বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ডিসেম্বর মাস এর কোনো তুলনা নাই। এই মাসেই বাংলা দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। বিশেষ করে প্রথম ১৪ দিনের যুদ্ধে।
ডিসেম্বরের তিন তারিখে দিল্লি ছিল শুনশান নীরব। ইন্দিরা গান্ধী তখন কোলকাতায় , মন্ত্রীরা ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ইন্ডিয়ার প্ল্যান ছিল চার তারিখে আক্রমণ করবে , কিন্তু পাকিস্তান আক্রমণ করে বসে তিন তারিখেই সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচ টায়। ইয়াহিয়া নভেম্বরের ২৯ তারিখে আক্রমণের প্ল্যান করেছিল , জানতো না ইন্ডিয়াও যুদ্ধের পরিকল্পনা করছে। ইন্ডিয়া তক্কে তক্কে ছিল , কখন পাকিস্তান আক্রমণ করবে ;পাকিস্তান সেদিন ইন্ডিয়ার বেশ কিছু বিমান ঘাঁটিতে হামলা করে বসে। ইন্ডিয়া প্রস্তুত ছিল না , তা নয়। তাই সুযোগ আসতেই পাকিস্তানের পূর্ব পশ্চিম দুই ফ্রন্টেই একযোগে পাল্টা আক্রমণ শুরু করে ।
মাত্র দু সপ্তাহের যুদ্ধে পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। নিয়াজির সেই কি কান্না , সে ছিল অপমানের কান্না, পূর্ব বাংলা হাতছাড়া হয়ে গেলো।
আসলে জেনারেল জ্যাকব এই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এক বছর ধরে , জ্যাকব ছিলেন ইন্ডিয়ান আর্মি’র ইস্টার্ন কম্যান্ড এর চিফ অফ স্টাফ। সেই সময়ে ইন্ডিয়ান আর্মি’র দশ লক্ষ সৈন্যের তুলনায় পাকিস্তানের ছিল মাত্র তিন লক্ষ , তাছাড়া মুক্তিবাহিনী ছিল সহযোগী শক্তি। পাকিস্তানিরা এমনিতেই গত নয় মাসের বাঙালির গেরিলা যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে পড়ে , তার উপর মুক্তিবাহিনী বাংলদেশের ভূখণ্ডের যাবতীয় অলিগলি চিনিয়ে দিয়ে ইন্ডিয়ান আর্মিকে এগিয়ে দিয়ে যায়। জ্যাকব তাই যুদ্ধের ছক আঁটতে গিয়ে সোজা ঢাকা আক্রমণ করার প্ল্যান করেন। একটা মজার সংলাপ আছে , জেনারেল মানেকশ , যিনি কিনা পুরো ইন্ডিয়ান আর্মির কমান্ডার , তিনি পরামর্শ দেন , ঢাকা বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম আর খুলনা আক্রমণ করতে , জ্যাকব বললেন , নো ওয়ে , এগুলো গুরুত্বপূর্ণ কোনো শহর নয় , যুদ্ধে এগুলোর কোনো ভূমিকা নেই। মানেকশ তার প্রিয় জ্যাকবকে মৃদু শাসিয়ে বলেন , সুইটি , তুমি কি বুঝতে পারো না , আমরা যদি চট্টগ্রাম আর খুলনাকে নিয়ে নিতে পারি, তাহলে কি ঢাকার স্বাভাবিকভাবেই পতন হবে না ? চার তারিখের ঘটনা এটি । সেই সাথে ইন্ডিয়া পাকিস্তানের পশ্চিম দিকটা ও ব্যস্ত করে রাখে। ইন্ডিয়ার নেভি করাচির বন্দরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সাত দিন ধরে জ্বলতে থাকে করাচি।
আসলে আমরা যেন ভুলে না যাই , নিক্সন এবং কিসিঞ্জার বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানের শুধু দোসর ছিল না , তারা চায়নাকে ও চাপ দিয়েছিলো , ইন্ডিয়ায় সীমান্তে সেনা পাঠাতে। এগুলো আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর দলিলের খবর। আর মার্কিনিরা তো নৌবহর পাঠিয়েছিল , সে আমাদের সবার জানা। আসলে ইন্দিরা গান্ধীর সুচতুর একটা কাজ ছিল মস্কোর সাথে আগস্টে মৈত্রী চুক্তি , তাই চায়না আর আগাতে সাহস করে নি।
আরেকটা মাস্টার স্ট্রোক ছিল , ছয় তারিখেই ইন্ডিয়া বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দেয়। এদিকে জাতিসংঘের যত চাপ ম্যানেজ করবার দায়িত্ব পড়ে সোভিয়েতের উপর।
ডিসেম্বরের দশ তারিখের মধ্যেই পাকিস্তানিদের মনোবল ভাঙতে শুরু করে। এগারো তারিখে আত্মসমর্পনের উপায় খুঁজতে থাকে। এদিকে আমেরিকা জাতিসংঘকে চাপ দেয় ইন্ডিয়াকে যুদ্ধবিরতিতে রাজি করাতে কিন্তু ইন্ডিয়া নাছোড়বান্দা , পাকিস্তানিদের নিরংকুশ সারেন্ডার ছাড়া কিছুতেই রাজি নয়। শেষমেশ কি আর করা , ষোলো তারিখে পাকিস্তান এর নিয়াজী প্রায় লক্ষ খানেক সৈন্যসহ আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়।
এতো পুরানো ইতিহাস বললাম এই কারণে যখন দেখি আমেরিকার ডিপ স্টেট এর হাত কত লম্বা। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের বিরোধিতা করে ডিপ স্টেট। আর ২০২৪ সালেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ২০২৪ সালে আমেরিকার ডিপ স্টেটের আরেক অংশীজন হচ্ছে এনজিও , ১৯৭১ সালে এনজিও র ভূমিকা চোখে পড়ে নি ।
একথা আর গোপন নেই , জর্জ সোরোস এর ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন পয়সা বিলিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে অরাজকতার ইন্ধন দিচ্ছে । বাংলাদেশে ও এর ব্যতিক্রম নেই। যেমন , জর্জ সোরোস এর পুত্র আলেক্স সোরোস এবং আরেক সহযোগী অতি উৎসাহী হয়ে বাংলাদেশ সরকারের উর্ধতনদের সাথে ঘনিষ্ঠতা করতে শুরু করেন । আমেরিকায় জর্জ সোরোস নামটার সাথে আতঙ্ক জড়িত , এটা আমেরিকানরা ভালোভাবেই জানে। আমেরিকার স্টেটে স্টেটে ২০২০ এর সামার রায়ট এর মূলে অন্যতম ছিল সোরোস এর ফান্ডিং।
বাইরের দেশগুলোতে মুদ্রা অবমূল্যায়ন থেকে শুরু করে সরকার পরিবর্তনে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ঘুটি চালাতে এদের জুড়ি নেই। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে একবার ধ্বস নামাতে চেষ্টা করেছিল , ভাগ্য ভালো, মাহাথিরের মতো দেশপ্রেমিক লোক ক্ষমতায় ছিল , খুব বেশি ক্ষতি করতে পারে নি। শুনছি, ইন্ডিয়াকে টার্গেট করছে , সোরোস এবার সোনিয়া, রাহুল কে কাজে লাগাতে চায় । মজার ক্লাইম্যাক্স হলো , রাহুল যখন নির্বাচনের পরদিন নভেম্বরের ছয় তারিখে ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানায় , ট্রাম্প প্রতি উত্তরে রাহুলকে ট্রল করে লিখে , “ধন্যবাদ ইন্ডিয়ান সোরোস এজেন্ট রাহুল গান্ধী। একটা বিষয় পরিষ্কার করতে চাই , জর্জ সোরোস এর মতো কেউ যদি নিজের দেশকে বিট্রে করে , তাহলে সে কখনোই আমেরিকা বা তার ভিশন কে সত্যিকারভাবে সমর্থন করতে পারে না। সবচেয়ে ভালো হয়, তোমার নিজের বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগ দাও , রাহুল”।
তবে ট্রাম্প এর এই বারের শাসন আমলে সোরোস গোষ্ঠী খুব একটা সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হয় না। কারণ ট্রাম্প এর ওয়ার রুম খুব ভালো করেই ক্লিনটন , ওবামা , সোরোস এর অক্ষ শক্তি নিয়ে অবগত আছে। সোরোস এর এবার আর মানবাধিকার ফেরি করার খুব একটা সুযোগ আছে বলে মনে হয় না । শুনেছি, ইন্ডিয়াতে সরকারকে পাশ কাটিয়ে স্থানীয় কোনো ফেরিওয়ালা সংগঠন বাইরের আর্থিক সাহায্য নিতে পারছে না আর । সোরোস এর ফর্মুলা অনেক দেশ ধরে ফেলেছে। মানবাধিকার এর দোহাই দিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে টাকা পয়সা ঢেলে উস্কে দিতে সোরোস এর জুড়ি নেই। মালয়েশিয়া , সিঙ্গাপুর এর মতো দেশগুলোতে শান্তি আছে কারণ ওসব দেশে কোনো ধরণের মহাজনী ব্যবসা বা মানবাধিকার ফেরি করার কোনো সুযোগ নেই।
তাই সোরোস বা তাদের আশ্রিত কেউ যদি কোনো সরকার বা বিরোধী দলের সাথে বেশি মাখামাখি করে , তাহলে একটু সাবধান থাকা ভালো। মানবাধিকার ফেরি করতে এসে মুখের ভাত কেড়ে নিতে পারে।
টরন্টো, কানাডা