আমার বন্ধু সাত সকালে উঠে বেলচা হাতে স্নো পরিষ্কার করা শুরু করেছে। আমি হেল্প করতে চাইলে সে সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই রেস্ট নে। এবার কোনো কাজ করবি না। ঘুমাবি, ঘুরবি, খাবি। তুই হচ্ছিস আমার গেস্ট। তুই কাজ করলে লোকে নানা কথা বলবে। সব কথা ফেইসবুকে পোস্ট না করলে তোর পেটের ভাত হজম হয় না। আমাকে বানায়ে ফেলছিস ভিলেন। তুই বসে বসে দেখ কিভাবে স্নো ক্লিন করি- বলে এক পাশ থেকে স্নো ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসে মাঝখানে জমা করতে থাকে। আগে একটা সাইড ক্লিন করবি, তারপর একসাথে বরফ নিয়ে গাছের গোড়ায় ফেলবি- বলে ব্রেক নিয়ে পকেট থেকে ম্যাচ বের করে সিগারেট ধরিয়ে মনের সুখে আকাশে ধোঁয়া ছুড়তে থাকে।
প্রচন্ড ঠান্ডা, মাইনাস পনেরো। বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যায় না। আমি বাসার ভেতরে গিয়ে মচমচে চিকেন রোল খেতে খেতে কফিতে চুমুক দিতে থাকি আর তার বিশাল কাঁচের জানালা গলে তার কাজ দেখতে থাকি। বেচারার কষ্ট দেখে খারাপ লাগছে। মানুষটা আসলে খারাপ না। আমাকে গতকাল থেকে কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না। এমনকি কাল বাজারে গিয়ে ট্রলিটা পর্যন্ত সে আগাগোড়া নিজে ঠেললো। কথায় কথায় কফি খাওয়ালো।
সকাল সাড়ে ছয়টা থেকে শুরু করে নয়টার মধ্যে সে সমস্ত বরফ সরিয়ে ফেলল। কাজ সে আসলে ঠিকই পারে; সমস্যা হলো করে না। ঘর-দুয়ার গোছানো, বাজার করা, স্নো সরানোর কারণ হচ্ছে আজ তার বাসায় বিরাট পিকনিক হবে।
সে আধাঘন্টা মতো রেস্ট নিলো।
আমরা ব্যাকিয়ার্ডে গিয়ে শেষ মাথায় বরফ খুঁড়ে একটা বিরানব্বই লিটারের বিরাট প্লাস্টিকের বক্স বের করে কম্বিনেশন লক দেয়া তালা খুলে, ডালাটা তুলতেই দেখি ভেতরে অর্ধেকটা আস্ত ছাগল, দুটা পাতিহাঁস, তিনটা মুরগি আর একটা মাঝারি সাইজের টুনা মাছ রাখা। মোটা পলিথিনে মোড়ানো।
সে চাকু দিয়ে ঘ্যাচাং করে ছাগলের সামনের পা দুটো কেটে নিয়ে, দুটো বিরাট মুরগী আর দুই হাঁসের গলা ধরে টেনে বের করে ডালা আটকালো। তারপর আরেক পাশের বরফ সরিয়ে আরেকটা বাক্স খুঁড়ে তিন প্যাকেট নান রুটি, আইসক্রিম এর কৌটা, টিনের কৌটায় রেডিমেড কুনাফা বের করলো। বলল- রুটিগুলা ঘি দিয়ে সামান্য ভেজে নিলেই দেখবি পারফেক্ট।
সে এক টার্কিশ দোকান থেকে এসব অদ্ভুত সাইজের রুটি আর ডেজার্ট কিনে আনে। এই কুনাফা ফ্রিজ থেকে বের করে ওভেনে দিয়ে কিছুক্ষন গরম করে চিজ ছিটিয়ে দিলেই হয়ে যায় পারফেক্ট মুচমুচে কুনাফা। শেষে শুধু একটু চিনির সিরা ঢেলে দিলেই হয়।
খানা আজ হবে একখান!
এরকম আয়োজন জীবনে দেখিনি। তার দশজন বন্ধু আসবে। বাথটাব সাইজের কয়লার চুলাও সে অর্ডার দিয়ে এনেছে টার্কিশ দোকান থেকে।
এখন বাজে সকাল দশটা।
ফ্রোজেন খাবারগুলো আমরা এলুমিনিয়ামের ট্রে তে রাখলাম। দুপুর একটার মধ্যে বরফ ছেড়ে যাবে। অটোয়া থেকে আনা গিন্নীর বেধে দেয়া গরুর ভুড়ি, সিম ভাজি, ডাল দিয়ে পেট পুরে খাবার খেয়ে আমরা নেমে পড়ি মাংস মেরিনেড করতে। সে আমার গিন্নির ভূয়সী প্রশংসা করে বলল, ভাবীর রান্নায় যাদু আছে। সে নিজ হাতে মাংস সাইজ করা শুরু করলো। খাসির ঠ্যাং দুটো চাকু দিয়ে ফালা ফালা করতে লাগলো; যাতে একদম ভেতরে মজ্জা পর্যন্ত মশলা ঢুকে। সে যদিও মশলা দেয় খুব কম। কিছু রোজমেরি, লবন, গলানো মাখন, গোলমরিচ, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ-রসুন-আদা বাটা। আর কিচ্ছু না। ভাই রে ভাই, সেই স্বাদ হয়! আগেও দু’বার খেয়েছি তার খাসির পায়ের বার্বিকিউ।
হাঁসদুটাকে এস সাইজের লোহার আংটায় ঝুলিয়ে জাপানি মশলার বোতল বের করে ব্রাশ করতে লাগলো। কমলা রঙের পাতলা সসটার দাম পঁচিশ ডলার। মেইড ইন জাপান। সে এসব কোথায় পায় খোদা জানে!
মাইনাস পনেরো ডিগ্রিতে ঠিক বিকাল পাঁচটার সময় বাসার পেছনে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো চুলা। লোহার চুলায় দুই বস্তা কয়লা ঢেলে একটা ফ্যান চালিয়ে দিলো। কয়লার তীব্র আগুনের উত্তাপে কাছেই ভেরা যাচ্ছিল না। চারপাশটা লোহার নেট দিয়ে ঘিরে দিলো, যাতে তাপ আটকানো থাকে।
আমার কাজ কিছুক্ষন পরপর ঝলসানো ভেড়ার রান, মুরগি আর হাঁসে সস ব্রাশ করা। প্রথমে খুব সন্দেহ ছিল, ওগুলো এতোই উপরে ঝুলিয়েছিল, যে তাপ লাগার কথা না। কিন্তু কি আশ্চর্য! মাংসগুলো ঝলসে গিয়ে টুপটুপ করে রস গড়িয়ে পড়তে থাকে কয়লার ওপর। কয়লা থেকে বার্বিকিউ এর স্বর্গীয় সুবাস ছড়িয়ে পড়লো সারা মহল্লায়। ভাগ্য ভালো দুপুরের পর থেকে আর স্নো পড়েনি। বাতাসও নেই। ঘন্টাদুয়েক ঝলসানোর পর মাংস হয়ে আসলো। আমাকে দিয়ে মুক্ত হস্তে টেস্ট করালো। জোর করে মুখে ঠেসে ঠেসে ধরলো। আগুন থেকে মাংস তুলে খাওয়ার মজাই আলাদা। হাঁসগুলো হলো দেখার মতো। লালচে কালারের চামড়া মুচমুচে হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিলো বড়সড় একটা কলার মোচা। সে হাঁসগুলো কাটার বোর্ডে রেখে জাপানি দা দিয়ে কোপ মেরে ঠাস ঠাস শব্দে কেটে ফেলল। আর ছাগলের ঠ্যাং, মুরগী নামিয়ে একটা লোহার চোঙার মধ্যে নিয়ে অল্প কয়েকটুকরা কয়লা ঢুকিয়ে নিয়ে মুখ আটকিয়ে পাঁচ মিনিট তাপে রাখলো। এভাবে নাকি হাড় পর্যন্ত স্মোকি ফ্লেভার ঢুকবে!
সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে সব রেডি।
সে নিজের হাতে টার্কিশ টি পটে চা-কফি বানিয়ে সবাইকে সার্ভ করতে থাকে। টার্কিশ চা-কফিতে খুব একটা বিশেষত্ব না থাকলেও পরিবেশনা দেখে ভালো লাগলো। সুলতান আমলের রুপার পাত্র। কুনাফাগুলো কাঁসার গোল পাত্রে নিয়ে কিছুক্ষন কয়লার উপর বসিয়ে উপরে এক গাদা চিজ ছিটিয়ে, চিনির সিরাপ ঢেলে নামিয়ে ফেলল। টকবগ করে ফুটতে লাগলো কুনাফা!
সে খুশি হয়ে বলল- রিপন রে, এই খানা তোর আজীবন মনে থাকবে। লিখে রাখ!
আটশো ডলার খরচ করে নর্তকী হায়ার করে নিয়ে আসা হয়েছে। মানুষ না বলে হুর বলাই উপযুক্ত হবে। রূপকথার দেশের অপরূপা রাজকন্যা সেজে নাচ শুরু করে দিলো এই লেবানীজ নর্তকী। এরাবিক বাজনার সাথে এরাবিক নাচ। চিশতীর আমন্ত্রণে এক টার্কিশ বন্ধুও এসেছে। সে তার সাথে নাচতে নেমে গেলো। তার দেখাদেখি সবাই, এক লোক আমার হাত ধরে টান দিয়ে নিয়ে গেলো নাচাতে। আমরা বারো জন নাচতে থাকি হুরের সাথে। সবার হাতে চায়ের পেয়ালা..
কি তার নাচের ভংগিমা!
বক্ষ দুলিয়ে, দুই হাত ঢেউয়ের মতো দোলাতে দোলাতে পেছনে নব্বই ডিগ্রি বাঁকা হয়ে আবার সোজা হয়ে যাচ্ছে। মখমলের মতো চুল তার হাঁটু পর্যন্ত। ঝলমলে আলোয় শান্ত সমুদ্রের পানির মতো ঝিলিক দিচ্ছিলো। গাড় নীল চোখ তো নয়, যেন জীবনানন্দের সেই পাখির বাসা! দুধে-আলতা গায়ের রং। লম্বায় পাক্কা ছয় ফিট। হিরেখোচিত ঝলমলে গোলাপী ছোট স্কার্ট পড়েছে, বুকের কাছে সামান্য এক চিলতে মখমল ঝিকমিক করছে। শরীরের মারাত্মক বিপদজনক বাঁকগুলোর দিকে চোখ আটকাবে না এমন মানুষ পাওয়া বিরল। ঠিক যেন নোভাস্কোশিয়ার কেপ ব্রেটনের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ভয়ংকর সুন্দর বাকঁ! যে রাস্তায় উঠলে অপরূপ দৃশ্য দেখে যে কেউ এক নেশায় আসক্ত হয়ে যেতে বাধ্য। আবার একটু অসতর্ক হলেই জীবন শেষ!
নর্তকী বিদায় নিলো ঘন্টাখানেক পর।
এবার আমরা ফুরফুরে মেজাজে বসে গেলাম বেইজমেন্টের বিরাট সাজানো টেবিলে। রান্নাঘরে তাওয়ায় মাখনে নানরুটিগুলো ভেজে আনলাম। ঝলমলে ঝাড়বাতি। রুপার থালায় খাবারগুলো সাজিয়ে চিশতী নিজ হাতে পরিবেশন করতে লাগলো। প্লেটে সাজানো হাঁসের লালচে চকচকে মাংস, সাথে মুরগী আর ছাগলের পায়ের মাংসের বিরাট টুকরো। হাঁসের উপরে টেরিয়াকী সস আর প্রচুর সালাদ দেয়া। এক ডিশ ফ্রায়েড রাইস। আমার টার্গেট এই ভাতের উপর। ভাত ছাড়া আমি অচল। সে চারটা বাঁশের ঝুড়িতে তোয়ালের মধ্যে প্যাঁচানো ঘিয়ে ভাজা টার্কিশ নানগুলো সার্ভ করে নানা রকমের সসের বাটি সাজিয়ে চেয়ার টেনে বসে বলল, বিসমিল্লাহ করা যায় কি বলেন?
আমরা সবাই বিসমিল্লাহ বলে প্লেট টেনে নেই। অপেক্ষা করে করে আমার সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে। খিদেতে পেটের অবস্থা কাহিল; পাচক রস তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে শিকার ধরতে। ঝাপিয়ে পড়তে যাবো; ঠিক সে মুহূর্তে চিশতী আমাকে ঝাকাঝাকি করে উঠিয়ে ফেলে বলল- এই ব্যাটা অলস! আর কত ঘুমাবি? বিকালে না স্নো পরিষ্কার করার কথা? লালা ফেলে বালিশটা করছিস কি রে বুকা..! শিগগির ওঠ!
আমি মোটা জ্যাকেট গায়ে, বেলচা হাতে বাইরে বের হয়ে আসি..
অটোয়া, কানাডা