
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুম-খুনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যবহৃত ‘আয়নাঘর’ থাকার যে অভিযোগ উঠেছে, তার অস্তিত্ব র্যাবে থাকার কথা স্বীকার করেছেন বিশেষায়িত বাহিনীটির মহাপরিচালক (ডিজি) একেএম শহিদুর রহমান। ‘গুম তদন্ত কমিশনের’ নির্দেশে এখনো সেসব আয়নাঘর অপরিবর্তিত অবস্থায় রাখা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া র্যাবের হাতে যারা নির্যাতিত বা অত্যাচারিত হয়েছেন, যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তাদের পরিবারের কাছে দুঃখপ্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সমসাময়িক বিষয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের করা প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
র্যাবের ১০০ আয়নাঘর থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘যত ধরনের অভিযোগ আছে, গুমের বিষয়ে, খুনের বিষয়ে, আয়নাঘরের বিষয়ে, এটা গুম-খুন কমিশন তদন্ত করছে। আমরা তাদের সার্বিকভাবে এ তদন্তে সহায়তা করছি। আমরা আশা করব, এ তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে একটা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
র্যাব ডিজি বলেন, ‘র্যাবে যে আয়নাঘরের বিষয়টা এসেছে, এটা তো ছিল, আছে। কমিশন আমাদের নির্দেশ দিয়েছে, যে অবস্থায় আছে ওই অবস্থায় রাখার জন্য। কোথাও এখন কোনোরকম যেন পরিবর্তন, পরিবর্ধন না করা হয়। সে অনুযায়ী আমরা ঠিক ওইভাবেই রেখেছি, যা যেভাবে ছিল।’
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে গত ২৭ আগস্ট অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ‘গুম তদন্ত কমিশন’ গঠন করে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে চলতি বছর ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময়ের যেসব অভিযোগ কমিশনে জমা পড়েছে, তার বেশিরভাগই র্যাবের বিরুদ্ধে।
এদিকে গত মঙ্গলবার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তুলে র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে বিএনপি। পুলিশ সংস্কার কমিটির কাছে জমা দেওয়া সুপারিশমালা তুলে ধরতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলনে এসে বলেছিলেন, ‘র্যাব বাহিনী আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দনীয় হয়েছে। আর দেশের মধ্যে তো র্যাব মানেই একটা দানব। দেশে যত ধরনের খুন-গুম, যত এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং হয়েছে তার অধিকাংশই এই র্যাব বাহিনীর মাধ্যমে হয়েছে। সেজন্য আমরা এটিকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ করেছি।’ এর এক দিন পর র্যাবের মহাপরিচালক গণমাধ্যমে মুখোমুখি হয়ে ভবিষ্যতে র্যাব তার দায়িত্ব আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করবে বলে জানান।
শহিদুর রহমান বলেন, ‘আপনাদের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানাতে চাই, আজ পর্যন্ত যেসব জনগণ র্যাব দ্বারা, নির্যাতিত বা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদের কাছে এবং যারা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে, তাদের পরিবারের কাছে আমরা দুঃখপ্রকাশ করি এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করি।’
এসব ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচার প্রত্যাশা করে র্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার গুম-খুন কমিশন করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ ধরনের অপরাধ আমলে নিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করছে। আমরা আশা করব, সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে আমাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত হবে এবং এর বিচার হবে। এভাবেই দায়মুক্তি সম্ভব, অন্য কোনোভাবেই আমরা এ দায় থেকে মুক্ত হতে পারব না।’
তিনি বলেন, ‘শুধু সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচারের মাধ্যমেই আমরা দায়মুক্ত হতে চাই। আমি আপনাদের মাধ্যমে আবারও যারা র্যাবের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের পরিবারের, তাদের কাছে আবারও দুঃখপ্রকাশ এবং ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।’
এদিকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বর র্যাব এবং এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হলেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সাড়া মেলেনি। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বলে আসছে, নিষেধাজ্ঞা ওঠানোর প্রক্রিয়া বেশ ‘জটিল’।
র্যাব বিলুপ্তির বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শহিদুর রহমান বলেন, ‘আমি র্যাবে কর্মরত আছি। আমরা যতদিন র্যাবে দায়িত্ব পালন করব, আমাদের দায়িত্ব আমরা নিষ্ঠার সঙ্গে আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করব। এ ব্যাপারে সরকার যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, সেটাই শিরোধার্য। আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকব।’
র্যাবের পোশাক পরিবর্তন চান কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশের ক্ষেত্রে দাবি উঠেছে, র্যাবের ক্ষেত্রেও দাবি উঠেছে। আমরা পোশাক পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছি। পোশাকের বিষয়ে আমি মনে করি, পোশাকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষটাকে পোশাকটা পরানো হয় তারা। ভালো ব্যক্তি যে পোশাকই পরুক না কেন, তার কাছ থেকে আমরা ভালো কিছু পাব, খারাপ ব্যক্তি যত ভালো পোশাকই পরাই আমরা ভালো কিছু পাব না।’
‘রিক্রুটমেন্ট পলিসির ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারে না’‘রিক্রুটমেন্ট পলিসির ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীবান্ধব হতে পারে না’
র্যাবের নিজস্ব আইন প্রণয়নের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে জানিয়ে র্যাব ডিজি বলেন, ‘র্যাবের নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। পুলিশ ব্যাটালিয়ন আইন সংশোধন করে র্যাব বাহিনী গঠন করা হয়েছে। আমরা র্যাবের জন্য একটা আইন প্রণয়নের চিন্তা করছি। এ ছাড়া কীভাবে সংস্কার আনা যায় জনসাধারণের মতামতের সাপেক্ষে আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
আন্দোলনে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র্যাব ডিজি বলেন, ‘হেলিকপ্টারের বিষয়ে হাইকোর্টের যে রিট আছে, এ-সংক্রান্ত ফৌজদারি মামলাও রুজু হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এটার অনুসন্ধান করছে। আমরা আশা করব, এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হবে।’
আন্দোলনে গুলিবর্ষণকারীদের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ভিডিও ফুটেজ দেখে দুই হাতে দুটি পিস্তল নিয়ে গুলি করছিল পাবনায়, তাকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। যাত্রাবাড়ী এলাকায় লিটন নামে একজন ছিলেন তাকেও আমরা গ্রেপ্তার করেছি। এ পর্যন্ত ৩০ জনকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। আরও যারা অভিযুক্ত আছেন তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’
র্যাব সদস্যদের ছিনতাই-ডাকাতির মতো বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে যাওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত ছিনতাই-ডাকাতি-চাঁদাবাজির সঙ্গে সম্পৃক্ত জড়িত ১৬ জন র্যাব সদস্যকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি চার্জ দায়ের করেছি। ভবিষ্যতেও কোনো সদস্য এ ধরনের অপরাধ করলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা এবং বিভাগীয় মামলা দুটিই অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।’
নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যাকাণ্ড মামলায় যথেষ্ট অগ্রগতি আছে জানিয়ে র্যাব ডিজি বলেন, ‘৫ আগস্টের আগপর্যন্ত পাঁচজন গ্রেপ্তার হয়েছিল, তাদের দুজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিল। পরে আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন জবানবন্দি দিয়েছে। আশা করছি মামলার তদন্ত দ্রুত সম্পন্ন হবে।’
বগুড়ায় মাকে হত্যার দায়ে সন্তানকে অভিযুক্ত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজ করতে গেলে কিছু ভুলভ্রান্তি হয়, কাজ না করলে ভুল হয় না। এ ক্ষেত্রে যাতে ভুলভ্রান্তি না হয় ভবিষ্যতে সতর্ক থাকব। বগুড়ার ওই ঘটনায় পেশাদারিত্বের পরিচয় না দেওয়ার কারণে ওই অফিসারের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। তদন্তের পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত ১০ নভেম্বর বগুড়ায় গৃহবধূ উম্মে সালমা খাতুনের (৫০) লাশ বাড়ির ডিপ ফ্রিজের ভেতরে পাওয়ার ঘটনায় পরদিন তার ছেলে সাদ বিন আজিজুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
র্যাব-১২ বগুড়ার কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. এহতেশামুল হক খান নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘হাতখরচের টাকা এবং প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মনোমালিন্যের জেরেই মাকে হত্যার পর লাশ ডিপ ফ্রিজে রাখে সাদ বিন আজিজুর রহমান।’ অবশ্য পরে পুলিশি তদন্তে সাদ বিন আজিজুর ওই হত্যাকাণ্ডে জড়িত না থাকার তথ্য উঠে আসে। বিষয়টি নিয়ে শুরু হয় র্যাবের সমালোচনা।
আন্দোলনে র্যাবের অস্ত্র খোয়া যাওয়ার বিষয়ে মহাপরিচালক জানান, ১৬৮টি অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল যার মধ্যে ৯০টি উদ্ধার হয়েছে। আর লুট হওয়া ১২ হাজার গুলির মধ্যে ৭ হাজার উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট থেকে লুণ্ঠিত ২২৮টি অস্ত্র ও ১১ হাজার ৯৪১ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।