0.6 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

বিচিত্রা

বিচিত্রা
বিচিত্রা

মহা মূল্যবান এক সম্পদের খোঁজ পেয়েছিলাম বিয়ের তিন-চারদিনের মাথায়। শ্বশুর বাড়িতে যে এতো সম্পদ আছে বিয়ের আগে তা জানতে পারিনি। তাহলে হয়তো বিয়েটা আরও আগেই করে ফেলতাম। এক তারিখে বিয়ে, দুই তারিখে বউভাত। বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে রোজীকে নিয়ে গেলাম তাদের আজিমপুরের বাসায়। পরেরদিন নাস্তা খেয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির বাসাটা দেখতে শুরু করলাম। বেশ লম্বা তিনতালা একটা বাড়ি। দ্বিতীয় তলার দুটো ফ্লাটে ওনারা থাকেন। মানে বাড়ি এদিকে-ওদিক অংশে। উপরের আর নিচ তলার ফ্লাটগুলো ভাড়া দেওয়া। বসার জন্য দোতালায় খোলা একটা যায়গা ছিল, পরবর্তীতে আমি জায়গাটার নাম দিয়েছিলেম রোদ বারান্দা। নারকেল গাছের একটা পাতা গ্রিল ভেদ করে খানিকটা ভেতর মুখি। পেছনে আজিমপুর নতুন কবরস্থান। রোদ বারান্দায় পাশাপাশি দুটি চেয়ার পাতা। ওটা হলো মালেক দম্পতীর পত্রিকা পাঠের স্থান। সে সময়ও পিলখানা গেটের আশেপাশের বাড়িগুলো ছিল লাগোয়া বাড়ি। সেকারণে গ্রিলের ভেতর দিকে থাকতো বাঁশের তৈরি ঝুলন্ত পর্দা। চারটি মেয়ে বড় হয়েছে এ বাড়িতে। বাঁশের তৈরি ঝুলন্ত পর্দার সুবিধা হলো, তাতে রোদ আসতো। আলো আসতো আবার পর্দাও হতো। রাজ্যের খবরের কাগজ আসতো প্রতি সকালে। সপ্তাহ শেষে আরও অনেক বেশি। একসাথে এতোগুলো সৌজন্য সংখ্যা আগে কখনো দেখিনি। রোদ বারান্দার ফ্লোর ঢেকে যেত সেই সমস্ত পত্রিকার আড়ালে।

টুর শেষ করে ফিরে আসতেই চোখের সামনে এক পাহাড় এসে দাঁড়াল। মনে হল পাহাড়ের স্তরে স্তরে রয়েছে হাজারো মণিমুক্তা। এতো সম্পদের খোঁজ পাবার সাথে সাথে মাথায় ফেরেশতা এসে ভর করলো। আমিও সাহস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলাম। চিন্তাভাবনা করে সঠিক ভাষা খুঁজে নিলাম যতে কোন ভাবেই হাত ছাড়া হয়ে না যায় রাজ সম্পদ। মনে মনে ঠিক করলাম, আমার সাথে এ বাড়ির সবার বন্ধুত্ব হবে। এ বাড়ির জামাই না হয়ে আমি হবো সকলের বন্ধু।  শাশুড়িকে হাসাবো, স্ত্রীর বড় বোনদের সাথে লুডু খেলবো, শ্যালকদের সাথে ক্যারাম-বোর্ড, গম্ভীর গম্ভীর দুলাভাইদের সাথে খেলবো ঘরোয়া খেলা। কিন্তু মুশকিল হলো যে পরিবারের সকলে পা টিপে টিপে হাঁটে যাতে শব্দ না হয়, কথা বলেন ভৈরবী রাগে, উচ্চ স্বর, চেঁচামেচি কিছুই নেই। সে বাড়িতে কি সহজেই হৈ হৈ পরিবর্তন আনা সম্ভব? শাশুড়ির কাছে কি প্রথম দিনেই আবদার করা যায়? তবুও চেষ্টা করতে দোষ কী?

- Advertisement -

বিকেলে চা খেতে বসে শাশুড়িকে বললাম। আপনার বাড়িটি বেশ বড়। অনেক কিছু চোখে পড়ল। যখন ভাগ বাটোয়ারা করবেন আমাকে কিন্তু কিচ্ছু দিতে হবে না। আপনার অন্য জামাইদের টাকা পয়সা জমি জমা যা দেবার দিয়ে দেবেন। ওসব আমার লাগবে না। কেশে-কুশে বললাম, ঔ আলমারিটাও আপনার থাকবে, শুধু আলমারির ভেতরে বাঁধাই করা বিচিত্রাগুলো আমাকে যৌতুক হিসেবে দিয়ে দেন আম্মা। তারপর হাত চেপে ধরলাম। প্লিজ।

তাৎক্ষণিক একটা সাফল্য দেখতে পেলাম। বেশ সরল মনের মানুষ ছিলেন আমার শাশুড়ি। দেখলাম মাথায় ঘোমটা টেনে মিটিমিটি করে হাসছেন। বড়শীতে মাছ ধরেছে, এবার আস্তে আস্তে টানতে হবে। আরও একটু মোলায়েম করে অতিরিক্ত মন ভোলানো কিছু কথা বললাম। কী অবাক কাণ্ড সাথে সাথে তিনি রাজি হয়ে গেলেন। কথাও দিলেন। আর এভাবেই বিয়ে হতে না হতেই আমি বিরাট সম্পদের মালিক হয়ে গেলাম।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার এক বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলা থেকে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশনা বের করা হয়েছিল। যার নাম ছিল ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’। জনপ্রিয়তা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং পাঠক প্রিয়তার দিক থেকে এখন পর্যন্ত হয়তো বাংলাদেশের আর কোন সাপ্তাহিক পত্রিকা বিচিত্রাকে টপকাতে পারেনি। প্রতি সপ্তাহের চমকপ্রদ প্রচ্ছদ, গবেষণা মূলক প্রতিবেদন, ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন, পাঠকের পাতা, রনবীর কার্টুন, কবিতা, গল্প, উপন্যাস এসবের জন্য পাঠক সমাজ একসময় মুখিয়ে থাকতো বিচিত্রার জন্য। বলা যেতে পারে স্বাধীন বাংলাদেশের সমাজ অধ্যক্ষের আসন নিয়ে ফেলেছিল বিচিত্রা। ‘আমি বিচিত্রা পড়ি’ এই ধরনের একটি পাঠক সমজ তৈরি হয়ে গিয়েছিল আমাদের দেশে। এখন চিন্তা করলে অবাক লাগে যে, একটি পত্রিকার ছায়াতলে বেড়ে ওঠা রুচিশীল সমাজ ছিল আমাদের। প্রতিটি সংখ্যা যেন ধারণ করে রাখতো আগামী দিনের জন্য তথ্যভাণ্ডার, ইতিহাস, রূপকথা। যাইহোক, আমার শ্বশুর সাহেব প্রথম দিন থেকেই সেই বিচিত্রার সাথে জড়িত ছিলেন। সম্পাদক সাহেবের নাম গড়িয়ে একদম শেষে থাকতো তাঁর নাম, জেনারেল ম্যানেজার; আব্দুল মালেক। স্বভাবতই প্রতি সংখ্যার একটা সৌজন্য কপি পেতেন তিনি। বিচক্ষণতার সাথেই তিনি প্রথম দিনের প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে বাড়ীতে আসা প্রতিটি সৌজন্য সংখ্যা বাঁধাই করে রেখেছিলেন। যেন একটি যাদুঘর কিংবা লাইব্রেরী তৈরি করছিলেন তিনি। বছরের সংখ্যাগুলো কয়েকটি খণ্ডে মোটা মোটা বাঁধাই করে সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন। বাদ ছিল না ঈদ সংখ্যা কিংবা বিশেষ দিনের কোন সংখ্যা।

বিয়ে হবার দুই বছরের মাথায় আমি বিদেশে চলে এলাম। কয়েক বছরের মধ্যে ওনারাও বাসা বদল করলেন। এই অদল-বদলের সময় এতোগুলো বিচিত্রা বেশ ভারি হয়ে গিয়েছিল তাদের জন্য। মানুষের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবকিছুর ওজনও বেড়ে যায়। হাতের কাছের জিনিস আকারে আকৃতিতে ছোট হোলেও ওজনে তা ভারি হয় যায় শেষ বয়সে। তবুও অনেক পুরানো জিনিস ফেলে এলেও একটিও বিচিত্রা ফেলে আসেননি আমার শ্বশুর-শাশুড়ি। ছোট ছোট তাকে সেগুলো ভাগাভাগি করে রেখে দিয়েছিলেন আমার জন্য।

শ্বশুর এবং শাশুড়ির মৃত্যুর পর স্ত্রীর ছোট ভাইকে বিচিত্রাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করলাম। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে অনেক সময় অনেক মানুষ তাল হারিয়ে ফেলে। বিচিত্র কপালে তাল-বেতাল হাল এসে হাজির হলো। প্রথমে ৮৮’র বন্যা খেয়ে নিলো বিশাল পাহাড়ের অর্ধেক, এরপর উইপোকা, পিপীলিকা, টিকটিকি এবং একসময় ইবলিশ শয়তান এসে কাঠের তাকগুলো খালি করে দিল। সেই থেকে আমি ভিখারি।

শাশুড়ি যেহেতু ছোট জামাইকে কথা দিয়ে ফেলেছেন, তাই বিয়ের পরের সংখ্যাগুলোও অর্থাৎ ১৯৮৫’র পরবর্তী সংখ্যাগুলো আরও বেশি যত্ন করে বাঁধাই করতে শুরু করে দিয়েছিলেন আমার শ্বশুর। খুব ধীর স্থির স্বল্পভাষী ভদ্রলোক মানুষ ছিলেন আব্দুল মালেক। মুখ ফুটে বলেন নি কখনো কিন্তু কেন যেন মনে হতো আমাকে তিনি তাঁর চতুর্থ পুত্রের মতো আদর করতেন। দৃশ্যমান কিংবা অদৃশ্যমান অবস্থায় আমি যেন তাঁর কাছাকাছিই থাকতাম। বিচিত্রাগুলো বাঁধাই করে রেখে দেওয়ার পরও যখনই সুযোগ পেতেন এক কপি, দুটি কপি করে কানাডাতেও পাঠিয়ে দিতেন। শুধু বিচিত্রা নয়, প্যাকেজের ভেতর থাকতো তাঁর হাতে লেখা চিঠি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, কুশলাদি আর  সম্পর্ককে কাছাকাছি যুক্ত রাখার প্রচেষ্টা। যেদিন স্নেহ মায়া মমতার সেই হাত স্থির হয়ে গেল, সেদিন থেকে ডাকপিয়নের ঝুলি থেকে সোনার ময়না পাখি উঁকি দেওয়া চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল। জীবিত কালে একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার আম্মা যখন বললো, বিচিত্রার কপিগুলো তুমি চেয়েছ সেদিন থেকে ভার মুক্ত হয়ে গেছি’। শ্বশুর সাহেবের এই কথার গুরুত্ব হয়তো বুঝতে পারিনি। হয়তো পেরেছিলাম। তাই এখনো বসে বসে ভাবি, মৃত্যুর সময় আমাকে কাছে পেলে হয়তো বলে যেতেন, বিচিত্রাগুলোর যত্ন নিও।

বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া সত্ত্বেও একসময় সাপ্তাহিক বিচিত্রা বন্ধ হয়ে গেল। অবসরে চলে গেল খুব জরুরী একটি বিবেকী প্রচেষ্টা। মে ১৯৭২ – অক্টোবর ১৯৯৭, এই ছিল বিচিত্রার জীবিত কাল। মাত্র পঁচিশ বছর বেঁচে থেকে আজও বিচিত্রা বিশ্বাসযোগ্য সূত্র হয়ে টিকে আছে। সাপ্তাহিক বিচিত্রার শেষ সংখ্যাটি সযত্নে রাখা আছে আমার কাছে। সেটারই প্রচ্ছদ দেখতে পাচ্ছেন। ইচ্ছে করেই আব্দুল মালেকের স্বাক্ষরটি হলুদিয়া পাখির রঙে রাঙিয়ে দিলাম। যিনি ‘বিচিত্রা’কে তাঁর আরেকটি সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন।

 

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles