-5.5 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

রাজকন্যা পাখির মতো ডানা মেলে

রাজকন্যা পাখির মতো ডানা মেলে
ডাক্তারের পরামর্শ মতো রাজকন্যার মা তাকে নানাভাবে শিক্ষা দিতে থাকে

ডাক্তারের পরামর্শ মতো রাজকন্যার মা তাকে নানাভাবে শিক্ষা দিতে থাকে। বড় বড় ছবির বই কিনে রাজকন্যাকে পাখির মতো ডানা মেলে বলে-এটা পাখি, আকাশ দেখিয়ে বলে-পাখি আকাশে কীভাবে উড়ে। মাছের ছবি দেখিয়ে দেখায়-মাছ কী করে পানিতে সাঁতার কাটে, বারবার কানের সামনে মুখ নিয়ে বলে-রাজকন্যা বলো মা। তিন বছর পেরিয়ে চার বছর হতে চললো। এর মাঝে কয়েকবার রাজকন্যাকে ঢাকা নিয়ে ডাক্তার দেখানো হয়েছে। স্পিচ থেরাপিষ্টের সাথে থেকে নতুন নতুন পদ্ধতি শিখে নিচ্ছে। রাজকন্যা এখন অদ্ভুত শব্দ করে বলতে পারে বাবা, মা, দাদি। পাঁচ বছর হলেই রাজকন্যাকে ভর্তি করানো হবে নানারকম প্রতবিন্ধী বাচ্চাদের স্কুলে। অন্তত রাজকন্যা কিছু বন্ধু পাবে। তাদের সাথে খেলবে। স্কুলটি তাদের বাড়ি থেকে বেশি দূর না। কতবার ওরা স্কুলের সামনে দিয়ে আসা যাওয়া করেছে। তখন কি তাদের কল্পনাতেও এসেছিল তাদের সন্তানকে এই স্কুলে ভর্তি করাতে হবে?

রাজকন্যার দাদির সকাল বিকেল একই কথা, ‘একটাই মেয়ে তাও আবার কথা বলতে পারে না।’ মেয়েটারও একটা খেলার সাথী দরকার। তোমরা কি চিরদিন বেঁচে থাকবে? তখন তো রাজকন্যাকে দেখার কেউ থাকবে না এই দুনিয়াতে। শাশুড়ির কথার সত্যতা উপলব্দি করে রাজকন্যার মা। কিন্তু ভয় অন্য সন্তানটিও যদি একই সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে? তারপরও রাজকন্যার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে আরেকটি সন্তান নেবার সিদ্বান্ত নেয় ওর বাবা-মা।

- Advertisement -

রাজকন্যার পাঁচ বছর হয়ে গেছে, ওকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। কয়েকদিন স্কুলে গিয়ে কান্নাকাটি করলেও কিছুদিনের মধ্যেই রাজকন্যা স্কুলের আনন্দ পেতে থাকে। কিছু বন্ধু হয়, যাদের সাথে ওরা তাদের মতো করে খেলে কথা বলে। বাবা বাড়ি ফিরলে বাবাকে বসিয়ে হাত নেড়ে নানারকম শব্দ করে কি করলো কি শিখলো বাবাকে বলে। মেয়েকে খুশি দেখে বাবা-মা কিছুতা স্বস্তি পায়। আরেকটি ছেলে শিশুর জন্ম নেয় পরিবারে। ভাইকে নিয়ে রাজকন্যার খুশির শেষ নেই। ভাইকে আদর করে, ডাকে ভাই-ভাই। স্কুল থেকে ফিরে রাজকন্যার প্রথম কাজ ভাইকে নিয়ে খেলা। বাবা-মা ছেলের কোনো গালভরা নাম রাখলো না। খোকা বলেই ডাকে শিশুটিকে। বাবা-মায়ের মনে আতঙ্ক কি জানি কি হয়। না খোকার তেমন কিছু হলো না। স্বাভাবিক সময়ে স্বাভাবিকভাবেই খোকা কথা বলতে শুরু করে। বাবা-মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

সময় দ্রæত পেরিয়ে যায়। রাজকন্যা তরুণ বয়েসে পা রাখে। তার স্কুল পর্ব শেষ। স্কুল থেকে অনেক কিছু শিখেছে রাজকন্যা, সাথে সাথে ঘরে মায়ের কাছ থেকে। একমাত্র কথা বলা ছাড়া রাজকন্যা সবকিছুই করতে পারে। তাছাড়া অনেকগুলো শব্দই বলতে পারে সে। অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়ে হয়ে উঠে রাজকন্যা। এক নজরে মুগ্ধ হওয়ার মতো একটি মেয়ে। তরুণ বয়েসের আবেগ আনুভুতি ভালোবাসা প্রেম সবকিছুই জন্ম নেয় রাজকন্যার ভেতর। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে, কপালে টিপ পরে, লিপস্টিক লাগায়, হাতে চুড়ি পড়ে, দীর্ঘ কালো চুলে বেণী বাঁধে, চুলে ফুল গুজে নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয় রাজকন্যা। স্বপ্ন দেখে কোনো এক রাজপুত্রের, যে কি-না তাকে এসে হাত ধরে নিয়ে যাবে। বৃষ্টি নামলে খুশিতে রাজকন্যা ছুটে যায় বৃষ্টিতে ভিজতে, বসন্তের হাওয়া দেখে উদাস হয়ে উঠে, আকাশে পূর্ণ চাঁদ দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। মাকে নিয়ে শাড়ির দোকানে যায় শাড়ি কিনতে। বড্ড বুদ্ধিমতি মেয়ে রাজকন্যা বাকহীন বলে বাইরের লোকদের সামনে মুখ খুলে না, যা বলার হাতের ইশারাতে বলে। রাজকন্যা বুঝতে পারে সে কথা বলার জন্য যে শব্দ করবে এতে বাবা-মা বিব্রত বোধ করবে হয়তো। বুকের ভেতর তোলপাড় ঘটে যায় কিন্তু প্রকাশের কোনো বাক শক্তি নেই। তার অনুভূতিগুলো হৃদয়ের গহীনে জমতে থাকে। বৃদ্ধা দাদির সেবা করতে করতে দাদিকে হাতের নানারকম ভঙি করে বোঝায় ওর বিয়ে করতে ইচ্ছা করে, মাথায় টিকলি পরবে লাল শাড়ি দিয়ে ঘোমটা দেবে, বর আসবে পাগড়ি পড়ে, বিয়ে করে ফুল দিয়ে সাজানো গাড়িতে করে ওকে নিয়ে যাবে। মামাতো, ফুপাতো বোনদের বিয়েতে গিয়ে সবকিছু দেখে রাজকন্যার আবেগ আরো বেড়ে যেতে থাকে। মা বাবার চিন্তার শেষ নেই কে করবে বিয়ে তাদের বোবা মেয়েকে? এই অপরূপ সুন্দর মেয়েটির যেভাবে বিয়ের সখ, প্রেম ভালোবাসার অনুভূতি জেগে উঠেছে-কখন কী অঘটন ঘটে যায় কে জানে? রাজকন্যাকে চোখের আড়াল করে না তার মা।

রাজকন্যার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসে কিছু, কিন্তু ভালোবেসে কেউ আসে না। আসে করুণা করতে এবং সে করুণার বিনিময়ে প্রচুর চাহিদা। বাবা-মা বুঝতে পারে তারা চায় অর্থ সম্পদ, বোবা মেয়ে তাদের আগ্রাধিকার না। তার চাইতে তাদের মেয়ে তাদের কাছেই থাকুক। আদর আহালাদে বড় হওয়া মেয়েটিকে তারা কোনো পানিতে ভাসিয়ে দেবে? রাজকন্যার একমাত্র বন্ধু ছোট ভাই খোকা। খোকার সাথে হাত নেড়ে গল্প করে, হাসে। খোকার সাথে বসে টেলিভিশন দেখে। খোকা হাসলে রাজকন্যাও হাসে। সময় এগিয়ে চলে দ্রæত। খোকা বড় হয়ে ঢাকা চলে গেছে পড়তে। রাজকন্যার আর কোনো বন্ধু রইলো না। বৃদ্ধা দাদি সারাদিন বিছানাতে শুয়ে থাকে আর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন, ‘আহা রে এমন সুন্দর গুণি মেয়েটাকে কথা বলতে পারে না বলে কেউ বিয়ে করলো না। আল্লাহ্ কী জীবন তুমি লিখে রাখলা মেয়েটার?’ রাজকন্যা বুঝতে পাড়ে দাদির কষ্ট। কথা বলতে না পারলেও রাজকন্যা তার অনুভূতি দিয়ে সবকিছুই বুঝে নেয়।

রাজকন্যা হতাশাতে ভুগতে থাকে। ও বুঝে গেছে কোনো রাজপুত্র আসবে না তাকে ঘরে তুলে নিতে। রাজকন্যা এখন আর কপালে টিপ পরে হাতে চুড়ি পরে চুলে ফুল গুজে আয়না দেখে না। বৃষ্টি ঝরা দেখে ছুটে যায় না। বসন্তের হওয়াতে খোলা চুলে বাগানে হাঁটে না। জোৎস্নার আলো দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে না। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে রাজকন্যা রাতে শুয়ে কাঁদে। সারাদিন মায়ের সাথে সংসারের কাজ করে। ভর দুপুরে সবাই যখন বিশ্রাম নেয়, রাজকন্যা তখন একরাশ ব্যথা নিয়ে উদাসভাবে জানালার গ্রিল ধরে তাকিয়ে থাকে। ও বুঝতে পারে না ওর জীবনটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে।

ম্যাল্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles