11.8 C
Toronto
শনিবার, মার্চ ১৫, ২০২৫

সেদিন যেভাবে পতন হয়েছিল এরশাদের

সেদিন যেভাবে পতন হয়েছিল এরশাদের
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ

আজ ৬ ডিসেম্বর, রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ১৯৯০ সালের এই দিনে সামরিক স্বৈরাচারী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের মুখে তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন।

এরশাদের এই ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে যে রক্তাক্ত সংগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল তার পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রযাত্রা। সেই থেকে দিনটিকে আওয়ামী লীগ ‘গণতন্ত্র মুক্তি দিবস’, বিএনপি ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে পালন করে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এই দিনকে ‘স্বৈরাচার পতন দিবস’ হিসেবেও পালন করে থাকে। তবে এরশাদের জাতীয় পার্টি দিনটিকে ‘সংবিধান সংরক্ষণ দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।

- Advertisement -

গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হলেও প্রায় তিনদশক ধরে রাজনীতিতে কিভাবে টিকে ছিলেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

কাদির কল্লোলের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে এক জরুরি বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদ যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন, সে প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে আলোচনা করা।

জেনারেল এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এর কয়েকদিন আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

সেনানিবাসের ভেতরে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে দেশের চলমান সংকট একটি রাজনৈতিক বিষয় এবং এ সংকট সমাধানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা আরও সিদ্ধান্ত নিলেন যে চলমান রাজনৈতিক সংকটে সেনাবাহিনীর করণীয় কিছু নেই।

এমন অবস্থায় প্রেসিডেন্ট এরশাদ সেনা সদরকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে দেশে সামরিক আইন জারি করা হবে।

এরপর ৩ ডিসেম্বর তখনকার সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নূর উদ্দিন প্রেসিডেন্ট এরশাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেনা কর্মকর্তারা চেয়েছিলেন, সেনাপ্রধান যেন প্রেসিডেন্ট এরশাদকে পদত্যাগের জন্য সরাসরি বলেন।

অবশ্য সেনাপ্রধান প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি পদত্যাগের কথা না বললেও তিনি জানিয়ে দেন, দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেনা অফিসাররা কোনো দায়িত্ব নিতে রাজি হচ্ছে না। তখন ঢাকা সেনানিবাসে ব্রিগেডিয়ার পদে কর্মরত ছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী, যিনি পরবর্তীতে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। ২০১০ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “উনি (সেনাপ্রধান) প্রেসিডেন্টকে বলেছিলেন- আপনার উচিত হবে বিষয়টির দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান করা। অথবা বিকল্প কোনো ব্যবস্থা নেওয়া।”

জেনারেল এরশাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক শাসন জারির বিষয়ে সেনাবাহিনী একমত নয় বলে প্রেসিডেন্টকে পরিষ্কার জানিয়েছিলেন তখনকার সেনাপ্রধান।

প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক নিয়ে তখন দেশজুড়ে নানা গুঞ্জন। একদিকে সেনানিবাসের ভেতরে নানা তৎপরতা অন্যদিকে রাস্তায় এরশাদ বিরোধী বিক্ষোভ। সব মিলিয়ে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল।

বিবিসির এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ৪ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল আবদুস সালাম প্রেসিডেন্ট এরশাদকে সরাসরি বলেন যে, তার পদত্যাগ করা উচিত।

“পদত্যাগের কথাটা জেনারেল সালামই প্রথম সরাসরি বলেন। অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে। আর্মি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছে” বলছিলেন আমিন আহমেদ চৌধুরী।

জরুরি অবস্থা এবং কারফিউর মতো কঠোর পদক্ষেপের মাধ্যমেও যখন গণ-আন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না, তখন সেনাবাহিনীর দিক থেকে নেতিবাচক মনোভাব দেখলেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ। এ অবস্থায় ৪ ডিসেম্বর রাতেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন জেনারেল এরশাদ।

তখন এরশাদ সরকারের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ছিলেন বর্তমানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য প্রয়াত মওদুদ আহমেদ। তিনি জানান, সেনাবাহিনীর মনোভাব বোঝার পরেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেননি এরশাদ।

সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন মোকাবেলার জন্য তিনি সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক জোটগুলো এরশাদের সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

‘পল্লী নিবাসে’ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন এরশাদ‘পল্লী নিবাসে’ চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন এরশাদ
এরশাদ ৪ ডিসেম্বর তখনকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে টেলিভিশনে পাঠিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্টের পরিকল্পিত নির্বাচন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরা।

এরশাদের নির্দেশ মতো ভাইস-প্রেসিডেন্ট মওদুদ আহমদ সন্ধ্যার সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে গিয়েছিলেন ভাষণ রেকর্ড করার জন্য। সে ভাষণ তিনি রেকর্ডও করেছিলেন। সে ভাষণ রেকর্ড করার পর মওদুদ আহমদ যখন বাসায় ফিরে আসেন, তখন তিনি জানতে পারেন প্রেসিডেন্ট পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

কয়েক ঘণ্টা পর মধ্যরাতে মওদুদ আহমদকে আবারও বাংলাদেশ টেলিভিশনে যেতে হয়েছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার জন্য।

ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পর্কে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘৫ তারিখে বিরোধী দল থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব আসলো যে প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন সাহেব উপ-রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে তারপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাজ করবেন তিনি এবং তার অধীনেই একটি নির্দলীয় সরকার হবে।

তিনি বলেন, ‘৬ তারিখ বিকেল তিনটায় আমি রিজাইন করলাম। আমি রিজাইন করার পরে সাহাবুদ্দিন সাহেবকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট অ্যাপয়েন্ট করলেন প্রেসিডেন্ট সাহেব। তারপর প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজে রিজাইন করলেন এবং তারপর সাহাবুদ্দিন সাহেব ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু করলেন।’

জেনারেল এরশাদ যখন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন রাস্তায় মানুষের যে ঢল নেমেছিল সেটি ৬ ডিসেম্বর অস্থায়ী সরকারের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত বজায় ছিল।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles