-5.5 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

রাজকন্যা

রাজকন্যা
রাজকন্যা

দোল দোল দুলনী

রাঙা মাথায় চিরুনি

- Advertisement -

বর আসবে এখনি

নিয়ে যাবে তখনি।

মা শিশুকে দোল দিতে দিতে গান করে। দোলনার দোলায় শিশুটি হাসে। কী যে ফুটফুটে একটি শিশু। মনে হয় যেন একটি ফুটন্ত ফুল ফুটে আছে। মা ভাবে কার মতো হয়েছে তার মেয়েটি? এই পরিবারে তো এমন সুন্দরী কেউ নেই। মায়ের নজর নাকি বড্ড খারাপ এই ভেবে মা থুথু ছিটিয়ে দেয় শিশুটির গায়ে। বড় করে কালো টিপ দিয়ে রাখে শিশুটির কপালে যেন কারো নজর না লাগে শিশুটির উপর। মা বাবা আদর করে শিশুটির নাম রাখে ‘রাজকন্যা’। মেয়ে যে তাদের রাজকন্যার মতোই দেখতে। রাজকন্যার দাদি বলে রাজকন্যা হয়েছে তার দাদির মতো। সে তো কতকাল আগের কথা, দাদির-দাদি? কী করে এতকাল পরে রাজকন্যা সে রূপ নিয়ে জন্মগ্রহণ করলো? শাশুড়ির কথা শুনে রাজকন্যার মা হাসে। ভেবে নেয় এটা শাশুড়ির মনগড়া কথা। রাজকন্যার দাদি চেহারা মলিন করে বলে, ‘শোন বউমা, আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের মেয়েদের এত রূপ ভালো না। পরের ঘরে যাবার আগে পর্যন্ত মেয়েকে তোমার আগলে রাখতে হবে। দুনিয়া বড় খারাপ বুঝলা বউমা?’ রাজকন্যার মা বিরক্ত বোধ করে শাশুড়ির কথায়।  রাজকন্যার মা রাজকন্যাকে সাজায়, মেয়েকে কোলে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পাড়ায়। বাবা নানারকম খেলনা জামা কাপড় কিনে আনে মেয়ের জন্য। রাজকন্যা যেন তাদের খেলার পুতুল। কতো স্বপ্ন দেখে বাবা-মা রাজকন্যাকে নিয়ে। বাবা-মায়ের আদর ভালোবাসায় রাজকন্যা বেড়ে উঠতে থাকে। তিন মাস, ছয় মাস, একবছর বয়েস হয়ে যায় রাজকন্যার। এর মাঝেই একপা দুপা হাঁটতে শুরু করেছে রাজকন্যা। বাবা-মা রাজকন্যার জন্মবার্ষিকী পালন করলো ঘটা করে। শাশুড়ি আবারো মুখ মলিন করে বললেন, ‘এত বাড়াবাড়ি ভালো না। মানুষের নজর লাগে।’

রাজকন্যা একবছর পেরিয়ে দেড় বছর পেরিয়ে দুবছরে পা দিল। কিন্তু রাজকন্যা কোনো কথা বলে না কেন? রাজকন্যার বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকে। মা রাজকন্যাকে বলতে থাকে, মা বলো, মা-মা। বাবা বলে, মা বলো, বাবা-বাবা। রাজকন্যা কিছুই বলে না। অদ্ভুত শব্দ করে কী যেন বলতে চায় আর বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসে। স্বজনরা সান্ত্বনা দিয়ে বলে চিন্তার কোনো কারণ নেই, অনেক বাচ্চাদের তারা চিনে যারা তিন বছর চার বছরে কথা বলেছে। রাজকন্যার দাদি জায়নামাজে বসে দোয়া দুরুদ পড়েন রাজকন্যাকে যেন আল্লাহ্তালাহ তাড়াতাড়ি কথা বলার ক্ষমতা দান করেন। রাজকন্যা বাবা-মায়ের সাথে খেলে, মা-বাবাকে আদর করে চুমু দেয়, বাবার চুল টেনে টেনে খেলে, মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। কি খাবে কি নিয়ে খেলবে আঙুল দিয়ে দেখায়। হাসে কাঁদে স্বাভাবিকভাবে কিন্তু একটা শব্দও ফুটে না মুখ দিয়ে। নাহ এভাবে বসে থাকা যায় না। রাজকন্যার বয়েস এখন তিন বছরের কাছাকাছি হয়ে গেছে। এখন ডাক্তার দেখাতে হবে। নানারকম ছোট খাট শারীরিক অসুস্থার জন্য কতবারই ডাক্তার দেখেছে, কই কেউ তো কখনো বলেনি রাজকন্যার কথা বলার সমস্যা হবে? রাজকন্যাকে নিয়ে বাবা-মা যায় ডক্তারের কাছে। মফস্বল শহর ফরিদপুর। এখানে বিশেষ অসুস্থতার জন্য বিশেষ কোনো বিশেষজ্ঞ নেই। তারপরও ডাক্তার নানারকম পরীক্ষা করে জানালেন, মনে হচ্ছে কণ্ঠনালীতে সমস্যা আছে আর কণ্ঠনালীতে সমস্যা মানে কানেও সমস্যা, আপনারা বরং ঢাকা নিয়ে কোনো গলা-কানের বিশেষজ্ঞ দেখান এবং তাদের পরামর্শ মতো যা করনীয় তাই করান। রাজকন্যার বাবা-মায়ের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। তাহলে কি আমাদের রাজকন্যা বোবা-কালা হবে? ডাক্তার সান্ত্বনা দেয়, এত ভাববেন না। দেখুন বড় ডাক্তার কী বলেন। আমি তো আর এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই। ডাক্তার সাহেব নাম ঠিকানা সবকিছু দিয়ে দিলেন রাজকন্যার বাবা-মাকে ঢাকার ডাক্তারের। রাজকন্যা কিছুই বুঝতে পারে না সে আপন মনে তার প্রিয় খেলনাগুলো দিয়ে খেলতে থাকে। রাজকন্যার বাবা-মা রাজকন্যাকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার পর ডাক্তার সাহেবের চোখ দিয়ে নিজের অজান্তে দুফোঁটা অশ্রæ ঝরে পড়ে এই ভেবে, এমন পরীর মতো মেয়েটিকে কেন সৃষ্টিকর্তা কেন বাকশক্তি থেকে বঞ্চিত করলেন?

রাজকন্যার বাবা-মা ঢাকার পথে রওয়ানা হন। ঢাকা শহরে তাদের আত্মীয়- স্বজনের অভাব নেই। রাজকন্যার মায়ের মা বাবা সবাই তো ঢাকাতে থাকে। তারাও তো চিন্তিত রাজকন্যাকে নিয়ে। রাজকন্যাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার নানারকম পরীক্ষা করতে দেন। পরীক্ষার ফলাফল এলো। ডাক্তার জানালেন ফলাফল যেটা এলো সেটা হলো, রাজকন্যার জন্ম থেকেই শ্রবণ এবং কথা বলার শক্তি খুবই দুর্বল। একটা শব্দ বহুবার বলতে বলতে হয়তো সেটা হালকাভাবে শুনতে পাবে এবং সেটা বলার চেষ্টা করবে কিন্তু সেটা অন্য বাচ্চাদের মতো হবে না। স্বাভাবিকভাবে সে কখনো কথা বলতে পারবে না। তারপরও বলবো সবকিছুই উপরওয়ালার ইচ্ছা। তিনি চাইলে সবকিছুই করতে পারেন। আমাদের একজন ভালো একজন স্পিচ থেরাপিস্ট আছে। আপনারা কিছুদিন থেকে তার কাছ থেকে চিকিৎসা নিয়ে যান। তাছাড়া উনি আপনাদের শিখিয়ে দেবেন বাড়িতে কী করে স্পিচ থেরাপি করতে হবে। রাজকন্যার বাবা-মা চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ফেরে। কিছুদিন ঢাকা থেকে নিজেরা এবং রাজকন্যাকে কিছুটা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে। ডাক্তার সাহেব আরো বলে দিয়েছিলেন, এখন এসব বাচ্চাদের জন্য অনেক ভালো ভালো স্কুল খোলা হয়েছে। আরেকটু বড় হলে যেন রাজকন্যাকে সে সব একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় সেখানে এসব বাচ্চারা নানা বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে।

রাজকন্যাকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখেছে তার বাবা-মা। রাজকন্যাকে গান শেখাবে, নাচ শেখাবে। অনেক দূর পড়াশুনা শেখাবে। মায়ের ইচ্ছা ছিল মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। বাবা বলতেন রাজকন্যা যা হতে চায় তাই হবে আমরা কিন্তু কোনো চাপ দেবো না ওকে। রাজকন্যার বাবা-মায়ের সব স্বপ্ন নিমিষে ধুলিস্যাৎ হয়ে গেলো। মেয়ের ভবিষ্যৎ কী হবে চিন্তা করে রাজকন্যার বাবা-মা আড়ালে কেঁদে বুক ভাসায়। সৃষ্টিকর্তার কাছে অভিযোগ করে, কী দরকার ছিল আমার মেয়েকে এত সুন্দরী বানাবার অথচ তার কথা বলার শক্তিটা তুমি দিলে না। এই শিশু মেয়েটির কী অপরাধ যে কি-না জীবনে কথা বলতে পারবে না? এ তোমার কেমন বিচার আল্লাহ্!

 

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -
পূর্ববর্তী খবর
পরবর্তী খবর

Related Articles

Latest Articles