বাচ্চাদের হুযুর যখন অনলাইনে কোরআন শেখায়; তখন মোবাইলের স্পিকারে উচ্চশব্দে ভেসে আসে পাখিদের কিচিরমিচির। বাসায় একটা ভিন্ন পরিবেশ সৃষ্টি করে। বেশিরভাগই দোয়েল পাখির ডাক আর মাঝেমধ্যে ছোট বাচ্চাদের মধুর কন্ঠ। এতো দোয়েল এখনো গ্রামে-গঞ্জে টিকে আছে? কি মিষ্টি তাদের গলা! ঠিক যেন বাসার পাশ থেকেই আসছে; এতোটা নিখুঁত আর জীবন্ত। অটোয়ায় তখন রাত, বাংলাদেশে সকাল।
স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসে- ডানপিটে চড়ুইগুলো বরই গাছে ধরাধরি খেলছে। শিমুল গাছের ডালে বসা শালিক আর উজ্জ্বল গাঢ় বেগুনি মৌটুসী ফুল ঠুকরে ভেতর থেকে মধু চুষে খাচ্ছে। বিড়াট মেহগনি গাছে বসন্ত বাউরি মূর্তির মতো বসে কিজানি ভাবছে। নীল আর লালচে স্কার্ফ পরা, কলাপাতা সবুজ সিল্কের শাড়ী গায়ে। হয়তো সে ভুলেই বসে আছে; তাকে মরমী গানের অনুষ্ঠানে যেতে হবে।
ওদিকে ভাত শালিকেরা উঠোনে নিশ্চিন্ত মনে খেলছে; কেউ কর্কশ কণ্ঠে বাধিয়ে দিয়েছে তুমুল ঝগড়া। কেউবা কেঁচো-মাকড় খুঁড়ে বের করতে ব্যস্ত। পাতাবাহার গাছের পাতায় লুকিয়ে আছে ছোট সবুজাভ-ধুসর টুনটুনি পাখি। তারা মানুষের চোখ এড়িয়ে চোরের মতো বাসায় আসা-যাওয়া করে। বাসাগুলো একদম মানুষের হাতের নাগালে। টিকটিকির ডিমের মত ছোট্ট, সবুজাভ ডিম। ছোট্ট আর আদুরে হবার কারনে তাদেরকে চরম মূল্য দিতে হয়। জীবন কাটে মহা অনিশ্চয়তার মাঝে।
আর খালের ধারে কচুরিপানার মধ্যে ডাহুকগুলো খুব সতর্ক। ছোট মাছ নড়েছে কি মরেছে। বিদ্যুৎ বেগে ছোবল মেরে তুলে নেবে অব্যর্থ নিশানা! বিলে ফুটে থাকা শত শত শাপলা, পদ্ম ফুলের মাঝে ঝাঁকে ঝাঁকে পাতি হাঁস, পরিব্রাজক পাখিদের মেলা। জল ময়ূরদের আনাগোনা। চোখে কাজল দেয়া কি অসম্ভব রূপবতী এই জল ময়ূর! খয়েরি সিল্কের শাড়িতে সাদা পাড় দেয়া, হলুদ রঙের স্কার্ফ পরা; রঙের কি কম্বিনেশন! স্মার্ট আর আধুনিতার ছোঁয়া তাদের রুচিতে। আর ছোট্ট হলুদ পাখিগুলো আমগাছে চিরুনিসদৃশ কমলা-হলুদ পরগাছা ফুলে লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত। সজনে পাতার নরম পরশে পালক ছোঁয়াবে আরামে।
ওদিকে বাড়ির পেছনে রাগি কোকিল আর কানাকুয়াদের মনোমালিন্য করতে করতেই দিন শেষ। বাচ্চা মানুষ করাতেও নেই তাদের কোনো আগ্রহ। কাকের বাসায় ডিম পারা হয়ে গেলে যেন দায়িত্ব শেষ।। সমস্যা তৈরি হয় ডিম ফুটে বাচ্চা বের হবার পর। আর বাড়ির ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখিদের বাসা বানানো যে কতো কঠোর পরিশ্রমের কাজ! তার মাঝেই সময় বের করে চলে প্রেম-ভালোবাসা, ধরাধরি খেলা, গানের আসর জমিয়ে গলা সাধা।
কৃষকেরা নতুন জমি তৈরিতে, কিংবা আগাছা দমনে ব্যস্ত। কেউ আবার কাদা খন্ড তুলে আইল মেরামতে মনোযোগী। বীজতলা খুব স্পর্শকাতর; খুব যত্ন নিতে হয়। হঠাৎ দূরে বিরাট সারস পাখিগুলো বিমানের মতো ল্যান্ড করছে খোলা প্রান্তরে। আবার রান করে উড়েও যাচ্ছে। লাল ঠোঁটে গাড় লিপ্সটিক দিয়ে রঙিন শাড়ি পরা মাছরাঙাগুলো রূপ দেখিয়ে মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। হঠাৎ আবার নিস্তব্ধতাকে খানখান করে ভেঙে দিয়ে ডেকে উঠে বিরাট ঠোঁটের বুড়ো ধনেশ।
এসব খেটে খাওয়া কৃষকদের মাঝে নিশ্চয়ই কিছুটা প্রশান্তি এনে দেয়? দোয়েল পাখির গান তাদের মনের দুঃখ ঘুচাতে চায়? গ্রাম-বাংলার জীবনের সাথে পাখিদের সখ্যতা আজীবনের। এ বন্ধন কখনো ছিঁড়বার নয়।
বারো হাজার কিলোমিটার দূরে বসে বাংলাদেশের পাখির কলতানে কান পেতে থাকি, তাদের ভাষা বুঝতে। বুক ভরে ধানক্ষেতের বাতাসে শ্বাস নেবার চেষ্টা করি। প্রাণ ভরে সৌরভ নেবার চেষ্টা করি সোঁদা মাটির গন্ধ। রক্তের প্রতিটা কোষ হন্য হয়ে খোঁজে ভোরবেলার শিউলি ঝড়ানো বাতাস, হলদে দুপুরে আম-কাঁঠালের শীতল ছায়া, রাতে তারাভরা আকাশের নিচে হাস্নাহেনার গন্ধে মাতানো নিরিবিলি উঠোন।
হঠাৎ বাস্তবতায় ফিরি।
বাইরে তাকিয়ে নির্লিপ্ত মনে চেয়ে থাকি ধবধবে সাদা পুরু বরফে ঢাকা শান্ত প্রকৃতি, প্রতিবেশী বাসাগুলোর দিকে।
বৈচিত্র্যের বড্ড অভাব।
অটোয়া, কানাডা