
জামান সাহেব ছেলে গুলোর কথার বিপরীতে, যে কোন পদক্ষেপ নেয়ার মতো অবস্থা তার যথেষ্ট আছে। কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। এই বিষয়ে নিজের ক্ষমতা জাহির করার কোন প্রয়োজন মনে করলেন না।
তার অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব আমাকে তার দিকে চুম্বকের মতো টানছে।
খুব সাধারণ একটা ক্যাফেতে বসলাম। জামান সাহেব প্রথম মুখ খুললেন।
– পাতা তোমাকে দেখতে একটা লাল ডানার প্রজাতির মতো লাগছে। তোমার ড্রেস সেন্স বরাবর-ই আমাকে মুগ্ধ করে।
– ধন্যবাদ, আপনার টাইয়ের কালেকশন ও অসাধারণ।
– পাতা তুমি কি জানো,তোমার অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব, কত টা সুন্দর করে তুলেছে আমার কাছে।
এর উত্তর কি দেবো আসলে বুঝতে পারছিলাম না। তাই এক চিলতে হাসলাম। এরপর কাচের দরজার বাহিরে যতটুকু আকাশ দেখা যায় তাকিয়ে রইলাম।
– স্যার, জানেন তো যে বসন্ত জীবন রাঙাতে পারে না তা দমকা হাওয়া। আমার জীবনে টা একটা দমকা হাওয়া এসেছিল, এলোমেলো করে দিয়ে গেছে৷ ভাগ্য ভালো টাল সামলে উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলাম। না,হয় গুঁড়িয়ে দিয়ে যেতো হয়তো।
– পাতা,বসন্ত জীবনে একবার নয় বার বার আসে। হয়তো সব বসন্তে জীবন রঙিন হয় না,তবে বসন্ত আসে তার নিজের নিয়মে।
আমি তোমার জীবনে বসন্ত হয়ে নয়,ষড়ঋতু হয়ে আসতে চাই। কখনো মেঘ হয়ে এক পশলা বৃষ্টি নামবে,রংধনু উঠবে,শিউলি ফুটবে।
– স্যার আপনি জ্ঞানী মানুষ। জীবনবোধ আপনার বেশি। আমি-ই হয়তো ভুল। এক বসন্তে জীবন যায় না এখানে ষড়ঋতুর বড্ড প্রয়োজন। আমি ষড়ঋতু কে আমার জীবনের ঋতু রাজ করে রাখার চেষ্টা করবো।
জামান সাহেব মুগ্ধ চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে আছে৷
– এই মেয়ে, অবেলায় কেনো এলে তুমি। এতো দেরি করার কি খুব প্রয়োজন ছিল? কেন তোমায় পেতে এতো দেরি হল? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারছি না পাতা। তোমার আমার বয়সের দূরত্ব অনেক। তুমি সব মেনে নিয়ে, আমার সাথে বাঁচতে পারবে বলো?
– দূরত্ব কিছু নয় ঋতুরাজ। আপনি আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন জীবন, আমি ও আপনার কাছে তাই। আমরা আবার নতুন করে বাঁচবো। এক সাথে ছেড়ে যাবো না কখনো।
কফি টা শেষ করে চলেন বাহিরে হাত ধরে একটু হাঁটি।
– কেমন লাগবে বলো? মানুষ তাকিয়ে থাকবে খুব বাজে অবস্থা।
– প্রেমিকদের এতো ভীতু হতে নেই,ঋতুরাজ। আপনার হাত টা দিন দেখেন আপনাকে নিয়ে কত রংঢং করে বাঁচি।
জামান সাহেবের হাত ধরে বের হয়ে গেলাম। তাকে অনেক প্রশ্ন করার ছিল, অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ছিল। এসব কিছু- ভালোলাগছে না।
মানুষটার হাত ধরে হাঁটতে অদ্ভুত রকম ভালোলাগছে। একটা সময় চারপাশ শূণ্য মনে হতো,বুকের কোথায় জানি খালি খালি লাগতো।
একটা বিশেষ মানুষের উপস্থিতি হৃদয়ের কোথায় জানি একটা শিহরণ শিহরণ টোকা দিয়ে যায়।
জামান সাহেব শক্ত করে আমার হাত ধরে হাঁটছেন।
জিজ্ঞেস করলাম-
– আমাকে বলে দেশের বাহিরে জাননি কেন? আপনার শরীর ঠিক আছে কি? হাঁটতে অসুবিধা মনেহচ্ছে কি?
– আমার প্রতি তোমার টান টা জানতে ইচ্ছে করছিল। সম্পর্কহীন দুটো মানুষ যদি কেউ কারো জন্য টান অনুভব করে, এটা ভালোবাসার শুদ্ধতম প্রকাশ।
তুমি আমাকে ভালোবাস,হয়তো বুঝতে পারছ না। আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার সাথে হাঁটতে আমার ভালোই লাগছে। জানো তো একটা সময় হিয়া-দিয়ার মা’য়ের সাথে কত হেঁটেছি। অবশ্য তার পেছনে পেছনে ও অনেক ঘুরেছি।
স্কুল কলেজে যাওয়ার পথে ফলো করতাম। এখনকার মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফলো না কিন্তু। রিয়েল লাইফ ফলোয়ার,হা,হা,হা। হিয়া-দিয়া আমার দুই মেয়ে। দেশের বাহিরে আছে মাঝে মধ্যে খোঁজ নেয়। কান্না করে,আমার জন্য তাদের হৃদয় পুড়ে যায়।
– আপা কে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন?
– হ্যা, পাত্তা দিত না প্রথম দিকে। পরে আস্তে আস্তে পাত্তা দিল। আমি ছিলাম স্বল্প আয়ের মানুষ। এরপর দিন বদলাতে লাগলো। তেরো বছর হলো ফারজানা মারা গেছে।
ভালোবেসে হৃদয়ে ছবি নিয়ে একটা জীবন পার করে দেয়া মৃত্যুর যন্ত্রণার চেয়ে কম কি।
কত বার সুইসাইড এর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
– আপা তো চলে গেছেন আল্লাহর সিদ্ধান্তে। তাঁর সিদ্ধান্তের উর্ধ্বে গিয়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নেয়া অন্যায়। নিজের প্রতি নিজের অন্যায়। নিজেকে ভালো রাখা অবশ্যই খারপ কিছু না,আপনার জন্য আরেক টা মানুষ ভালো থাকলে এটা অত্যন্ত ভালো কাজ।
ভালোবাসা একটা বাতির আগুনের মতো,যতো বাতি জ্বলবে ততোই উজ্জ্বল হবে চারপাশ।
– পাতা তোমাকে বিয়ে করতে চাই। আমার পাশে একটা মানুষ অনুভব করি। টিন এজ ছেলে-মেয়েরা যে বলে, ‘তোমাকে ছাড়র বাঁচবো না।’ আসলেই বাঁচতে পারা যায় না। তাদের জায়গায় দাঁড়ালে বুঝতে পারা যায় কত টা যন্ত্রণা হয়।
– ঋতুরাজ,এই বিষয়ে হিয়া মা, দিয়া মায়ের সাথে কথা হয়েছে আপনার?
জামান সাহেবে চোখ-মুখ চকচক করছে-
– পাতা তোমার কাছে রুপের ঘনঘটা নেই, তোমার যে সৌন্দর্য আছে তাতে তথাকথিত রুপ কদাকার হয়ে যাব।
– আমি ঠিক বুঝতে পারছি না,আপনার কথা।
– আমি যা দেখেছি তোমার মাঝে,তা আর কোথাও কখনো পাইনি। হিয়া-দিয়ার কথা বলছো,কোন সন্তান তার পিতা-মাতার দ্বিতীয় বারের বিয়ে মেনে নিতে পারে না। তারা যতই উন্নত দেশে থাকুক না কেন। তবুও আমি
আমি তাদের সাথে কথা বলবো।
– যদি মেনে না নেয়?
– শোন পাতা বিরহের মতো যন্ত্রণা বহন করা কোন জীবিত মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এক নারী তে আসক্ত পুরুষ মহাপুরুষ এক পুরুষে আসক্ত নারী মহারাণী এগুলো দিয়ে জীবন চলে না।
এই মহাপুরুষ আর মহারাণী যে ভিতরে ভিতরে মৃত কিংবা প্রতিদিন হেরে যাচ্ছে জীবনের কাছে। এই খবর কেউ রাখে না। হেরে গিয়ে মৃত্যুর কাছাকাছি হাঁটে দিনের পর দিন সেই হিসাব রাখার জন্য কেউ ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে না। তেরো বছর আমি সঙ্গী ছাড়া। ভরা সংসার টা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেছে। যার যায় সে বুঝে তার ভিতরে কত টা শূণ্যতা।
– ঋতুরাজ, আপনি হয়তো ঠিক বলছেন। একটা সময় ভেবেছি জীবন টা এভাবে-ই পার করে দিব। দিনের পর দিন মরে গেছি, হেরে গেছি জীবনের কাছে। যন্ত্রণার ভাগ কেউ নেয়নি।
– পাতা,বুক পকেটে বিরহ নিয়ে মন্ত্র মুগ্ধ কবিতা লিখে হাততালি কুড়ানো গেলে ও বাস্তব জীবনে বিরহের মতো যন্ত্রণা আর কিছুতে নেই।
আমরা তো কোন অন্যায় করছি না। নিজেদের ভালো রাখতে চাইছি।