
ভাবি চোখ-মুখ লাল করে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
– এই তোমার ব্যাবসার জরুরি মিটিং,ভালো।
– তুমি বুঝতে পারছো না, আমি একটু আগে এসেছি।
– আমাকে তো জানানো যেতো,কই একবার ও তো বলোনি তুমি এখানে আসবে। পাতা তোমার সাথে তো আমার কথা হয়েছে,তুমি ও তো একটা কল দিতে পারতে?
– ভাবি আমি এখন যা-ই বলবো আপনার কাছে সে টা গ্রহণ যোগ্য হবে না। এই মুহূর্তে আপনি যা দেখেছেন তাই আপনার কাছে চিরন্তন সত্য মনে হবে। আব্বা অসুস্থ, একটু পরে রুগীর গার্ডিয়ানস্ হসপিটাল ত্যাগ করতে হবে। আমি এই বিষয় পরে আপনাদের সাথে কথা বলবো। এখন যা দেখেছে তা আংশিক সত্য বাকিটা আপনার ধারনা মাত্র।
– শোন, পাতা নিজেকে খুব বেশি চালাক মনে করো না। কোন কিছু জিজ্ঞেস করলে তোমার উত্তর হয়- ‘পরে এই বিষয়ে কথা বলবো?’
তুমি কি বুঝতে চাও পাতা? নিজের জীবন টা তো শেষ করে ফেলেছ,এখন আমাদের জীবন টা তছনছ করতে এসেছ?
আর তোমাকে কি বলবো?
শত্রু তো আমার ঘরে আমার খাটে।
তোমার জীবন যদি এতো পাতাময় হয়ে আছে তবে আমাকে পটিয়ে বিয়ে করেছিলে কেন? গাছের ও খাবে নিচের টা ও কুঁড়াবে, তাই তো?
তোমার মতো শয়তান পুরুষ আমি জীবনে দ্বিতীয় টি দেখিনি।
– আমি কিন্তু এখানে চাচা কে দেখতে এসেছি। পাতার সাথে কোন কথা বা যোগাযোগ হয়নি। পাভেল ভাইয়ের সাথে একটা দরকারে কথা হয়েছিল, তিনি তখন জানিয়েছেন। তুমি পাতা কে কোন কথা বলে অপমান করো না। এখানে ওর কোন হাত নেই,আগ্রহ নেই।
বাসায় চল,তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি।
আম্মা বললো –
– শোন বউ,অনেক কথা বলে ফেলছ। আমি চুপচাপ আছি বলে, এই না তুমি যা মনেচায় তা বলে আমার মেয়ে কে অপমান করবে। আমার মেয়ে যথেষ্ট জ্ঞান নিয়ে চলে,তোমরা এই পরিস্থিতির স্বীকার হলে গিয়াস উদ্দিনের মতো চারজন কে কবজা করতা….
আমি দ্রুত আম্মার মুখ চেপে ধরলাম। বয়স্ক মানুষ কি থেকে কি বলে ফেলবে।
গিয়াস উদ্দিন ভাই একরকম জোর করে টানতে টানতে তার বউকে নিয়ে গেছে।
আম্মা আমাকে বললেন-
– তোর জীবন টা কি ভুল করা,ভুল বুঝার জন্য সৃষ্টি হয়েছে? এতো কথা বলে ফেললো তুই কিছু বললি না আমাকে বলতে দিলি না ক্যান।
– হয়তো ভুলের জন্য ই আমি সৃষ্টি ,বাদ দাও। মানুষের জীবনে আরো কত ঝামেলা থাকে। সবকিছু তে উত্তর দিলে হয় না আম্মা।
আমি মুখ বুজে সহ্য করার মানুষ না আম্মা। যখন দেখবো আমার উপর অন্যায় সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে তখন চুপ থাকবো না। ভাবি এখন অসহায় তাকে আঘাত করে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করছে না। সে কিছু বলে শান্তি পেলে বলে নিজেকে শান্ত করুক।
আব্বা কে বাসায় আনার পর থেকে
জামান সাহেবের কোন খোঁজ পাচ্ছি না। মানুষের সব জায়গায় একটা ছায়া দরকার হয়।
বাহিরের মানুষের কাছে পরিবার একটা ছায়া,আবার পরিবারের মানুষের কাছে বাহিরের একটা মানুষের শক্ত ছায়া লাগে। আমার জীবনের তপ্ত রুদে নিরব ছায়া হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এই মানুষ টা। নয়তো পরিবারে কটুক্তির বাণে আমি ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যেতাম।
অফিস শেষ করে জামান সাহেবের খোঁজ নিতে শুরু করলাম। যেখানে যেখানে তার খোঁজ মিলে। মোবাইল বন্ধ দেখাচ্ছে, অফিসে কল দিলে তার ম্যানাজার কোন তথ্য দিতে পারছে না। ম্যানেজারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে তার বাসায় গেলাম। বাসা বললে চরম ভুল হবে,রাজ প্রাসাদ বলতে হবে।
দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করলাম –
– জামান স্যার কোথায়? তার কোন খবর পাচ্ছি না কেন?
– স্যার কোথায় আমি কেমনে বলমু? তারা কই যায় না যায় এসব কি আমাকে বলে।
– প্লিজ কোন একটা তথ্য দিন,তার কোন খবর আমি পাচ্ছি না। খুব চিন্তায় আছি।
– মেডাম আপনি ভিতরে গিয়ে কেয়ারটেকার কে জিজ্ঞেস করেন। সে জানতে পারে।
কেয়ারটেকার কিছু জানে না বলতেই আমার মেজাজ চরম খারাপ হয়ে গেল। একরকম চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম-
– এটা কেমন কথা? যার চাকরি করছেন। যেখান থেকে রোজগার করে আপনাদের পরিবার চালাচ্ছেন। তার কোন খবর আপনাদের কাছে নেই। ম্যানাজার জানে না,দারোয়ান জানে না,কেয়ারটেকার জানে না তাদের মালিক কোথায়। আপনারা কি করার জন্য এখানে আছেন?
আমি থানায় যাবো,দেখি কে কি জানে আর কে কি জানে না।
বলে দ্রুত পা’য়ে বের হয়ে আসলাম।
আমি এতো বন্দুরপথ অতিক্রম করেছি,মাঝেমধ্যে হাঁপিয়ে উঠেছি সত্যি। তবে কখনো এতো অসহায় হয়ে পরিনি। জামান সাহেবের অনুপস্থিতি আমাকে অসহায় করে ফেলেছে।
বারবার মনে হচ্ছে আমার পাশে কেউ নেই। অথচ এই মানুষ টি খুব অল্প দিন ধরে আমার পাশে আছেন।
রাস্তার পাশের একটা দোকান থেকে কোল্ড ড্রিংক কিনে গলা ভিজালাম। আমার বান্ধবী শুভার বাসায় যাই,অনেক আগের বান্ধবী। খুব একটা যোগাযোগ নেই,তারপর ও তার সাথে যখনই দেখা হয় তখন-ই সুখ-দুঃখের রাজ্যের গল্প জুড়ে বসি।
মনে অনেক কথা জমে গেছে,কিছু টা হাল্কা হওয়া দরকার।
শুভার বাসা টা খুব সাধারনের মাঝে অসাধারণ করে তুলেছে তার হাতের ছোঁয়ায়। টিন শ্যাড একতলা বাসা। বিল্ডিংয়ে সবুজ সবুজ শ্যাওলা গুলো খুব কাছ থেকে দেখলে বুঝা যায়, এরা মস,ফার্ণ। এদের আকৃতি খুব সুন্দর। এদের একটু হাত বুলিয়ে আদর করলাম জেনো সবুজ মখমল বিছিয়ে আছে দেয়াল জুড়ে।
স্টিলের গেইট খুলে ভেতরে ঢোকলে পায়ে হাঁটার রাস্তার দুই পাশে ফুলের বাগান। খাঁচায় বন্দী ময়না টা আমাকে দেখে বলছে-
– মেমান আইচে পিড়ি দেও। আম্মা, আম্মা..
কিছুক্ষন মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম পোষা ময়নার দিকে।
খাঁচার ভিতর তর্জনী আঙুল ঢোকিয়ে বললাম-
– কি পাকনা রে তুই!
ময়না ও সাথে সাথে বললো-
– কি পাকনা তুই।
আমি হেসে দিলাম,ময়না টা আমার হাসি নকল করে হাসছে।
রাস্তা টা ঝকঝকে পরিষ্কার। পেয়ারা গাছে লাল টুপি টা নাচ্ছে বুলবুলি পাখি। আতাফল গাছের নিচে সিমেন্টের গামলায় ফুটে আছে লাল শাপলা। স্বচ্ছ পানিতে আছে গোল্ড,গাপ্পি,মলি আরো কিছু নাম না জানা মাছ। মাছ গুলো কেমন লেজ দুলিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে। দেখলেই মনটা ভাল হয়ে যায়।
শুভা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলো-
– কেমন আছিস রে পাতা? আজ কিন্তু থেকে যাবি,পাতা।
শুভা ঠিক আগের মতোই আছে। সাধারণ একটা থ্রি পিস পরা । কানে এক পুঁথির ফুল,নাকে একটা স্বর্নের নোলক।
এই মেয়ে টা খুব সাধারনের মাঝে অসাধারণ লাগে আমার কাছে। কোন ঝামেলায় নেই,নিজরে মতো চলতে থাকে।
ওর ছোট ছোট দুই মেয়ে। শুভা দুধ জ্বাল দিয়ে মেয়েদের দিয়েছে,আমরা চা’য়ের কাপ হাতে গল্প করছি।
এমন সময় ছোট মেয়ে টা বড় মেয়ের কাপ থেকে এক আঙুল দিয়ে দুধের সড়টুকু তুলে নিজের মুখে পুরে নিল।
ব্যাস, আর যায় কোথায়। শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ।
এমন যুদ্ধ কত দিন দেখিনা। সহোদরের এমন যুদ্ধ গুলো প্রশান্তিময়।