![হোয়াট দা হেল ইজ গোয়িং অন? হোয়াট দা হেল ইজ গোয়িং অন?](https://www.thebengalitimes.com/wp-content/uploads/2025/01/Picture8-2.jpg)
একদিনের ঝটিকা সফর শেষে সন্ধ্যায় অশোয়া থেকে অটোয়ার দিকে রওনা দিলাম। হাইওয়ে ৪০১ এ ওঠার পর হঠাৎ একটা গাড়ি ইন্ডিকেটর না জ্বালিয়েই লেন চেঞ্জ করে আমাদের সামনে চলে আসলো। আমি দ্রুত ব্রেক করে হর্ন দিয়ে সতর্ক করলাম। সে থতমত খেয়ে বোকার মতো আবার আগের লেনে ফিরে গেলো। সবাই প্রবল ঝাঁকুনি খেলাম। একটা সম্ভাব্য এক্সিডেন্ট থেকে বাঁচলাম।
বিত্ত পেছন থেকে রাগান্বিত হয়ে বলল- হোয়াট দা হেল ইজ গোয়িং অন? কোনো রিজন ছাড়া লোকটা এরকম করলো কেন?
– ড্রাইভারটা মনে হয় এক্সপার্ট না। নতুন ড্রাইভাররা এরকম করে- বললাম।
গাড়িতে হেমন্তের গান বাজছিলো। আমিও গুনগুন করে তাল মিলাচ্ছিলাম। গিন্নি বলল- এতক্ষণ ধরে বাংলা গান বাজছে; আর ছেলে মেয়েরা আপত্তি করছে না, আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখি!
দখিনা পেছন থেকে বলল- বিত্ত’র কানে হেডফোন, তাই প্রটেস্ট করছে না।
হেমন্তের “আয় খুকু” গানটা শুনে সে বলল- আব্বু, মেয়েটা আব্বুর ডাক আর শুনতে পায় না কেন?
– তার বাবা মারা গেছে
– ইটস স্যাড!
গিন্নি পাশ থেকে প্রতিবাদ করে উঠলো- তার বাপ মারা যাবে কেন? বেচেঁ আছে
– না, মারা গেছে..
– আশ্চর্য্য, মেয়েটাকে তুমি আপসেট করছো কেন?
– যেটা সত্যি, সেটাই বলতেছি..
– গানে কোথাও উল্লেখ আছে, যে তার বাবা মারা গেছে?
– ডাইরেক্ট তো আর বলবে না..।
দখিনা বলল- আব্বু, গানটা আবার দিবা?
হেমন্তের ভরাট কণ্ঠে আবার বেজে উঠলো- আয় খুকু আয়..। মেয়েটা হয়তো গানের মর্ম বুঝবার চেষ্টা করছে। সে পেছন থেকে স্পষ্ট বাংলায় বলল- আব্বু, আমি তোমাকে ভালোবাসি
– হা হা, জানি মা।
আমার হাসার কারণ তার কঠিন কঠিন বাংলা বলা। বাংলা শেখার তার অসীম আগ্রহ। সেদিন আমাদের অবাক করে বলল- আব্বু, তুমি কী গুল ঝারতেছো [মিথ্যা বলছো]? সেদিন সে স্কুল যায়নি; আমি কারণ জানতে চাইলে সে অবিকল আমার স্টাইলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল- “গরিবের আবার স্কুল..”
আব্বু, বলো তো আমাদের এই লং ড্রাইভ এতো ইম্পর্ট্যান্ট কেন?
– কতো জায়গায় ঘোরাঘুরি করা যায়, তোর ফুপুদের বাসায় যাওয়া যায়..
– তারচাইতেও ইম্পর্ট্যান্ট হলো, বিত্ত আমাদের সাথে পাঁচ ঘন্টা থাকে। গ্রেট ফ্যামিলি টাইম পাওয়া যায়
– তাইতো!
– তা না হলে বিত্ত নিজের ঘরে গেমস খেলতো।
ভাই-বোন পেছনের সিটে বসে হাজারটা খুঁনসুটি করে, মারামারি করে, দু’জন দুজনকে আদর করে, কুইজ ধরে, খেলা করে। আমি গাড়ির আয়নায় লুকিয়ে দেখার চেষ্টা করি..
খিদে লাগতেই গিন্নিকে বললাম- দেখো তো কালকের বেঁচে যাওয়া স্যান্ডউইচ আছে নাকি? খাওয়া যাবে?
– সারা রাত মাইনাস পনেরো ডিগ্রিতে ছিল; কিছু হবার কথা না। চারটা আছে!
আমরা চারজন চারটা চিকেন স্যান্ডউইচ খেতে থাকি। একদম ঠিক আছে, তবে খুব ঠান্ডা। খেতে অবশ্য মন্দ লাগছে না। গিন্নি কালকের মুড়ি চানাচুরের কৌটা খুলে এক মুঠো চিবিয়ে বলল- আরে, পুরা মচমচে!
ঠান্ডার এই এক সুবিধা; খাবার নষ্ট হয় না। ড্রাইভ করা অবস্থায় সে আমার ডান হাতে এক মুঠো করে মুড়ি দিচ্ছিল। আমি মুখে নিয়ে কুড়মুড় করে চিবাতে থাকি।
আমরা Odessa অনরুটে থামলাম কফি ব্রেক নিতে। কারণ টানা চার ঘন্টা ড্রাইভ করা সম্ভব নয়। ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে, কফি খেয়ে ঘুম তাড়াতে হয়। আর ওয়াশরুম করাটাও জরুরি। এটা অটোয়া আর অশোয়া এর মধ্যবর্তী স্থান। দখিনা ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল- কফি এতো মজা হতে পারে!
– ইয়াকি! ফ্রেঞ্চ ভ্যানিলা কফি তুই কীভাবে খাস? কফির মধ্যে ভ্যানিলার গন্ধ আমার বমি লাগে..
বিত্ত নিয়েছে টিম হর্টনস এর ইনফিউসার এনার্জি ড্রিংক ক্যান।
খামোখা..
বিত্ত বলল- আব্বু, আমরা কতো লাকি!
– কেন রে বাবা?
– আমাদের কত সুন্দর একটা ফ্যামিলি আছে!
– আলহামদুলিল্লাহ!
তবুও আমার খুব ভয় করে।
এদেশে বাচ্চাদের মানুষ করা খুব একটা সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে তারা যখন হাইস্কুলে উঠে। বিপথে যাবার মোক্ষম সময়। এ সময় তাদেরকে আমাদের কালচার, ফ্যামিলি ভ্যালু নিয়ে শিক্ষা দিতে হয়। তারা অবশ্য পজিটিভভাবেই নেয়। তাদের যথেষ্ট বুদ্ধি-বিবেচনা হয়েছে। তারাও জানে এদেশের মানুষ কতোটা ভয়াবহভাবে বিচ্ছিন্ন পরিবারে বড়ো হয়। অনেকে জানেই না কে তাদের বাবা। তবে ভালো উদাহরণও আছে.. সবাই তো একরকম নয়। তাছাড়া ‘ফ্রি কান্ট্রি’ ব্যাপারটা যে আমাদের জন্য প্রযোজ্য নয়, সেটা আমরা মাঝেমধ্যেই তাদের স্মরণ করিয়ে দেই। তারাও আমাদের সাথে একমত পোষণ করে বলেই ভরসা পাই।
হঠাৎ তুষার পড়া শুরু হলো।
আমি গাড়ির গতি একশো ত্রিশ থেকে নামিয়ে নব্বই করে ফেললাম। মাইনাস বারো ডিগ্রিতে তুষার খুব একটা সুখকর কিছু না। রাস্তা হয়ে যায় মারাত্মক পিছলা। তার ওপর প্রচন্ড বাতাস। আমরা চুপ মেরে গেলাম। সবাই বেশ দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত।
বেশিরভাগ সময়েই আমাদের রওনা দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। ক’মাস আগে ফিরবার পথে রাস্তায় ঝমঝমে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। হাইওয়ে তে বৃষ্টি আরো ভয়াবহ।
এখনো প্রায় দুশো কিলোমিটার দূরের পথ পাড়ি দিতে হবে। ইতিমধ্যেই দুইটা এক্সিডেন্ট চোখে পড়লো। আমার সমস্ত কন্সেন্ট্রেশন রাস্তার দিকে।
মাঝেমধ্যে কফিতে চুমুক দিয়ে ঘুম তাড়াতে থাকি..
অটোয়া, কানাডা