![মেয়েটি এখন কেমন আছে মেয়েটি এখন কেমন আছে](https://www.thebengalitimes.com/wp-content/uploads/2024/12/Picture6-2.jpg)
পশ্চিমের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। সূর্য আজকের মতো বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আকাশের লাল আভা লেক হিরনের পানিতে পড়ে এক অপরূপ রূপের সৃষ্টি করেছে। আমরা আজ দুপুরে এসে এখানে পৌঁছেছি। আমরা আঠারো জন। বিকেলে বেড়িয়েছি এখানকার লাইট হাউজ দেখতে। লাইট হাউজের পদদেশে লেক হিরনের পানি বয়ে যাচ্ছে নীরবে। লেক হিরনের গা ঘেসে শুধু পাথর আর পাথর। লেক হিরনের পানি শান্ত ছিল সে মুহূর্তে, তারপরও ছলাৎ ছলাৎ করা পানির একটা শব্দ এসে গড়িয়ে পড়ছে পাথরের উপর। আমরা এপাথর থেকে সে পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছি। পানিতে পা ডুবিয়ে উহু করে চিৎকার দিয়ে উঠছি। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি। ঠিক সেই সময়টুকুতে আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা যেন আঠারো জন তরুণ-তরুণী আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠেছি।
হিরন লেকের নির্জন তীরটি আমাদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ করেই চোখ পড়লো মেয়েটির দিকে। লেকের তীরে আমাদের থেকে কিছুটা দূরে একটু উঁচু জায়গায় মেয়েটি বসে আছে একটি তোয়ালে গায়ে জড়িয়ে। সোনালি রঙ চুলের মেয়েটির মুখে পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়েছে, দেখে মনে হচ্ছে কোনো শিল্পী তার তুলির আঁচরে মেয়েটিকে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে অসাধারণ সুন্দরী করে তুলেছে। হঠাৎ করেই তোয়ালে সরিয়ে মেয়েটি পানিতে ঝাঁপ দিল। আমি ঘাবড়ে গেলাম এই ভেবে মেয়েটি কি আত্মহত্যা করতে চায়? নাহ্ মেয়েটি পানিতে ডুব দিল না। গলা পর্যন্ত পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল এই বরফের মত ঠাণ্ডা পানিতে। মেয়েটি যে পানিতে নামার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে তা বুঝতে পারলাম তার পরনে সাঁতারের পোশাক দেখে।
মেয়েটি মিনিট পাঁচেক নিজেকে ডুবিয়ে রেখে আবার উঠে এলো ডাঙ্গায়। আবারও বসে থাকলো তোয়ালে জড়িয়ে। আবার কয়েক মিনিট পর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে নিজেকে গলা পর্যন্ত ভিজিয়ে রাখলো। এভাবেই চলতে লাগলো মেয়েটির পানিতে নামা আর উঠা। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল মেয়েটির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করি ‘এই মেয়ে তুমি ভালো আছো তো? তোমার মনে কি অনেক কষ্ট? সে কষ্টটুকু পানিতে ডুবিয়ে দিতে এসেছ? নাকি এটা এক ধরনের শারীরিক ব্যায়াম যা তোমাকে সুস্থ রাখবে? তুমি কি কোনো মানসিক রোগী? তুমি কেন এমন একা নির্জন বিকেলে বসে আছো এখানে’? কিন্তু আমার কোনো কথাই জিজ্ঞেস করা হলো না। আমি মেয়েটির কাছেও গেলাম না। এদেশে কারো ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে কৌতুহল দেখানোটা শোভনীয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটা হ্যারাসমেন্টের পর্যায়ে পড়ে যায়। বলা যায় না এই অপরাধে আমার বিরুদ্ধে একটা মামলাও ঠুকে দিতে পারে।
সূর্যের আলো প্রায় নিভে যেতে বসেছে। একটু পরেই অন্ধকার ছেয়ে যাবে পুরো এলাকাটিতে। আমরা পা বাড়ালাম কটেজের দিকে। কিন্তু তখনো মেয়েটি সেভাবেই তার ডুবে থাকার আর উঠে আসার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমার ফিরতে ফিরতে চিন্তা হচ্ছিল মেয়েটি কি সারারাতভর এই কাজটিই করবে, এই নিরব নিস্তব্ধ লেকের ধারে বসে?
প্রতি বছরই আমাদের এই বন্ধুর দলটি কটেজ ট্রিপে যাই। শীতের হাওয়ার নাচন বন্ধ হল উষ্ণ হাওয়ার মাতনে আমরা নতুন করে জেগে উঠি। গত বেশকিছু বছর ধরে কত না জায়গায় আমরা যাচ্ছি। আমাদের এবারের ট্রিপ ছিল টোবার মুড়িতে। সেদিন ছিল ঝুম বৃষ্টি। অঝর ধারার বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা আঠারোজন বেরিয়ে পড়েছিলাম কটেজের দিকে। সব বুকিং হয়ে গেছে। এখন কোনোভাবেই ট্রিপ বাতিল করা যাবে না। যা আছে কপালে। কোথাও বের হতে না পারলে ঘরে বসে খিচুড়ি ডিম ভাজি খেয়ে, আড্ডা দিয়ে গান কবিতা করে ও শুনে সময় কাটিয়ে দেবো। সেটাও তো মন্দ কিছু না? একঘেয়েমী জীবন থেকে কিছুটা হলেও তো বিরতি। এই অঝর ধারার বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমাদের এক বন্ধুর প্রিয় বার্গার, চ্যাম্প বার্গার খাবার জন্য নামলাম সেলবর্নে। তারপর আবার শুরু হলো পথ চলা। এই পথ চলার যেন কোনো ক্লান্তি নেই। বাইরে বৃষ্টি। গাড়ির ভেতরে সিডিতে বাজছে প্রিয় শিল্পীদের গান। সেলবর্ন পেরিয়ে এগুতে থাকলে চোখে পড়লো ডানে বায়ে অসংখ্য উইন্ড মিল। আগে কখনো একসাথে এত উইন্ড মিল দেখিনি। বেশ অবাক হয়ে ভাবলাম এই ছোট শহরটির নামটি কি উইন্ডমিল শহর দিলে ভালো হতো না? হাইওয়ে টেন ধরে ছুটে চলেছে গাড়ি। একে একে কিছু ছোট ছোট শহর ছেড়ে উঁচুনিচু পথে সবুজের সমারোহের মাঝ দিয়ে আমরা যাচ্ছি। যখন উপরের দিকে গাড়ি উঠে যাচ্ছে তখন দূরে তাকালে মনে হচ্ছে পথ যেন মিশে গেছে আকাশের সাথে।
আমি উদ্ভট চিন্তা করার একজন পারদর্শী মানুষ। পথ চলতে চলতে মনে হচ্ছিল রবীন্দ্রনাথ কিংবা কবি নজরুল যদি এই পথ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতেন তাহলে উনারা কি কবিতা বা গান লিখতেন? ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার হেরিনু পল্লি জননী’ নাকি অন্যরকম কিছু? যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছি একরের পর একর চাষের জমি। পাশে ফার্ম হাউজ। আর বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিরাট বাড়ি। মনে মনে ভাবি কারা থাকে এই সব বাড়িতে? এমন নিরব এলাকায় থাকতে ওদের ভয় করে না? যেতে যেতে আবার কখনো দেখলাম বড় রাস্তা থেকে মেঠো পথ ভেতরের দিকে চলে গেছে। গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলাম ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ আমার মন ভোলায় রে।’
বৃষ্টির পালা শেষ হয়ে গেছে। আকাশ হেসে উঠেছে উজ্জল রোদে। হঠাৎ করেই চোখে পড়লো একরাশ হলুদ আভা। বিপুল পরিমাণ জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার প্রিয় সর্ষে ক্ষেত। যা কি-না আমাকে নিয়ে যায় আমার শৈশবের কোনো এক সময়ে। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। রাস্তার দুপাশে কাশফুল ফোটার অপেক্ষায় বাতাসে দোল খাচ্ছে।
গাড়ি চলেছে ওয়াটন উইলী নামের ছোট শহরটির উপর দিয়ে। এই শহরটি থেকে অন্টারিওর একবছরের আবহাওয়ার পূর্বাভাষ জানানো হয়। ব্যাপারটি বৈজ্ঞানিক নয়, এক ধরনের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়। এখানে ওয়াটন উইলী নামে একাধিক মানুষ আছে। যারা বছরের কোনো এক সময় একটি গুহায় ঢুকে ছায়া দেখে পুরো বছরের আবহাওয়াবার্তা জানায়। এই বছর কতটা শীত পড়বে, কতটা তুষারপাত হবে। উষ্ণ আবহাওয়া মানুষ কতটুকু উপভোগ করবে ইত্যাদি। কেউ ওদের কথা বিশ্বাস করে কেউ করে না। অবশ্য কখনো কখনো ঝড়ে বক মরার মতো তাদের ভবিষ্যতবাণী ঠিকও হয়ে যায়। পরদিন আমরা রওয়ানা হলাম ফ্লাওয়ার পট আয়াল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। আবারো আমরা আঠারো জন। গ্লাসবটম নৌকাতে বসে আছি আমরা। নৌকার গতি দেখে মনে হচ্ছে এখনি আমরা উল্টে পড়বো। শান্ত লেক হিরন অশান্ত হয়ে উঠেছে। প্রচণ্ড বাতাস বইছে। দূরে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট পালতোলা নৌকো দুলে দুলে যাচ্ছে। লেকের পানির কী রং? নীল নাকি সবুজ? বুঝে উঠতে পারছিলাম না। যেতে যেতে জনমানবহীন ছোট ছোট দ্বীপ চোখে পড়ছিল। সেগুলো শুধুই পাথর আর পাথুরে গাছ দিয়ে গড়ে উঠেছে। তীরে দেখা যাচ্ছিল ছোট ছোট পাথরের নুড়ি। যা দেখে আমার মনে পড়ে গেল ছোটবেলার পাথর কুড়ানোর স্মৃতি।
সারাদিন ফুলদানি দ্বীপে ঘুরলাম। হাজার হাজার বছর ধরে পাথর ক্ষয় হতে হতে সেগুলো একেকটা ফুলদানির আকার ধারণ করেছে। সেগুলোতে বেড়ে উঠেছে নানারকমের পাথুরে ফুল। সে জন্যই হয়তো এই দ্বীপটির নাম ফ্লাওয়ার পট। পরদিন দেখতে গেলাম সেখানকার ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে যে বাস করে কত রকমের পাখি, কত রকমের গাছ তা জানতে পারলাম। প্রতিবারের মত এবারও মহা আনন্দে চার পাঁচদিন কটেজ ট্রিপে ঘুরে এলাম। সারাদিন নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি, বিকেলে বার-বা-কিউ, রাতে বন ফায়ার জ্বালিয়ে আড্ডা গান চললো। ফিরে আসার দিন সবার মন খারাপ। আবারো সে একঘেয়েমি জীবন। তারপরও ঘরে ফেরার একটা আনন্দ মনের মাঝে রিন রিন করে বেজে উঠলো।
লেকের ধার দিয়ে ফেরার পথে আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। মনে মনে যেন সে মেয়েটিকে আবারো খুঁজলাম। আজও মেয়েটির কথা মনে হলে আপন মনেই বলি, ‘এই মেয়ে তুমি ভালো আছো তো? তুমি কি এখনো খেলে যাচ্ছ তোমার পানিতে ডুবে থাকা আর তীরে উঠে আসার খেলা?’
ম্যাল্টন, কানাডা