বাভাবিক। ল্যাপটপে বসে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতিতে মন দিলাম। ফোন দিলেন মমতা। আকবর হোসেনের সাথে ড. মমতাজ মমতাও ওকাডে আমার সাথে প্যানেলিস্ট। সমাপনী পর্বে মূল মঞ্চে রবীন্দ্রনাথের গানও গাইবেন তিনি। তাঁর ফোনের কারণ একটি গানকে বদলানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি এবং কী-বোর্ডিস্ট জাহিদ সাহেব। যেহেতু মমতার গানের সাথে এক-দুই বাক্য ইংরেজিতে বলে সুতোটা আমিই ধরে রাখবো, তাই আমাকে তাঁর আপডেট দেওয়া।

নীলিমা ফিরলেন দশটার দিকে। প্রতিমা ফেরার সময় নামিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি শুতে গেলেন খানিক পরেই। আমি বিছানাতে গেলাম সাড়ে এগারো নাগাদ। দৈনন্দিন অভ্যাসের মতো খানিক পরেই ঘুম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে। দেয়ালে লাগানো ঘড়ি বলছে মাত্র বারো। ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতেই আবার ঘুম। আবার ঘুম ভেঙে – ভালো লাগছে না। বুকের মধ্যে কেমন চাপ চাপ ভাব। মনে পড়লো সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর একবার ওই চাপটা টের পেয়েছি। ঘুম কম হয়েছে ভেবে আবার খানিক ঘুমিয়েছিলাম সোফাতে। ঠিক হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়লো আগের দিন অর্থাৎ সোমবার সকালেও ওমন একটা চাপভাব অনুভব করেছি। সেটাও খানিক নতুন করে ঘুমানোর পর কেটে গিয়েছিল। নাহ, এবার যেন কাটছেই না।

বিছানা ত্যাগ করে লিভিং রুমে এলাম। এমনি এমনি শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। সময় কাটছে। নীলিমাকে তখনও ডাকিনি। সারাদিনে বেচারি অনেক দৌড়ঝাঁপ করেন। মাত্র ঘুমিয়েছেন। তাঁকে ডেকে বিরক্ত করতে মন চায়নি একটুকুও। রাত একটা নাগাদ হঠাৎ মনে হলো প্রেসারটা দেখি। মেশিন লাগাতেই  চোখ ছানাবড়া – ১৭০ বাই ১২০। শরীর খারাপ লাগলে যে প্রেসারটা আগে দেখতে হয় এই সহজ জ্ঞানটা ষাট পেরিয়েও আমার হয়নি। শরীর সবসময় ফিট থাকাও বোধ করি এর একটি কারণ। কিন্তু আর দেরি নয়। আস্তে করে বেডরুমে ঢুকে লাইট জ্বালালাম। নীলিমা প্রেসারটা আবার মাপলেন। একই রিডিং। মেয়ের ঘুম ভেঙে না যায় সেভাবে দুজনে নিঃশব্দে এলাম লিভিঙে। মেয়েটাকে সকাল ছয়টায় উঠে নতুন কাজের জায়গাতে যেতে হবে। আর তাই আমাদের দুজনের নিঃশব্দ চলাফেরা।

প্রেসার কমাতে নীলিমা এক গ্লাস তেতুল জল দিলেন। সেটা খাওয়া হলে প্রেসারের ওষুধ দিয়ে খেতে বললেল। যেহেতু গত ছয় বছর ধরে বেবি এস্পিরিন খাচ্ছিলাম দৈনিক একটা করে, কী ভেবে নীলিমা একটা এস্পিরিনও দিলেন। তখন পর্যন্ত আমার খারাপ লাগলেও কোনো তীব্রতা ছিল না। ব্যাথা ছিল না। ঘাম ছিল না। ঘাড়ে চেপে ধরা ছিল না। কিন্তু যেটা ছিল সেটা হলো একটা অস্বস্তি – বুকে চেপে ধরা ভাব। ইতোমধ্যে নীলিমা দুইবার ৯১১-এ কল করার কথাও বলেছেন। কিন্তু করিনি কারণ শরীরতো ততো খারাপ লাগছে না।

কিন্তু এর এক দুই মিনিটের মধ্যেই টের পেলাম বুকের অস্বস্তি আর চেপে ধরা ভাবটা তীব্র হয়ে যাচ্ছে। নিজেই ফোন হাতে নিয়ে ৯১১-এ কল দিলাম। ‘ফায়ার নাকি এম্বুলেন্স?” উত্তরে এম্বুলেন্স বলতে বলতেই নীলিমা মেয়েকে ডেকে তুলেছেন। ফোনটা মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি। ওই এম্বুলেন্সের মানুষদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে চলেছে। আমি খাটের উপর গড়াগড়ি করছি অসহ্য কষ্টে। সব মিলিয়ে ৮-১০ মিনিট যাবার আগেই দুই নারী প্যারামেডিক ঘরে এসে ঢুকে আমার ইসিজি শুরু করে দিয়েছেন।

বুঝতে পারছি বুকের অস্বস্তি আর চেপে ধরা ভাবটা দ্রুত তীব্রতর হয়ে চলেছে। টের পাচ্ছি বোধ করি আর বেঁচে থাকা হবে না। মেয়ে ইতোমধ্যে রেডি হয়ে গেছে এম্বুলেন্সে ওঠার জন্য। স্ট্রেচার ঘরে ঢুকিয়ে তাঁর উপরে তোলা হলো আমাকে। নামানো হলো নিচতলায়। ওঠানো হলো এম্বুলেন্সে।

আমি তখন আর কিছুই আর শুনছি না। শুধুই অভ্যেসবশত মাগো মাগো করছি। মেয়ে বসেছে ড্রাইভারের পাশে। পেছনে স্ট্রেচারে আমি আর পাশের সিটে একজন প্যারামেডিক আমাকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। অস্থির করে ফেলছে বুকের চাপটা। ‘বাবা, বাবা’ বলে মেয়েকে ডাকছি। সে একটুও না ভেঙ্গে পরে সাড়া দিয়ে চলেছে। বুঝতে পারছি গাড়ি ছুটে চলেছে টরন্টো জেনারেল হাসপাতালের দিকে। বার বার মনে হচ্ছে গাড়িটা হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছানো পর্যন্ত বোধ করি আমি আর টিকে থাকবো না। জানতাম না এটাকেই হার্ট এটাক বলে। জানতাম না এমন খারাপ লাগা থেকেই মানুষের মৃত্যুও হতে পারে।

ইতোমধ্যে প্যারামেডিক আমাকে ওষুধ দিয়েছেন। কী ওষুধ জানি না। আমার চৈতন্য ততক্ষণে অনেকখানিই কমে গেছে। সবকিছু ঝাপসা দেখছি। ঝাপসা বুঝছি চারপাশ। মাথায় যা কিছু ভর করছে সব ঝাপসা ঝাপসা। একসময় বুঝতে পারলাম গাড়ি হাসপাতালে। স্ট্রেচার ঠেলে এগুতেই দেখলাম ৭/৮ জন ডাক্তার-নার্সের পোশাক পরা মানুষ চারপাশে। মেয়েকে তারা কিছু বললেন। কতোটা রিস্ক সেটাও বললেন। একটা কাগজ আমাকে দেওয়া হলো। আমি স্বাক্ষর  করলাম। মনে পড়ছে একটু দেখলাম ওটা আমার স্বাক্ষরের মতো হলো কি না। মুহূর্তেই স্ট্রেচার এগিয়ে চললো। বুঝতে পারছিলাম মেয়ে পিছিয়ে পড়ছে দ্রুত ধাবমান চিকিৎসক দলের দৌড়ের তুলনায়। শেষ একটা কথা বলতে চাইলাম মেয়েকে – সেটাও আর বলার সুযোগ হলো না।

ধাই ধাই করে স্ট্রেচার এগিয়ে ঢুকে গেলো একটা এলিভেটরে। এরপরেই টেবিলে। দেখছিলাম চারপাশে অনেক বড়ো বড়ো যন্ত্রপাতি। ক্রমে সব আরও বেশি ঝাপসা। বুঝলাম কিছু কাটাছেড়াও চলছে। একসময় বুঝলাম প্রচণ্ড বমি করছি। কেউ মুছিয়ে দিতে কাছে আসছে না। বমি মুখে-চুলে লেগে যাচ্ছে। হায় হায়!

যখন চৈতন্য ফিরলো টের পেলাম মেয়ে আর মিন্টু ভাই দাঁড়িয়ে। খানিক পরেই নীলিমা এসে দাঁড়ালেন। সেই চাপটা নেই। কোনো অস্বস্তিও নেই। ঝরঝরে বুক।  বুঝতে পারলাম একেই বলে জীবন ফিরে পাওয়া। একেই বলে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা।

ক্রমে ক্রমে জানতে পারলাম আমার নাকি ম্যাসিভ হার্ট এটাক হয়েছিল। তিনটি প্রধান ধমনীর একটি এক শ ভাগ ব্লক হয়ে গিয়েছিল। ডান হাতের কবজীর ধমনী কেটে এনজিও গ্রাম করে ওটাতে স্টেন্ট দেওয়া হয়েছে। আরও জানলাম আমার বাসাতে থাকতেই দুই প্যারামেডিক স্কারবোরো জেনারেল এবং মাইকেল গ্যারন হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। কিন্তু গভীর রাতে হৃদযন্ত্রের এমন অবাধ্য ব্যবহার সামলানোর মতো ব্যবস্থা না থাকায় গন্তব্য হয় টরন্টো জেনারেল।

পরে আরও জানলাম আমার হৃদয় দশ সেকেন্ডের মতো নীরবতা পালন করেছিল। তাঁকে সরব করতে ইলেক্ট্রিক শকের দরকার হয়। সেই শকের কারণের পাকস্থলী উগরেছে সব। জানলাম অন্য আরও দুটি উপধমনীও অনেকখানি ব্লক। ৯০-৮০ ভাগ করে। দুই দিন পর্যবেক্ষণ সেড়ে ওরা জানাবেন কী করণীয়। দুইদিন পর এসে গেলো শুক্রবার। লং উইকএন্ড আসন্ন। জানানো হলো হাসপাতালে থেকে গেলেই ভালো হয়। তাহলে ছুটি শেষে ওরা মঙ্গলবার সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। না হলে আমি যদি একমাস পরেও আবার হাসপাতালে যাই, তাহলেও নতুন করে শুরু করতে হবে একই মেডিকেশন। মেডিকেশন যেহেতু চলছে  তাই বাকি ব্লক দুটো আনব্লক করে বাড়িতে ফেরাই ভালো। এক সপ্তাহ পর বুধবার ওই কাজটুকু করা হয়েছে। কষ্ট হয়নি বেশি, কিন্তু বুকের মধ্যে কেমন এক শক্ত এক চেপে ধরা অনুভূতি ছিল স্টেন্ট বসানোর সময়।

পরে আরও জানলাম মেয়ে সেই বুধবার কাকভোরে ঢাকাতে ফোন করেছে। নীলিমা ওর বন্ধুদেরসহ মিন্টুভাইকে জানিয়েছেন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় কাটিয়েছেন পরিবারের মানুষেরা, বন্ধুজনেরা, প্রিয়জনেরা। বহুজন প্রার্থনায় রেখেছিলেন। কেউ কেউ পূজা দিয়েছেন সুস্থতা কামনা করে।

নিজের ঘরে ফিরেছি নয়দিন পর – ১৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। কোনো কোনো বন্ধু বলেছেন, নতুন জীবন শুরু হলো। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়। জীবনটা যেতে যেতে রক্ষা পেলেও এই জীবন নতুন নয়। গাড়ি এক্সিডেন্টের সময়ও মনে হয়েছিল এমন একটা দুর্ঘটনায় তো আমার বেঁচে থাকার কথা নয়। কিন্তু বেঁচে রয়েছি। হাজার প্রতিকুলতা কাটিয়ে ২০১৩ সালে যখন কানাডায় চলে এসেছিলাম মনে হয়েছিল নতুন জীবন লাভ করেছি। কিন্তু সেটা যে নতুন জীবন শুরু নয় সেটা টের পেলাম অল্পদিনেই। কারণ এমন পরিস্থিতির পরেও আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে এঁটে থাকে সেই অতীত, সেই সমাজ, সেই হিংসা-দ্বেষ, সেই লোভ-লালশা – কিছু থেকেই যেন মুক্তি হয় না।

তাহলে হয়টা কী! আমাদের মধ্যে একটা পরিশোধন ঘটে। আমরা বুঝতে পারি যেই জীবন নিয়ে এতো যে আমার অহংকার, সেই জীবনের এক মুহূর্তের নিশ্চয়তা নেই আমার হাতে। আর তাই বুঝতে পারি আরও বেশি করে মানুষের জন্য নতুন করে কাজ করতে হবে। নিজেকে সৎ রেখে নতুন উদ্যমে মানুষের জন্য কাজ চালিয়ে যাওয়াই জীবন। বুঝতে পারি, কাজই জীবন। যেই জীবনে কাজ নেই, সেই জীবন অর্থহীন।

তবে নিজের জন্য এটুকু বুঝতে পারি, জীবন যদি হিংসা-দ্বেষ আর লোভ-লালশা থেকে ইতোমধ্যেই মুক্ত হয়ে থাকে তাহলে এমন করে জীবন লাভ করা শুধুই স্বস্তির। সেদিন আমার মৃত্যু হয়ে গেলে, আমার বিশেষ আর কোনো কষ্টই হতো না। কিন্তু চারপাশের বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে কী যে হাহাকার হতো! আমার নতুন জীবন পাওয়াতে সেই বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা। এই যে আনন্দের বন্যা এর নামই জীবন। আমাদের জীবন সর্বদাই আনন্দে পরিপূর্ণ থাকুক এই কামনা করি।

 

ইষ্টইয়র্ক, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles