-1 C
Toronto
বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৩, ২০২৫

মায়া রিভারা (পঞ্চম পর্ব)

মায়া রিভারা (পঞ্চম পর্ব)
মায়া রিভারা পঞ্চম পর্ব

ঘুম থেকে উঠে হোটেলের রুম থেকে বের হয়ে এসে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। এখন আর বৃষ্টি নেই। ঝলমলে আকাশ। নীল আকাশে  সাদা মেঘ বেশ শান্ত ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে । কোথায় যেনো একটি ঘুঘু পাখি অনবরত ডেকে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই মনে হয় ঘুঘু  আছে এবং তার গুম গুম করা ডাক আছে। ঘুঘুর ডাক কখনো আমাকে আনন্দ দেয় না। ঘুঘুর ডাক শুনলে মনে হয়, এক রাশ দুঃখ আমাকে পেয়ে বসেছে। আর নির্জন দুপুরের ঘুঘুর ডাক আমার মনে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। খামাখাই মনে হয় আমি কি যেনো হারিয়ে ফেলেছি। আমার বুকের ভেতর এক গভীর শুন্যতা বিরাজ করতে থাকে।

শান্ত ঝিরঝির বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমার  সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছের পাতা গুলো মৃদু দোলায় দোল খাচ্ছে। আমার মনে পরে গেলো আমাদের  বাড়ীটির কথা। যে বাড়ীতে কেটেছে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার তরুন বয়সের চঞ্চলতা। সেখানেও দেখতাম নারিকেল গাছের পাতার দোল  খাওয়া। হৃদয়ের ভেতরে চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকা দুঃখের পাখিটি ডানা ঝাপটা দিয়ে উঠে বসলো। শুধু উঠে বসেই সে ক্ষান্ত থাকলো না। আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেলো আমাদের সে বাড়ীটিতে যেখানে জুই ফুলের লতা গাছটি ছাদ পর্যন্ত বেয়ে উঠে মৌ মৌ গন্ধে ভরিয়ে দিতো। সিঁড়ির দুই পাশে কামিনী গাছ, দোলন চাঁপার দোলা, হাস্নেহেনার সুভাস, নানা রঙের গোলাপের সমাবেশে বাড়িটি সজ্জিত থাকতো। ছুটির দিনের দুপুর বেলা পেয়ারা গাছ থেকে ডাঁসা পেয়ারা পেরে তেতুল লবন মরিচ দিয়ে খাওয়া আর হাসি আনন্দে মেতে থাকা। আমার হৃদয়ের পাখিটির ইচ্ছে ছিলো আমাকে আরো অনেক দুর উড়িয়ে নিয়ে অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে দেবার। কিন্তু রুমের ভেতর থেকে আমার স্বামীর ডাকে তাকে থেমে যেতে হোল।

- Advertisement -

এখন আমরা আবার বাইরে বেড় হবো। বিকেলের সাজ সজ্জা অন্য রকম । সবাই নিজেকে সুন্দর সাজে সজ্জিত করে। ঘুরে বেড়ায় এদিক সেদিক, নানা ভঙ্গিমাতে ছবি তোলে, সমুদ্র সৈকেত যায় নরম বাতাসে মন মাতাতে। হোটেলের ভেতরে সুসজ্জিত মল সেখানে ঘুরে বেড়ায় কেনাকাটা করে, পাশেই স্থানীয় জিনিষে ভরা প্লাযা। ভ্রমনকারীদের এটাও ঘুরে বেড়াবার আকর্ষণীও স্থান। কেউ কেউ আবার ঢুকছে ক্যাছিনোতে। কেউ হারবে কেউ জিতবে এ আরেক  নেশা। কেউ বের হয়ে আসে উজ্জ্বল খুশি মুখ নিয়ে কাউবা মলিন মুখ করে। সবি ভাগ্যের খেলা। চারপাশে ঘুরানো নানা বাহারি জিনিষে আকাশচুম্বী দাম নিয়ে মলের দোকান গুলো দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানের ফাকা জায়গাতে বিশাল মঞ্চ। সেখানে নানা রকম বাদ্য যন্ত্রের সাথে চলছে স্থানীও শিল্পিদের গান। অনেকে বসে মুগ্ধ হয়ে শুনছে তাদের গান। যার যেটা ভালো লাগছে সে সেটাই করছে।

আমরা আজ বের হলাম চার পাশটা ঘুরে দেখবো বলে এবং নিরিবিলি বসে থাকবো সমুদ্র সৈকতে সে উদ্দেশ্য ।

রুম থেকে বের হয়ে নিচে নেমে আসলাম। কি যে দুর্দান্ত সুন্দর ভাবে সাজানো চারপাশটা। সতেজ সবুজে ঢাকা  পুরো জায়গাটা তার মাঝে নিজস্ব ভঙ্গিমাতে দাঁড়িয়ে আছে বড় বড় গাছ গুলো। এখানে যে জিনিষটা  লক্ষ্য করালাম সেটা হোল এই রেজোডটিতে পাতা বাহারের সমারোহ যে পরিমান সে ভাবে ফুলের বাহার নেই আর নেই পাখির সমাবেশ। এখানে পাখিরা দল বেঁধে উড়ে এসে বসছে না। কিচির মিচির আর কলতানে ভরে তুলছে না পরিবেশটা। মাঝে মাঝে চড়ুই পাখির মতো কিছু পাখি কিচির মিচির  করে ঘুরা ঘুরি করে খাবারের সন্ধান করে উড়ে চলে যাচ্ছে। কি যে অসাধারন করে সাজানো হেটে যাবার পথটা হাঁটতে হাঁটতে পেলাম চাঁপা ফুলের মতো ফুল। ফুটে আছে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু গাছে। মনটা খুশি হয়ে গেলো ফুলের দেখা পেয়ে। ‘ চাঁপার বনে  রঙ লেগেছে আয়রে চলে আয়’ সুর করে বলতে বলতে দুটো ফুল ছিঁড়ে চুলে গুজে নিলাম। বেশ অনেকটা পথ ঘুরাঘুরি করে ,দর্শনীয় জায়গাগুলো দেখলাম ছবি তুললাম দুজনে মনের মাধুরী মিশিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে আবার এলাম সাগরের তীরে পরন্ত বিকেলের সাগরের রুপ দেখার জন্য। বিকেলে মানুষের ভিড় নেই সৈকতে। দূরে দুচারজকে দেখলাম পানিতে নেমেছে। আমাদের সামনে  দিয়ে দুজন তরুন তরুণীকে হাত ধরাধরি করে পানির দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম। সূর্য্য পুরো আকাশে লাল আভা ছড়িয়ে ডুব দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তরুন তরুণী ধীরে ধীরে দুজন দুজনের কোমর জড়িয়ে পানিতে নেমে যাচ্ছে। ধরে নিলাম ওরা হয়তো নব বিবাহিত দম্পতি, মধু চন্দ্রিমা করতে এসেছে। শেষ বিকেলের নীরব সৈকতের এ দৃশ্যটা অসাধারণ লাগলো। মনের ক্যামেরাতে ধরে রাখলাম তরুন তরুণীর রোমান্টিক দৃশ্যটি।

সন্ধ্যা নেমে আসছে ধীরে ধীরে। হোটেল রুমে ফিরতে হবে, রাত নয়টায় ডিনারের বুকিং দেয়া আছে  রেষ্টুরেন্টে। এখানে যদিও কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট আছে যারযার সময় মতো নির্ধারিত লাঞ্চ ও ডিনারের সময় সীমার মধ্যে খেয়ে নিচ্ছে। তারপরও হোটেল থেকে তিনটি বিশেষ রেষ্টুরেন্টে খাবার কুপন দেয়া হয়। ভ্রমণকারীরা যে কোন তিনটি বিশেষ রেষ্টুরেন্ট পছন্দ করতে পারে ডিনারের জন্য। আজকে আমাদের মাক্সিকান রেষ্টুরেন্টে ডিনার করার রাত। এই বিশেষ রেষ্টুরেন্ট গুলোতে ফরমাল ড্রেসে যাবার নিয়ম। যেমন তেমন ভাবে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। আমরাও একটু ফ্রেস হবো রুমে যেয়ে।

আমরা দুজন গল্প করতে করতে এগুতে লাগলাম। গল্প করে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের হোটেলের প্রবেশ পথটা কখন যে নজর থেকে চলে গেছে বুঝতে পারিনি। হোটেলে কর্মরত একজনকে জিজ্ঞাস করাতে সে দেখিয়ে দিলো আমাদের প্রবেশ পথ। আমরা সে পথে আনন্দ সহকারে ঢুকে গেলাম। কিন্তু কোথাও আমাদের রুম নাম্বারের এরো বা সাইন দেখতে পেলাম না। ঘুরে বেরাচ্ছি এপ্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। কোথায় গেলো আমাদের রুম নাম্বার?

পুরোটা বিল্ডিং খুঁজেও আমাদের রুমের হদীস পেলাম না। মনে হোল পথ হারাবার জন্যই যেন আজ পথে নেমেছি। রিসিপসান ডেস্কে গিয়ে বার বার গিয়ে জিজ্ঞাস করছি। ওরা যে ভাবে বলছে সে ভাবেই এগুচ্ছি তারপরও আবার হারিয়ে যাচ্ছি। হোটেলে কর্মরত লোককে জিজ্ঞাস করলাম। একটা শব্দ ইংরেজি ওরা বুঝে না এবং বলতেও পারে না। প্রচণ্ড হতাশাতে আমরা ডুবে গেলাম। যেখানে প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টাতে প্রতি মিনিটে  বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমনকারীরা আসছে সেখানে কি করে হোটেলে কর্মরত মানুষ গুলোকে ইংরেজি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি? আমি বিস্মিত হতাশাগ্রস্ত এবং রাগান্বিত। দুএকজনকে একটু রেগে বললাম, কেন তোমরা ইংরেজি শেখো না?

গোলক ধাঁধাঁয় ঘুরতে ঘুরতে দেখা হোল একটি দম্পতির সাথে যারা আমাদের মতো বেড়াতে এসেছে। উহ জানে পানি আসলো, দুজন ইংরেজি জানা মানুষ পাওয়া গেলো। ওরা আমাদের বললো আমরা হোটেলের অন্য বিল্ডিংয়ে চলে এসেছি। পাশের বিল্ডিংটা আমাদের। আমাদের জানাই ছিল না এখানে হোটেলের তিনটি ভাগ পাশা পাশি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর দিয়েই একটা থেকে আরেকটাতে যাওয়া যায় এবং তিনটির প্রবেশ পথও আলাদা। যাহোক পথ হারিয়ে পথের ঠিকানা পেলাম। সমস্ত হতাশা সমস্ত ক্লান্তির অবশান হোল। অথচ এ কথাটা  আমাদের এতক্ষণ কেউ বুঝিয়ে বলতে পারলো না। পৃথিবীর এত দেশ ঘুরেছি কিন্তু এমন ভাষা সমস্যাতে কোন দিন পরতে হয়নি।মানুষ ভুল করে শিখে আমরাও ভুল করে শিখলাম।

 

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles