0.6 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

স্যান্ডেল পরা এক পর্বতারোহীর চাপাবাজি

স্যান্ডেল পরা এক পর্বতারোহীর চাপাবাজি
স্যান্ডেল পরা এক পর্বতারোহীর চাপাবাজি

[আমি এডমন্ড হিলারি আর শেরপা তেনজিনের মতো করে হিমালয় দেখিনি,  উঠিনি এভারেস্টে। এমন কি জন্মজেলায় গারো-পাহাড়েও যাওয়া হয়নি। তবু পর্বতারোহীদের মতো যৎসামান্য পাহাড়ি অভিজ্ঞতা আছে। আছে পাহাড় নিয়ে একাধিক কবিতা বা কবিতার অংশ, বিষয়।

শিহাব শাহরিয়ারের ‘বৈঠা’র পাহাড় সংখ্যার জন্য লেখার আগে আমার দেখা পাহাড়্গুলোর কথা ভাবলাম। যুক্তরাজ্যে, যুক্তরাষ্ট্রে এবং কানাডায় ছোটবড় পাহাড়ে উঠেছি, থেকেছি এবং ঘুরেছি। সেই তিন পর্বের একটি আজ লিখে শেষ করলাম। আগ্রহীরা পড়ে মন্তব্য করতে পারেন]

- Advertisement -

কানাডার কুইবেক তথা কেবেক সিটির বিউপ্রে শহরে স্বপরিবারে অবকাশে যাই ২০১৬-তে। শহরে ঢুকতেই যেন ঐতিহাসিক সেন্ট জিন গেট আমাদের স্বাগত জানালো।

সেন্ট লরেন্স এবং সেন্ট-চার্লস দুই নদীর মোহনায় মনোরম পরিবেশে, ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা আর পাহাড়-পর্বত মিলিয়ে একটি পুরনো শহর, মনে হলো যেন ইউরোপীয় অনুভূতি!

স্যান্ডেল পরা এক পর্বতারোহীর চাপাবাজি

এই শহরেই প্রায় হাজার মিটার উচ্চতার পাহাড় Mont-Sainte-Anne,  পর্বতটি লরেন্টিয়ান পর্বত শৃঙ্খলের একটি অংশ। এখানেই UCI মাউন্টেন বাইক বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়।

এছাড়াও শীতকালে স্নোশুয়িং, কুকুর স্লেডিং, প্যারাগ্লাইডিং, স্লেই রাইড, আইস স্কেটিং, টিউবিং, স্নোমোবিলিং, স্পা, স্নোবোর্ডিং, স্কিইং আর গ্রীষ্মকালে জাকজমক ভাবে ক্যাম্পগ্রাউন্ড, প্যারাগ্লাইডিং, হাইকিং, গল্ফ, মাউন্টেন বাইকিং-এর আসর জমে উঠে।

পর্বতটির পাদদেশে ১০০ নম্বরের কটেজটি ভাড়া করি। আমরা দুই পরিবারে ছিলাম ছয় জন। দুই মেয়ে অর্জিতা, অনাদি, অপি আর আমি, এবং স্বপন-লিটিল। নিজেরাই রান্নাবান্না করে পিকনিক-পিকনিক আনন্দঘন সময় কাটতে থাকে আমাদের।

সকালে ব্রেকফার্স্ট সেরে বেরিয়ে পড়ি ঐতিহাসিক ফরাসি আর গ্রেট ব্রিটেন রাজ্যের স্মৃতিচিহ্ন স্থলে, ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যে,  দূর্গে,  দ্বীপে, দূরে লং-ড্রাইভে, মার্কেটে, গ্রামেও। লাঞ্চ বাইরের রেস্টুরেন্টে বা খোলা আকাশের নিচে আর রাতে বাসায় এসে ডিনার, ড্রিং, ম্যারাথন আড্ডা।

এক বিকেলে আমরা আমাদের কটেজের নিচে হাটাহাটি করছি। হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের পদদেশে যাই। দেখি- ক্যাবল কার দিয়ে পর্যটক উপরে উঠছে, নামছে। হাইকিং করার জন্য ট্রেকার্সরা ব্যাগ, লাঠি, পানি, হালকা খাবার, দড়ি ইত্যাদি দরকারি জিনিস নিয়ে পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে।

স্বপন, লিটল (হুমায়ূন আহমদের যাকে অনুবাদ করে ‘ক্ষুদ্র’ বলে ডাকতেন) আর আমি টিম হর্টন্সের চা হাতে নিয়ে খেতে খেতে পাহাড়ের প্রথম ধাপ উঠলাম।  ঘুরতে ঘুরতে আরো এক ধাপ উপরে উঠি। আমাদের মাথার উপর দিয়ে তার বেয়ে ক্যাবল কার নামছে, উঠছে। পাহাড়ের স্তরে স্তরে বসার ব্যবস্থা আছে। আমরা বসে বিশ্রাম নিই। কোথাও গাছের সাথে ঝুলানো দোলনা। দোলনায় বসে দোল খাই। পাশের পথ দিয়ে দু’একজন সরু পথে উপরে যাচ্ছে, নামছে। একটু সামনে গেলেই দেখি- একটি ছোট্ট ঝরনায় জল পড়ছে। সেটা লাফ দিয়ে পাড় হওয়া যায়। মাটিকাটা সিঁড়ি বেয়ে আবার পেয়ে যাই একটি গর্ত। গর্তের উপর মরা গাছে কাঠের সেঁতু। আমরা সেটা পেরিয়ে আরো একধাপ উপরে উঠি। একটু ক্লান্ত অনুভব করি। ক্লান্তি দূর করার জন্য ঝুলে থাকা মাটির কাছাকাছি গাছের ডালে বসে বিশ্রাম নেই। অনেকটা বেঞ্চির মতো।

স্যান্ডেল পরা এক পর্বতারোহীর চাপাবাজি

এবার লিটল নিচে নামার জন্য তাড়া দিলো আর স্বপন উপরে উঠার জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করলো। তাদের দু’জনের পায়ে ক্র্যাম্পন না থাকলেও বেশ মজবুত কেটস ছিলো। আমার পরনে ঘরে পরা একটা কালো টিশার্ট, চেকচেক ট্রাওজার এবং পায়ে একজোড়া কালো পুরনো স্যান্ডেল। যা পায়ে দিয়ে পর্বতারোহী হওয়া বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ!

ইউকিপিডিয়া ভাষ্য- ‘পর্বতারোহণ একধরনের খেলা, শখ বা পেশা।… এটি ধীরে ধীরে একটি দুঃসাহসিক খেলা হিসেবে বিকাশ লাভ করে। তিন ধরনের পর্বতারোহণ রয়েছে: রক-ক্রাফট, স্নো ক্র্যাফট এবং স্কিয়িং। এগুলো নির্ভর করে পর্বতের পৃষ্ঠের উপর। পর্বতারোহণের জন্য অভিজ্ঞতা, শারীরিক সক্ষমতা এবং কারিগরী এবং সতর্কতামূলক জ্ঞান প্রয়োজন।‘

কিন্তু আমাদের কারো কিছুই ছিলো না; হঠাৎ কৌতুহল আর সাহস বেড়ে যায়। কারণ, আমরা সমতল থেকে প্রায় এক তৃতীয়াংশ উঠে এসেছি।  আমি স্বপনের পক্ষে সায় দিয়ে মনে মনে একটু প্রস্তুতি নিলাম। প্রস্তুতি মানে দু’টো শক্ত মরা ডাল কুড়িয়ে নিলাম। সেটাই একমাত্র সম্বল।

৮০৩ মিটার উঁচু Mont-Sainte-Anne-এ আস্তে ধীরে উঠতে সময় লাগলো পৌণে তিন ঘন্টা। উঁচু-নিচু, আঁকা-বাঁকা, এবড়ো-থেবড়ো, পাহাড়ি মাটির পথ বেয়ে, জঙ্গল পেরিয়ে এক সময় চূড়ায় উঠেলাম। কিন্তু আমাদের হাতে বাংলাদেশ এবং কানাডা কোনো দেশের পতাকাই ছিলো না। থাকলে নিশ্চয় দুই আঙ্গুলে V দেখিয়ে বিজয়ের হাসিমার্কা  ছবি তুলতাম!

পর্বতের শেখর থেকে দেখা নিচে সেন্ট লরেন্স নদী, ঘরবাড়ি, ছোট ছোট পাহাড়, প্রকৃতি দেখা  সে এক অন্য রকম অনুভূতি। শীতকাল হলে স্নো আর বরফের দৃশ্য দেখা যেতো আর ফলঋতু হলে লাল-হলুদের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাতো।

যাহোক। পর্বতের চূড়ার বেশ কিছু জায়গা জুড়ে পার্কের মতো। পর্যটকদের জন্য বসার জায়গা, রেস্টুরেন্ট এবং ক্যাবল কার স্টেশন। আমরা বেশ ক্লান্ত। পা অসাড় হয়ে আসছিলো। রেস্টুরেন্টে চা-কফি-জুস খেয়ে নামার সময় হেঁটে নয়; ক্যাবল কারে বিনা পয়সায় নেমে এলাম। বিনা পয়সার কারণ, ক্যাবল কারে উঠানামার টিকিট এক সাথে করতে হয়। নিচ থেকে। উপর থেকে নামার ওয়ান ওয়ে টিকিট নেই। এই এডভেঞ্চার অভিযান এক বিরল অভিজ্ঞতা!

পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই অতি সাধারণ ভাবে ২,৬২৫ ফুট উঁচুর পর্বতারোহী হিসেবে নিজেই নিজে ‘ধন্যবাদ’ দিলাম।

 

ইস্টইয়র্ক, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles