-5 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

টরন্টোর পূর্ব সীমানায়

টরন্টোর পূর্ব সীমানায়
ঘন্টাখানেক পর সে আমার ঘাড়ে টোকা দিয়ে দুশো গজ দূরের পাবলিক টয়লেট নির্দেশ করে উঠে গেল

আমরা মাছ ধরতে গেলাম টরন্টোর পূর্ব সীমানায়, ন্যাশনাল আরবান পার্কে; রুজ নদীর মোহনায়।

ভীড় বেশি থাকায় আধা কিলোমিটার দূরে গাড়ি পার্ক করতে হলো। বন্ধুর গাড়ির পেছনের ডালা খুলে আমি হাঁটু গেড়ে বসলাম। সে নব্বই লিটারের, পঞ্চাশ কেজি ওজনের বিরাট বাক্সটা আমার মাথায় তুলে দিলো। ভারী বিধায় স্টেপ ফেলছিলাম ছোট করে। আমার আরেক হাতে ধরা ছিপ বড়শি। অনেকটা মুড়িআলা স্টাইলে হাঁটতে হচ্ছিল।

- Advertisement -

বন্ধু আমার ঠিক পাশে হাঁটতে লাগলো।

তার কানে মেবাইল ধরা; ব্যাস্ত ভঙ্গিমায় কথা বলতে বলতে এগুচ্ছে। তার আরেক হাতে টিম হর্টনস এর কফির মগ। আমরা জলাশয়ের ধারে পৌঁছে জুতসই জায়গা খুঁজতে থাকি। সে এক চাইনিজ ভদ্রলোকের কাছাকাছি গিয়ে আমার মাথা থেকে বাক্সটা ধরে নামালো। দুটো চেয়ার পেতে, বিরাট ছাতা ফুলিয়ে ছিপ-বড়শি ঠিকঠাক করে টোপ ছুঁড়ে বসে গেলাম। কাপড়ের ব্যাগে ফ্লাস্ক ভর্তি চা, হটডগ, পটেটো চিপ্স, ওয়ালমার্ট থেকে আনা বড়ো ছয়টা সিঙ্গারা।

আমার হাতে পয়ত্রিশ ডলারের ছিপ আর বন্ধুর হাতে তিন হাজার পাউন্ড দামের মেইড ইন ইংল্যান্ড ছিপ। খাসা জিনিস একটা! অনেকের কাছে হিংসার বস্তু। মাছ ধরতে গেলে অনেকেই আগ্রহ ভরে কাছে এসে আলাপ জুড়ে দেয় ছিপ নিয়ে। তার গর্বের শেষ নাই। যদিও এই ছিপ দিয়ে সে কখনো মাছ ধরেছে বলে মনে পড়ে না। তবে আলু সাইজের কাছিম উঠেছে কয়েকবার। তার কাছেই জীবনে প্রথম জানতে দুনিয়ার সবচাইতে কঠিন কাজ হলো কাছিম ধরা।

আমরা ঘন্টাখানেক চুপচাপ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম সুতোর দিকে। কার্প মাছ ধরার বিশেষ পদ্ধতি আছে। কোনো ফাতনা থাকে না। ভারী সীসার মাথায় টোপ দিয়ে সুতো টানটান করে ফেলে শুধু অপেক্ষা করা। আমাদের কাজ হবে শুধু মাছ টেনে তোলা। যদিও সে সৌভাগ্য কখনো হয়নি..

আমরা মাছ ধরার সময় কখনোই কথা বলি না। আওয়াজ করলে মাছ পালায়। তার অভিযোগ অতীতে মাছ না পাওয়ার একমাত্র কারন নাকি আমি। আমার উচ্ছস্বরে কথা বলা আর খুটখাট আওয়াজের কারণে মাছ আসে না। তাই মোবাইল রিং বন্ধ রাখলাম। এমন কি ভাইব্রেশনও অফ করে রাখলাম; মাছেরা যদি ঝাঁকুনী টের পায়?

আমাদের আরেকপাশে এক বাঙালি মহিলা বসা। উনি মাছ ধরাতে সিদ্ধহস্ত। একটা কার্প ধরে নাকে দড়ি দিয়ে পানিতে চুবিয়ে রেখেছে চাইনিজটার মতো। ভদ্রমহিলা বেশ কিছু ক্যাট ফিশ (মাগুর ধরনের) আর পাইক ফিসও ধরেছে। চিশতী অবশ্য চুনোপুটি মাছ ধরে না। তার যুক্তি হলো- হয় আধা মন বোয়াল সাইজের মাছ ধরবি, নয়তো কিচ্ছু না। মান-সম্মান বলে একটা ব্যাপার আছে।

তার চোখে এমনই সানগ্লাস, কোনো ফাঁক-ফোকর নাই। পুরো চোখ চারদিক দিয়ে ঘিরে রাখা। সে কোনদিকে তাকাচ্ছে, ঠিক বুঝতে পারছি না। ভয়ানক পরিস্থিতি। তাই আমি এদিক-ওদিক না তাকিয়ে, পুরো কনসেনট্রেশান দিলাম সুতোয়। তা না হলে গালি খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা।

কিংবা এমনও হতে পারে সে আসলে ঘুমাচ্ছে?

ঘন্টাখানেক পর সে আমার ঘাড়ে টোকা দিয়ে, দুশো গজ দূরের পাবলিক টয়লেট নির্দেশ করে উঠে গেল। তার অর্থ সে জরুরী প্রয়োজনে বাথরুমে যাচ্ছে, আমি যেন খেয়াল রাখি।

সে পাক্কা বিশ মিনিট পর আসলো। এতোক্ষণ কোথায় ছিল, কী করলো খোদা মালুম। ফিরে এসেই আগে তার ছিপটা পর্যবেক্ষণ করে সুতো গুটিয়ে দেখে বড়শিতে টপ নেই। তারপর আমার দিকে খানিক্ষন সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে থাকলো। এমন ভাব করলো যে মাছই তার টোপ খেয়ে পালিয়ে গেছে; অথচ আমি টান দেইনি।

আমার ধারনা সে টোপ ভালো করে বড়শিতে আটকাতে পারেনি, তাই টোপ এমনিতেই খুলে পড়ে গেছে।

এবার আমার বাথরুম পেয়ে গেল। আমিও একই স্টাইলে তাকে টোকা দিয়ে পাবলিক বাথরুমে গেলাম; খুব দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে। কারণ মাছ টোপে ঠোকর মারলেও সে তুলবে কিনা আমার সন্দেহ।

যে হিংসুটে!

ঠিক দুই ঘন্টা পর তার মোবাইলে খুব আস্তে করে অ্যালার্ম বেজে উঠলো। তারমানে পনেরো মিনিটের বিরতি। সে গম্ভীর মুখে কিছু না বলে উঠে গিয়ে দূরে ঝোপের আড়ালে বিড়ি ফুঁকে আসলো। আমি ফ্লাস্ক থেকে গরম চা ঢেলে, একটা হটডগ আর সিঙ্গারা তার হাতে দিলাম।

আমরা মাছ ধরা শেষ করলাম বিকাল চারটায়। দিন ছোট; সন্ধ্যা হয়ে আসছে। তার মোবাইলে অ্যালার্ম বেজে উঠতেই ছিপ বড়শি গুটিয়ে বাক্সে তুলতে লাগলাম। সে একটা কথা সবসময়ই বলে- মাছ পাওয়ার থেকে না পাওয়াই ভালো; একটা অবলা প্রাণীকে ঠকিয়ে মুখে বড়শি বিঁধিয়ে টেনে-হিঁচড়ে তোলা নাকি খুব অমাছবিক।

সে আর চাইনিজটা মিলে আমার মাথায় পঞ্চাশ কেজির বাক্সটা তুলে দিলো। আমি এক হাত দিয়ে বাক্স ধরে আরেক হাতে দুইটা ছয় কেজি ওজনের (দুটা মোট বারো কেজি) কার্প ঝুলিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে আধা কিলোমিটার দূরে গাড়ির দিকে রওনা দেই। এবারও তার কানে মোবাইল ধরা আর আরেক হাতে দুটা বড়শি।

সামনে অনেক কাজ।

সন্ধ্যায় তার বাসায় পৌঁছেই মাছ দুটো সাইজ করবো। চিশতী একদমই মাছ সাফ করতে পারে না। তার কাছে নাকি মাছ সাফ করা দুনিয়ার সবচাইতে কষ্টের কাজ। আর টাটকা মাছ ছাড়া তার রুচিও হয় না। একটা মাছের আঁশ তুলে, নাড়িভুঁড়ি সাফ করে আমের বিচির মতো সাবধানে দুই ফালি করে মশলা মাখিয়ে বার্বিকিউ করবো জ্বলন্ত কয়লার উপর। ঘিয়ে ভাজা নান আর হোয়াইট সস দিয়ে খাবো। তার পাড়ায় তিন প্রতিবেশীকে দিয়েও আসবো। আর আরেকটা মাছ সাফ করে অটোয়া নিয়ে যাবো।

মাছ দুটো সে চাইনিজটার কাছ থেকে আশি ডলার দিয়ে কিনেছে।

এটা আমাদের খুব সিক্রেট ব্যাপার!

 

অটোয়া, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles