8.9 C
Toronto
রবিবার, এপ্রিল ২০, ২০২৫

“আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী”

“আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী” - the Bengali Times
আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী

খুব চমতকার এক শহরের খুব মন খারাপ করানো এক গল্প। এমস্টারডাম, নেদারল্যান্ডস- টিউলিপ ফুল, হেনিক্যান বিয়ার এবং আলু ভাজির জন্য বিখ্যাত এক শহর। আরও বিখ্যাত এর লাল বাতি এলাকার জন্য। যদিও সমস্ত রাত হাঁটার পরেও সৌন্দর্য্য ছাড়া দুষ্টু কিছু চোখে পড়ে নি। এমস্টারডামে দেখেছি বহু কিছু। কেটেছে চমতকার কিছু সময় তবে এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল আমার আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ী দর্শন।

প্রায় দুই মাস আগে থেকে পরিকল্পনা আনা ফ্রাঙ্কের বাড়ীতে যে জাদুঘর তৈরী হয়েছে তা দেখব। স্বল্পসংখ্যক টিকেট দুই মাস আগে থেকে না কিনে রাখলে ফুরিয়ে যায়।

- Advertisement -

আসো, আনা ফ্রাঙ্কের ব্যাপারে কিছু জানি। এই জ্ঞানের বেশিরভাগই নানা ধরনের বই এবং অন্তর্জাল থেকে ধার করা। কিছুটা আমার পন্ডিত ভাই রানাটির কাছ থেকেও জানা।

“আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী” - the Bengali Times

ঠিক তেরো বছর বয়সের এক সদ্য কিশোরী। ডায়েরি লেখার শুরু সেই বয়সেই। দিনে দিনে কেটে গেছে দুই বছর দুই মাস। পনেরো বছর দুই মাস বয়স পর্যন্ত লিখতে পেরেছিল সেই কিশোরী। ডায়েরির পাতায় শেষ আঁচড় টানার ঠিক সাত মাস পরে এই পৃথিবীর জল-মাটি হাওয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল তার। ফ্যাসিস্ট নাৎসীদের নির্মমতার সাক্ষর হিসেবে এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যেতে হয়েছিল তাকে। চলে গেছে সে কিন্তু রেখে গেছে তার কালজয়ী অমর দিনলিপি। এ হলো সেই কিশোরীর সেই ডায়েরি, দুই বছর দুই মাসের দিনলিপি–আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি।

তার বাবার নাম ছিল অটো ফ্রাঙ্ক, মায়ের নাম এডিথ। মূলত জার্মানির বাসিন্দা তারা, ধর্মে ইহুদি। অটো-এডিথের প্রথম সন্তান মারগট, জন্ম তার ১৯২৬ সালে। দ্বিতীয় সন্তান। আনা–আনা ফ্রাঙ্ক, জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ জুন।

এইসময় জার্মানির মাটিতে মাথা তুলে হুংকার ছাড়ছে হিটলার। চারদিকে বিভৎস। অত্যাচার আর ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে শুরু করেছে তার নাৎসি বাহিনী। এ যেন সরাসরি ইহুদিদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। অনেক ইহুদিই জার্মানির পাট চুকিয়ে চলে যাচ্ছে অন্য কোনও দেশে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ১৯৩৩ সালে দেশ ছাড়লেন অটো ফ্রাঙ্কও। চলে গেলেন হল্যাণ্ডে। আনা ফ্রাঙ্ক তখন চার বছরের শিশু।

এর ঠিক ছয়বছর পর শুরু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পৃথিবী দখলের দুর্বার স্বপ্ন দেখছে নাৎসী হিটলার। জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনকে, কারণ তিনি ইহুদি। এদিকে হল্যাণ্ডের আলো-হাওয়ায় বড় হচ্ছে আনা ফ্রাঙ্ক।

“আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী” - the Bengali Times

কিন্তু ফ্রাঙ্ক পরিবারের হল্যাণ্ডের আশ্রয়ও নিরাপদ রইল না। হিটলারের নাৎসিবাহিনী হল্যাণ্ড দখল করল। শুরু হল ইহুদিদের ওপর অত্যাচার। অসংখ্য ইহুদিকে পাঠানো হল বন্দীশিবিরে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে সরাসরি শমন এল অটো ফ্রাঙ্কের নামে। আসলে। সেই শমন ছিল তার বড় মেয়ে মারগটের নামে। মারগট তখন ষোড়শী সুন্দরী। নাৎসী বাহিনীর কয়েকজন অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তার রূপ-সৌন্দর্য। তাকে হাতছানি। দিল বন্দীশিবির। কিন্তু সে-ডাকে সাড়া দিলেন না অটো ফ্রাঙ্ক। সমস্ত পরিবার সহ নিলেন এক চরম ঝুঁকি। নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পেছনদিকে এক গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন সপরিবারে। সঙ্গে রইল আরও একটি পরিবার। এই সময় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তাঁর অতি কাছের কয়েকজন ইংরেজ বন্ধু। আনা ফ্রাঙ্কের বয়স তখন সবেমাত্র তেরো বছর এক মাস। কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ককে বরণ করে নিতে হলো ঘুপচি ঘরের নিরাপদ আশ্রয়। রাতের বেলা যেখানে ৰাতি জ্বালানো নিষেধ ছিল। দিনের বেলায় কোন জানালা খোলার উপায় ছিল না। সে এক অপরিসীম সহ্যাতীত সময়।

এইসময় কলম উঠে এলো সদ্য কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের হাতে। নিজের মনের কথা, সেই সময়ের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ হতে শুরু করলো কাগজের পাতায় পাতায়। অনেক কষ্ট, অনেক ত্যাগ আর সেই সময়ের কষ্টার্জিত জীবন-যাপন প্রণালীর দিনলিপি একের পর এক লিখে চললো কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক।

“আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী” - the Bengali Times

এরপর পেরিয়ে গেল একে একে পঁচিশটা মাস। চারদিকে চলছে হিটলারের নাৎসীবাহিনীর অত্যাচার। সেই অত্যাচারের খবরে কেঁপে কেঁপে উঠছে গোপন আস্তানায় লুকিয়ে থাকা ফ্রাঙ্ক পরিবার। কখনও ভয়ে আতংকে কাতর হয়ে নিশ্রুপ–আসলে এছাড়া তো তাদের আর করার কিছুই নেই। কারণ বাইরে বের হলেই নাৎসী বাহিনীর হাতে পড়ার সম্ভাবনা। আর তারপর আতংকময় সেই বন্দীশিবির। যেখান থেকে ফিরে আসার কোন সম্ভাবনা নেই। এভাবেই হয়তো পেরিয়ে যেত দিন। আতংক আর বিভীষিকাময় দিন রাতগুলো হয়তো যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত পার করতে পারতো ফ্রাঙ্ক পরিবার–সেই ঘুপচি ঘরগুলোর মধ্যে বাস করে। কিন্তু সেটাও হলো না। গোপন আস্তানায় আশ্রয় নেবার পঁচিশ মাস পর, ১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট, সেখানে হানা দিয়েছিল নাৎসিবাহিনী, আটজন ইহুদি মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বন্দীশিবিরে। জার্মানির আউশভিৎস বন্দীশিবিরে ১৯৪৫ সালের ৬ জানুয়ারি মারা যান আনার মা। মারগট আর আনাকে পাঠানো হয় আরও দূরবর্তী বেরজেন-বেসেন বন্দীশিবিরে। ১৯৪৫-এর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে অথবা মার্চের শুরুতে সেখানেই মারা যায় মারগট। আর মার্চ মাসেই, ওই বন্দীশিবিরেই, শেষবারের মতো চোখ বুজেছিল পনেরো বছর নয় মাসের সেই কিশোরী আনা ফ্রাঙ্ক।

বন্দীশিবির থেকে ফিরতে পারেননি অন্য পরিবারের তিনজন সদস্য এবং দাঁতের ডাক্তার ডুসেল-ও। মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ফিরে এসেছিলেন শুধু একজন। তিনি ছিলেন মারগট আর আনা-র বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। আর তখনই তাদের দুই শুভার্থী–এলি আর মিপ, তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন লাল ডোরাকাটা মলাটের একটা ডায়েরি এবং আরও কিছু কাগজ–এগুলো ছিল আনার লেখা। আনার দিনলিপি। আনার গল্প-উপন্যাস-স্মৃতিকথা।

তারপর প্রকাশিত হয়েছিল সেই দিনলিপি–আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’ নামে। প্রকাশিত হবার পরই শুরু হলো আসল ইতিহাস। সারা পৃথিবী যেন চমকে গেল একজন সদ্য কিশোরীর কলমের আঁচড়ে। পরবর্তীতে এই সদ্যকিশোরীর দিনলিপি অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ভাষায়, তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র, মঞ্চস্থ হয়েছে নাটক।

“আনা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ী” - the Bengali Times

এক আশ্চর্য অনুভূতি তৈরি হয় পাঠকের মধ্যে এই ডায়েরি পড়তে গিয়ে। কখন যেন এতে খুঁজে পাওয়া যায় একজন কিশোরী আনাকে; পরক্ষণেই পাঠককে বিস্মিত করে সামনে। এসে দাঁড়াবে আশ্চর্য গভীর আনা ফ্রাঙ্ক। সেই সময়ের বিভীষিকাময় দৈনন্দিন ঘটনার বর্ননার পাশাপাশি তেরো থেকে পনেরোর দিকে হেঁটে-চলা কিশোরী অনায়াসে কথা বলে গেছে দর্শন, ঈশ্বর, মানবচরিত্র এমনকি প্রেম-প্রকৃতি-জীবনবোধ নিয়েও। পাশাপাশি ফুটে উঠেছে সমকালীন ইতিহাস, ইহুদিদের লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা-সংগ্রাম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি খন্ডকালীন ছবি।

সেই শুরু থেকেই লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন ছিল আনা ফ্রাঙ্কের। তার স্বপ্ন ছিল এমন কিছু করার যাতে সে মৃত্যুর পরেও বেঁচে থাকতে পারবে–সাধারণ মানুষের অন্তর জুড়ে। কিন্তু তা হলো না। যে ফুল ফুটলে চারদিক ভরে যেতে পারতো অন্তহীন সুবাসে–সেই ফুলের ফোঁটা হলো না। ঝরে যেতে হয়েছে তাকে কুঁড়িতেই।

কিন্তু বেঁচে আছে তার সেই অমর দিনলিপি। বাঁচিয়ে রেখেছে তাকে বিশ্বজুড়ে পাঠকের অন্তরে। বেঁচে থাকবে আনা ফ্রাঙ্ক, বেঁচে থাকবে তার ডায়েরি।

তখন আমি অন্তত সাতবারের মত সদ্য পড়ে শেষ করেছি “আনা ফ্রাঙ্কের ডায়রী”। এরপরে দেখতে গেলাম সেই বাড়ী। প্রতিটা ইটের পরতে পরতে ডায়রীর শব্দগুলোকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখলাম চোখের সামনে। আবেগে অনুভূতির আশ্চর্য্য সমন্বয়ে বোধ করলাম বুকের মধ্যে। মন বিষাদাক্রান্ত হল।

বাড়ীটির মধ্যে ছবি তোলা নিষেধ। তাই কেবল বাহিরের ছবি তুলতে পেরেছি। বাড়ীর পেছনের দিকে রয়েছে আনা ফ্রাঙ্কের একটু মূর্তি। বহু মানুষ এসে দিয়ে গেছে তাজা ফুল মূর্তিটির পায়ের কাছে। আমি কাছে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম পাথর কুদে তৈরী করা ঠান্ডা মূর্তিটিকে। বুকের মাঝে আবারও টের পেলাম সেই আবেগ।

এবার বুঝলাম কেন সমস্ত পৃথিবীর মানুষ কেঁদে বুক ভাসালো তের বছর বয়সী এক পুঁচকে মেয়ের লেখা ডায়রী পড়ে! এমস্টারডামের সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি হল এই জাদুঘর দর্শন। এই শহর নিয়ে আমি আরও লিখব। তবে আনা ফ্রাঙ্কের সাথে অন্য আর কিছু মিলিয়ে ফেলতে চাচ্ছি না।

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles