-0 C
Toronto
বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

টরন্টো ফিল্ম ফোরামে কবি হেলাল হাফিজ স্মরণ

টরন্টো ফিল্ম ফোরামে কবি হেলাল হাফিজ স্মরণ
টরন্টো ফিল্ম ফোরামে কবি হেলাল হাফিজ স্মরণ

গত ২৮শে ডিসেম্বার শনিবার চরম শীতে বেশ রাত করে টরন্টো ফিল্ম ফোরাম নিজস্ব অডিটোরিয়ামে কবি হেলাল হাফিজ স্মরণ করলো। তিনজন নারী আবৃতিকার কবির লোকপ্রিয় কবিতা আবৃতি করলেন অন্য অনেকে কবিকে নিয়ে কথা বল্লেন তাদের মধ্যে আমিও একজন। ভালো বলেছেন সাওগাদ আলি সাগর সহ আরো কয়েকজন।

কবি রোখসানা আমার ও কয়েক জনের ভিডিও রেকর্ড করে দিয়েছে তারটি করে দিয়েছেন অন্য একজন যা পেলাম সব জোড়া দিয়ে নিজের ইউ টিউব চ্যানেলে দিয়ে দিলাম। ইচ্ছে হলে উপরের লিঙ্কে ক্লিক করলেই ভিডিও দেখতে পারেন।আরো খুশি হতাম চ্যানেলটি যদি Subscribe এ ক্লিক করলে। যারা বল্লেন অনেকেরই কথায় কবির বাল্য কিশোর প্রেম হেলেনের সাথে সেই প্রসঙ্গ এসেছে।

- Advertisement -

আসারই কথা কবি এতটাই সিরিয়াস ছিলেন যে মিলন না হওয়ায় নিজকে আজীবন বিরহের আগুনে পুড়িয়েছেন। প্রেমিকা হেলেন এখনো জীবীত তবে বদ্ধ উন্মাদ। ৭০ দশকের প্রথম ভাগে হেলাল হাফিজ ঢাকার দৈনাক পূর্বদেশ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। চট্রগ্রামে আমার একটি গল্প পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়ে ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল যে গল্পটি ভালো লাগলে ছাপতে চিরকুট লিখে আমাকে ঢাকা পাঠিয়ে ছিলেন হেলাল হাফিজের কাছে।

লেখাটি তিনি ছেপে ছিলেন। শুধু খারাপ লেগে ছিলো পাঠ শেষে মাথা তুলে প্রশ্ন করে ছিলেন- গল্পটি সত্যি তুমি লিখেছো? দুইটি ধাক্কা লেগে ছিলো সরাসরি তুমি করে বলায়,আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও সবার মত আমাকেও আপনি বলতে।দ্বিতীয়ত গল্পটি আমার লেখা কিনা সন্দেহ করা। ঢাকার জাতীয় দৈনিকে গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত জনপদের পর ঢাকার দৈনিক পূর্বদেশে আমার  দ্বিতীয় ছাপা গল্প। স্বনামধন্য লেখক সাংবাদিক রাহাত খান ছিলেন আমার গুরু তিনি ও হেলাল ভাই দুইজনই নেত্রকোণার মানুষ। হেলাল হেলেন এই চরম প্রেমের কথা রাহাত ভাই দুঃখ করে আমাকে বলে ছিলেন। আমারই ভুল হেলেন নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করায় তিনি এরপর থেকে আমার সঙ্গে তেমন একটা কথা বলতেন না।

গোটা ৮০ দশক ৩৫ তোপখানা রোড বিটপী বিজ্ঞাপনী সংস্থার দুই কদম প্রেস ক্লাবের দিকে যেতে নিউ ক্যাফে ঝিল এর পাশে আঁকা বাঁক অপরিকল্পিত ভাবে দাঁড়া করানো হোটেলের তিন তলার একটি রুমে কবি হেলাল হাফিজ তার জীবনের লম্বা সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। দুই তলা সিঁড়ি দিয়ে উঠলে আমিও ওনার সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারতাম, তবে যাইনি। অথচ বিটপীতে কাজ করতাম তাই লাঞ্চ করতে ক্যাফে ঝিলে যেতে সেই হোটেলের সামনে দিয়েই হেঁটে যেতাম।  এরপরে, এইতো এই বছরের মার্চের শেষের দিকি শাহবাগ শাকুরা বারের পেছনে চার নাকি পাঁচ তলা একি হোটেল,মোটেল নাকি হোস্টেল বোঝা মুস্কিল ৩০ থেকে ৪০ হাজারে সকালে নাস্তা দুপুর এবং রাতে খাওয়া।হপ্তায় একবার কাপড় চোপোড়ও মেশিনে ধুয়ে দেবে।মালিক একজন চাইনিজ তবে মেনেজমেন্টে সব বাংলাদেশি।

কবীর হোসেন তাপসের গাড়িতে মুন্নী সাহা এসেছে এখানেই গত বেশ কয়েক বছর ধরে থাকা কবি হেলাল হাফিজে সাথে দেখা করতে। আমিও তাদের সঙ্গে এসেছি যেহেতু পাঠক সমাজ বইয়ের দোকানে বিবি রাশেল আমার জন্যে বিজুর রুমে অপেক্ষা করছেন।ওরা ওপরে উঠে গেলো আমি নিচে গাড়ি থেকে নেমে আজিজ সুপার মার্কেটের বিপরীতে দোতলায় পাঠক সমাজের দিকে গেলাম। প্রায় পাঠক সমাজে সিঁড়িতে উপরে উঠতে পা বাড়িয়েছি তখনি তাপসের ফোন এলো ধরতে দেখি সরাসরি হেলাল ভাই বল্লে নিচে এসেও চলে গেলা। আসো একবার এত বছর পর দেখা হোক,আমার ওপর রাইগা থাইকোনা! আমি বল্লাম দুই এক দিনেই আসছি। তিনি বল্লেন – আসলে ফ্রন্ট ডেক্সে তোমার নাম বলে আমাকে কল করতে বলো আমি তেমন কারো সাথে তেমন একটা দেখা করি নাতো,তাই তার দেখা হবেনা বলে দেয়।

এরপরও দুই মাস ঢাকায় ছিলাম। তবে যাচ্ছি যাবো করে জুনের শেষে টরন্টো ফিরে এলাম আর যাওয়া হলোনা,তিনি চলে গেলেন। হেলেন ও তার এই তীব্র প্রেম তিনি কারো সাথে শেয়ার করতে চাইতেন না। তবে তার জীবনকে পুড়িয়েছে আজীবন।কি ভাবে অন্য নারীর সঙ্গে থাকবেন তাই ভেবে জীবনে বিয়েই করেননি। হেলেন তাকে একটাই চিঠি লিখে ছিলো বিয়ের আমন্ত্রণ পত্র সহ। উত্তরে শত চিঠি তিনি লিখেছেন হেলেনকে একটিও উত্তর আসেনি। লম্বা ফর্সা পুরোনো ঢাকার নাওয়াব বাড়ির বংশভূত মুন সিনেমা আরো কয়েকটি সিনেমার মালিকের সঙ্গে হেলেনে দারোগা পিতা বিয়ে দিয়েছেন। বুকে বিশাল ভারি পাথর চেপে তাই হেলেন সংসার করছিলেন।

প্রেমিকের চিঠি না পড়েই ছিড়ে ফেলে দিয়েছেন। তবু কি রক্ষা হলো! একদিন বউকে খুশি করতে বইমেলা থেকে বেশ অনেক গুলো বই কিনে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।তিনি না জেনে নিজের সর্বনাশ করলেন। বই গুলোর মধ্যে ছিলো হেলাল হাফিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘যে জলে আগুন জ্বলে’। প্রেমিকের বইয়ের কবিতার পর কবিতা পড়ে হেলেন থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। তাকে নিয়ে কবি প্রমিকের একি নিবেদন,একি বন্দনা,,একি ভালোবাসা। ছিড়ে ফেল্লেন বইটি,টুকরো-টুকরো করে।হয়তো হেলেন নিজকেই এরপর টুকরো-টুকরো করে ছিড়ে ফেলে ছিলেন।

তাই দ্রুত পাগল থেকে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেলেন।এমনি অবস্থা যে চেইন দিয়ে বেঁধে রাখতে হয়।তার কবি প্রেমিক যে আর নেই তার খবরই নেই। তবে এ নতুন কিছু নয় তাইতো হেলাল হাফিজই লিখে গেছেন ‘ মূলত ভালোবাসা মিলনে মলিন হয় বিরহে উজ্জ্বল।’সব স্বনামধন্য মহা মানুষের সঙ্গে যেন এমনটাই হয়। কাফকা তার মিলেনাকে পান নাই। এডগার এলেন পো সারাহ কে পাননি। লর্ড বায়রন  নিজের প্রিয়া হারিয়ে লিখে ফেলে ছিলেন জগত বিখ্যাত কবিতা ‘ড্রিমার্স’। দান্তে বিয়াট্রেস  না পেয়ে যত কষ্ট ঢেলে দিয়ে লিখে ছিলেন ‘ডিভাইন; শিল্পী ভিন্সেন্ট ভ্যান গোহ তার প্রিয় যৌনকর্মীর কাছে প্রত্যাখ্যান হয়ে এতটাই দুঃখ পেয়ে ছিলেন যে নিজের বুকু বন্দুক রেখে গুলি চালিয়ে ছিলেন।

আমাদের বাংলা রহস্যময় কবি জীবনানন্দ দাশ আজীবনের ভালোবাসা শোভনার জন্যে কাতরতা সহ্য করতে না পেরে অতি ধীরগতি ট্রামে ইচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়ে ছিলেন। চট্টগ্রাম চোখের সামনে দেখেছি বন্ধু কবি ত্রিদীব দস্তীদারের মেরিয়ানের জন্যে আজীবন হাহাকার। ক্যাথলিক খৃষ্টান মেয়ে মেরিয়ানের ধনী বাবা কোনো মতে অগোছালো ত্রিদীবের সঙ্গে বিয়ে দেবেন না। চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় মেরিয়ানদের বাড়িতে ঢুকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বাবা ভাই ব্রাদার মিলে মেরে নাক মুখ থেতলে দিয়ে ছিলো। ত্রিদীব টলতে টলতে এসে ছিলো নালাপাড়ায় সদ্য মুক্তিযুদ্ধ ফেরত মহা যুদ্ধবাজ মহিউদ্দীন ভাইয়ের দখলকৃত পত্রিকা অফিসে।সেটাই আমাদের আস্তানা ছিলো তখন।

কবি স্বপন দত্ত,হেনা ইসলাম,খুরশিদ আনোয়ার,কাজী রফিক,শিশির দত্ত আর আমি এই বাড়ি থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতকে কাঁপিয়ে দেয়া দেশ স্বাধীনের পর প্রথম সাহিত্য আন্দোলন ‘স্পাক জেনারেশান’ এই বাড়ি থেকেই শুরু করে ছিলাম। এই মহিউদ্দীন ভাই পরে বড় আওয়ামী নেতা ও চট্টগ্রামের মেয়র হয়ে ছিলেন। ত্রিদীবের এই অবস্থা দেখে মহিউদ্দীন ভাই রেগে আগুন। নিজের স্টেনগান হাতে তুলে নিলেন,তার সঙ্গীরাও তাই করলো।

সাথে গল্পকার হেনা ইসলাম সহ সঙ্গে ফাদার (পাদ্রী) বিয়ে রেজিষ্টার সহ সবাই স্টেনগানের গুলি আকাশের দিকে ছুড়তে-ছুড়তে মেরিয়ানদের বাড়ি ঘিরে ফেলা হলো। ভেতরে ঢুকতে দেখা গেলো ভয়ে সবাই কাঁপছে। হাত জোড় করে মাফ চাইলেন মেরীয়ানের বাবা। যারা মেরে ছিলো তাদে কান ধরে উঠবস করালেন। খৃষ্টান ধর্মীয় ভাবে এবং রেজীস্ট্রার বিয়ে দিতে বাধ্য করলেন মহিউদ্দীন ভাই এন্ড গ্যাং। কথা হলো ত্রিদীব স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত মেরিয়ান বাবা মায়ের সাথে থাকবে।

সেভয়ের কেক এনে কাটা হলো। মেরিয়ান ত্রিদীবতো ভীষণ খুশি। এরপর মাত্র আড়াই মাস পর একদিন মেরিয়ানের গোটা পরিবার কানাডায় চলে গেলো।বাড়ি বিক্রী,ব্যবস্যা বিক্রী করে।কবে যে এসব করলো কাকপক্ষী কেউ জানেনি। মেরিয়ানও যাওয়ার আগে কিছু জানায়নি।এরপর থেকে ত্রিদীব আর বিয়ে করেনি। আজীবন মেরিয়ান! মেরিয়ান হাহাকার করেই মরে গেলো। তাই বলি হেলাল হেলেনই প্রথম নয় অনেক খ্যাতিমানদের জীবনে এরকম হয়েছে,,ভবিষতেও হবে।

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles