-5 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

মাদার অব অল স্লোগান

মাদার অব অল স্লোগান
মাদার অব অল স্লোগান

দীর্ঘদিন থেকে ইচ্ছা অনিচ্ছার দোলায় দোল খাচ্ছে জাতির উল্লেখযোগ্য গৌরব ও অহংকার। একসময় যা ছিল বুক ভরা গর্ব সেরকম কিছু কালের ধ্বনির সাথে নিজেকে যুক্ত করতে অনেকেই ব্যর্থ হয়েছি। অজানা কারণে অনেকে হাত গুটিয়ে বসে আছি যেন সেই গৌরব কিংবা অহংকারে আমার কিছু যায় আসে না। ভাবটা এমন, আমার ধন আমার গর্ব হারিয়ে গেলে ক্ষতি নেই, কেউ নিয়ে গেলেও দুঃখ নেই। বলছিলাম ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দুটোর কথা।

মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করা গৌরবোজ্জ্বল দুটি হীরক খণ্ডের দিকে আজ দৃষ্টি আকর্ষণ করব। অতীতে অনেক রাজনীতিবিদ আমাদের অধিকার ও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে বিখ্যাত হয়েছেন। তাই আমাদের রয়েছে অগণিত রাজনৈতিক নেতা ও পথ প্রদর্শক। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সকলের চেয়ে ভিন্নতর মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছিলেন বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, দেশ প্রেম ও মৌলিক একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাফল্য অর্জন করার মধ্যে দিয়ে। মনে রাখতে হবে স্বপ্ন অনেকেই দেখতে পারে, যতক্ষণ পর্যন্ত সেটার বাস্তবায়ন না হচ্ছে সেটা স্বপ্নই থেকে যাচ্ছে। কাজেই কৃতকর্মের সাফল্যের ভাগীদার তখন কেউ হবে না। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন বলেই পূর্ব পাকিস্তানকে সবসময় ‘বাংলাদেশ’ অথবা ‘পূর্ববঙ্গ’ নামে ডাকতেন। বাংলাদেশ নামক একটি দেশের বাস্তবতা নিয়ে তার কোন সংশয় ছিল না। এই চিন্তা ভাবনাতে তিনি অনড় ছিলেন এবং তার বিশ্বাস ও সততা ছিল বলেই তিনিই পেরেছিলেন বাংলা ভাষীদের জন্য একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। তাই তার নামে হয়েছে একাধিক স্লোগান এবং তিনি পেয়েছেন জাতির পিতার সম্মান। অথচ অনেকে আজ সে কথা অস্বীকার করতে চায় অথবা তাকে জাতির পিতা হিসেবে মানতে অনীহা করে।

- Advertisement -

তিনি তার রাজনৈতিক লক্ষ্য ও সম্ভাবনাময় প্রাপ্তি এই দুটো জিনিস জাতির কাছে পরিষ্কার করে উত্থাপন করতে পেরেছিলেন বলেই সমগ্র জাতি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাংলার কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-জনতা, শিল্পী-সাহিত্যিক, সরকারী কর্মচারী-কর্মকর্তা, সেনাবাহিনী, গৃহিণী ব্যবসায়ী, মা-বোন সকলেই তার ঐক্যের ডাকে সাড়া দিয়েছিল। এমন একতা আজ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি। এমন ভাবে বৃহত্তর ছাতা জাতির মাথার ওপর আর কেউ ধরতে পারেনি। তার আগে কেউ দূরদূরান্ত সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে কথার রাজ্য ছড়িয়ে দিতে পারেনি। একক ব্যক্তিত্ব হিসেবে একমাত্র তাকেই আমরা পেয়েছি যার নির্দেশের জন্য মানুষ অপেক্ষা করেছে দেশে বিদেশে। এ কথার সত্যতা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মিছিল, মিটিং পত্রিকার পাতা খুঁজলে পাওয়া যাবে। এমনকি তার কথা গেঁথে আছে স্লোগানে স্লোগানে। যেমন, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো। তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব। মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব, জয় বঙ্গবন্ধু ইত্যাদি।

১৯৬৯ -৭১ সময়কালে পথে নেমে এলেই শোনা যেত এমন কিছু স্লোগান যা বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত করে রেখেছিল। যেসমস্ত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঠন করা হয়েছে যেমন, জাসদ, বাসদ, বিএনপি, বিকল্প ধারা, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি, তারা দলীয়ভাবে এই সমস্ত স্লোগানের সাথে জন্মলগ্ন থেকে জড়িত হতে পারেনি। কেননা, দল হিসাবে তখন তাদের অবস্থান ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলেই কিছু কিছু নেতা আছেন যারা বিনা দ্বিধায় এইসব স্লোগান এক সময় কণ্ঠে ধারণ করে নিয়েছিলেন। তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এই সমস্ত স্লোগানে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের মধ্যে স্বাধীনতার স্বচ্ছ ধারণা লুকিয়ে আছে। যদিও সামান্য কিছু লোক বা রাজনৈতিক দল অখণ্ড পাকিস্তানে বিশ্বাস করতো বলেই পাকিস্তান রক্ষার স্লোগান দিত। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ এই সমস্ত শব্দ উচ্চারণে তাদের আপত্তি ছিল। তখনো যেমন এখনো তেমন। ওরা জিন্দাবাদে বিশ্বাসী।

‘জয় বাংলা’ স্লোগানটির বাঙালির ঐতিহ্যের সাথে কতটা মিশে আছে তা বলে শেষ করা যাবে না। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। কোন কিছু উচ্চারণ করে সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে কণ্ঠকেও সেই মাত্রায় উচ্চতায় নিয়ে যেতে হয়। যেমন একটি মিনারের কথা কিংবা পিরামিডের কথা ভাবুন। গোঁড়াটা কত মজবুত এবং প্রশস্ত। অথচ উচ্চতায় গিয়ে সেটা চিকন একটা ফালি। তেমনি দূরের কাউকে ডাকলে যেভাবে ডাক শুরু করি তার শেষটা কিন্তু সেভাবে থাকে না। মিনারের সেই প্রস্থ ও উচ্চতার মতই শেষে গিয়ে চিকন বা চূড়ায় উঠে যায়। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনে যতগুলো স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ঠিক তেমনি একটি অবস্থানে রয়েছে। যেন দূরের কাউকে বা পুরো জাতিকে একটা জায়গা থেকে ডাক দেয়া হচ্ছে। সেই জন্য ‘জয়’ শব্দটা টেনে টেনে উচ্চতায় নিয়ে গিয়ে শেষে ‘বাংলা’ শব্দটাকে মিনারে গম্বুজ করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। যেটা অনেকটা এরকম। জয়য়য়য়য়য়য়য়য়…. বাংলা। এই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে বাদ দিলে অন্যসব স্লোগান বাংলার সমতল ভূমির মতো বয়ে চলা, কিংবা আগুনের ফুলকির মতো ধেয়ে চলা। তাই ভিন্নতা ও মর্যাদার কারণে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথাকে স্বীকার করে নিতে হলে ‘জয় বাংলা’-কেও ধরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, যে সমস্ত ঘটনা অতীতে ছাপ ফেলে গেছে সেটাই ইতিহাস, সেখানেই গর্ব। আর তার ভাগীদার জাতির সকলে।

বাঙালিদের স্বাধীকার আন্দোলনের চুম্বক পর্বে ছাত্র সমাজ ও রাজনৈতিক নেতাদের বিচক্ষণ উপলব্ধি ও সিদ্ধান্তে ‘জয় বাংলা’ সাধারণ স্লোগান থেকে অসাধারণ রূপ ধারণ করে। বলা যেতে পারে মাদার অব অল স্লোগান এই ‘জয় বাংলা’। ধারণা করা হয়, কাজি নজরুল ইসলামের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায় উল্লেখিত ‘জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র’ অংশ থাকে কিংবা গুরু সদয় দত্তের লেখা ও ‘ব্রতচারী সমিতি’ দ্বারা ব্যবহৃত স্লোগান ‘জয় সোনার বাংলা’ থেকে ‘জয় বাংলা’র উৎপত্তি হতে পারে। কথা হলো, যে স্লোগান আমাদের যুদ্ধ জয় এনে দিয়েছিল এখন সেই স্লোগানকে বাঁচাতে নতুন স্লোগান দেবার প্রয়োজন কেন হলো?

যুদ্ধের সময় গুলি ছোঁড়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ বলে একটা চিৎকার করতো। কোন ব্রিজ উড়িয়ে দিতে সক্ষম হলে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ করে বিজয়ের স্বাদ নিত। স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রেরণা যোগাতে ‘জয় বাংলা’ নামে পত্রিকা, সিনেমা, গান, দল সবই বানানো হয়েছিল। ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ দেশাত্মবোধক গানটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর সৃষ্টি। ভারতের লোকেরা যুদ্ধের নয় মাস আমাদের ‘জয় বাংলা’র লোক বলে ডাকতো। মানে পুরো দেশ কিংবা জাতির নাম একটা স্লোগান দিয়ে বলা হতো।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসীদের কর্মকাণ্ডেও ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ছিল ঐক্যের প্রতীক। অথচ সেই স্লোগান এখন বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল উচ্চারণ করে না, এক মাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া। ভারতের লোকেরা যখন আমাদের ‘জয় বাংলা’র লোক বলে ডাকত তখন কিন্তু আমাদেরকে আওয়ামী লীগের লোক বলে ভাবত না। অথচ এখন ‘জয় বাংলা’ বললে নিজ দেশে আমরা চিহ্নিত হয়ে যাই আওয়ামী লীগ দলের সদস্য হিসেবে। তেমনি ভাবেই জাতির পিতা হয়েও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ এখন একটি মাত্র রাজনৈতিক দলের স্লোগানে টিকে আছেন।

এখনতো নির্বাচন মওসুম। দেখবেন শুধু আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র, পোষ্টের লিফলেটেই লেখা থাকবে ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। একথা সত্য যে দেশের চাকা যখন উল্টো দিকে ঘুরছিল, আমাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পরাজিতদের পায়ের কাছে। যখন ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ উচ্চারণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, মুছে ফেলা হয়েছিল সত্য ইতিহাস। তখন রাজনৈতিক দল হিসাবে একমাত্র আওয়ামী লীগই এই স্লোগান দুটোকে আগলে রেখেছে। তবে, ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দুটিকে সমুদ্রের তলদেশ থেকে তুলে আনতে অগণিত অরাজনৈতিক ব্যক্তি, দল, সংগঠন গোপনে ও প্রকাশ্যে কাজ করে গেছে। একাজে অগ্রণীয় ভূমিকা রেখেছে নাটক গল্প কবিতা গান প্রবন্ধ উপন্যাস ইত্যাদি। সবশেষে গণজাগরণ মঞ্চ মুখে মুখে তুলে দিয়েছে স্লোগান দুটি।

অনেকে মনে করেন যেহেতু আওয়ামী লীগ তাদের দলীয় প্রচার পত্রে ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ লিখে থাকে তাই অন্য পার্টি একই রকম স্লোগান দিলে মনে হতে পারে সেই দলটি বোধ হয় আওয়ামী লীগেরই অঙ্গ সংগঠন। কথা হলো, দোষটা কার? যারা ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলা ছেড়ে দিয়েছেন তাদের নাকি যে দল এখনো বুক আগলে রক্ষা করে চলছে বিজয়ের স্লোগান?

অমুক বলে দেখে আমি বলবো না, অমুক করে দেখে আমি করবো না এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে আসতে রাজনৈতিক মহলের অনেক সময় লেগে যাবে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সবার বলে কিছু নেই। আছে আমার। তাই এক দলের কাছে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ গচ্ছিত আছে বলে অন্য কেউ তার দায় দায়িত্ব নিতে চায় না এমনটা ভাবলে খুব ভুল হবে বলে মনে করি না।

এর একটা সুরাহা হওয়া উচিত। আদালতে গিয়ে হলেও কেউ যেন এই সমস্যার একটা সমাধান করতে এগিয়ে আসেন। হয়, কোন বিশেষ রাজনৈতিক দল জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক এই দুটি স্লোগানকে তাদের দলের প্রচার কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। নয়তো জাতীয় সব রাজনৈতিক দলকে উৎসাহিত করতে হবে তারাও যেন ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দুটি ব্যবহার করতে শুরু করে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই খেলার মাঠে, জনসমাবেশে, জাতীয় উৎসবে ‘জয় বাংলা’ এবং ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দুটো পূর্ণ মর্যাদার সাথে উচ্চারিত হবে।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles