-8.2 C
Toronto
বুধবার, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫

বদলে গেছে পৃথিবী

বদলে গেছে পৃথিবী
বদলে গেছে পৃথিবী

কলমে কালি ফুরিয়ে গেছে। এখন বড় খশখশে আমাদের তৃষ্ণা। কালির অভাবে রোলটানা খাতা যেমন সূর্য দীঘল বাড়ি। শূন্য, ফাঁকা। আমাদের মধ্যে এখনো অনেকেই তেমনি নিঃসঙ্গ। আমাদের অনেকের অলেখা পাতায় পড়ে আছে শুধু দাড়ি কমা সেমিকোলন। নেই কোন চিহ্ন কিংবা গোলাপ ফুলের পাপড়ি। বাস্তবতা হলো এক সময় আমাদের সকলের খাতায় থাকতো রূপক নামে ডাকা কোন এক টান পাখির বৃত্তান্ত।

এখন বদলে গেছে পৃথিবী। কাগজ কালীর সম্পর্ক অনেকটা কলের গানের মতো। ধরে এনে বসাতে হয়। কিছুক্ষণ পরপর দম দিতে হয়। অথচ কাগজ কলম কালি ছাড়া আমাদের যুগে চলতোই না। বুকে ভাঁজ করা কাগজ, পকেটে কাগজ। বইয়ের ভাঁজে ছিল কাগজ। কাগজ মানে শুধু সাদা কাগজ নয়, আঁকিবুঁকি কাগজ কিংবা তাতে থাকতো ভরপুর স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ।

- Advertisement -

আমাদের যুগের ছাপ ছিল  ‘কথা না বলা কথা’। আমাদের যুগ বলি কেন, বলা উচিৎ আমাদের যুগের আগের যুগও ঠিক এরকম ছিল এবং আমরা তার শেষ বংশধর। তা নাহলে কবি লিখতেন না ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলে’।

আমাদের সময়কার, কথা না বলার কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছিল সাহিত্য ভাণ্ডার। আমরা বয়সের এক বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু অপেক্ষা করতাম। কোন কাজ নেই, কোন চাওয়া-পাওয়া নেই শুধুই অপেক্ষা এবং ক্ষণিক দেখার সাধ। আমাদের অপেক্ষাগুলো ছিল নি:শ্বাসের চেয়েও ছোট। অথবা খুব বেশি বড় হলে পলকের মতো দীর্ঘ। হাত চিঠির ওপর রূপকথার একটি নাম লিখতে গিয়ে আমাদের কারোর কারোর হাত কেঁপে উঠত সুখ অনুভূতিতে। আমাদের মধ্য কেউ কেউ  সন্ধ্যা হবার আগে ছাদে চলে যেত বোনের ছোট্ট শিশুকে কোলে নিয়ে। যেখানে অপেক্ষা করতো বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র চিরকুট হাতে।

আমাদের মধ্যে কেউ কেউ মধ্য দুপুরে জানালার পাশে এসে দাঁড়াত সাইকেলের ঘণ্টি শুনে। আবার জানলার কাছে এসেই অনেক সাইকেল আরোহীর চেন পড়ে যেত। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রাত জেগে পাশের বাড়ির বন্ধ জানালার দিকে চেয়ে থাকতো সিগারেট হাতে নিয়ে। কেউ আবার স্কুল থেকে এসেই বিকেলে দাঁড়াত প্রিয় বারান্দায়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ রোকেয়া হলের গেটে দাঁড়িয়ে মগরেবের আজান পর্যন্ত অহেতুক ঝালমুড়ি খেত। কেউ আবার প্রাইভেট শিক্ষকের জন্য চা বনিয়ে আনত দু চামচ অতিরিক্ত চিনি মিশিয়ে।

এমনই ছিল আমাদের পাথর কাঁটা যুগ। আমরা সভ্যতা গড়েছিলাম অপেক্ষার ইট পাথর দিয়ে। মোদ্দা কথা সে সময় আমাদের মধ্যে একটা টান ছিল। দুটি মানুষের মাঝে ছিল অনেক না বলা কথা। অধিকার বিহীন সম্পর্ক। অথবা সম্পর্ক নেই তবুও অপেক্ষা করার অভ্যাস ছিল আমাদের। অনেকে বলে না, বিনে সুতোর মালা, ঠিক তাই।

এ যুগের মতো এতো কথা বলে, কথা বলা হতো না আমাদের। কোন কিছু না বলেই গেছে বছর পাঁচেক। কারোর বা মাসের পর মাস। আমাদের সময় মনের কথা প্রিয়জনকে বলতে গিয়েও ফিরে এসেছে অনেকে। বলে দিলে তো বলা হয়ে গেল, সেটাও মনে করত অনেকে। আমাদের যুগে প্রিয় মানুষকে অনেকেই আপনি করে বলতো। কই! আপনি তো কোনদিন এসবের কিছুই বলেন নি, এমন কথা শোনার ভাগ্য হয়েছে অনেকের। কিন্তু জাহাজ তো অনেক দূর চলে এসেছে। আবিষ্কৃত না হয়ে কিংবা অনাবৃষ্টির কারণে ধুসর হয়ে আছে অনেক অতীত। যতোটা হারাবার, তার থেকে না পাবার বেদনায় অনেকের চোখ আজও লাল।

আমাদের যুগে প্রচণ্ড একটা টান এসে ছিঁড়ে দিতো আলতো টানের টানাটানি। ঠিক তখনই মুখে মুখে শোনা যেত শরৎ বাবুর উপন্যাসের নাম। ‘দেবদাস যুগ’ বুঝি চলেই গেল। অথচ জিজ্ঞেস করে দেখেন। আমাদের যুগের অনেকের ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিন কাঁটা ঘুড়ির মত দুলছে। যাদের অনেকের ছিল প্রিয় একটা – টান পাখি।

আজ কলম নেই কারোর পকেটে। কালিও নেই কলমে। বুকে করে রাখতো যারা একখানা চিরকুট এমন মানুষগুলো পৃথিবীর নানান দেশে এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

কিছু কিছু তৃষ্ণা আছে যা কখনো মেটে না। তাই বলছিলাম, এক গ্লাস পানি পেলে ভালো হতো। ছুঁয়ে দেখতাম। যে পানি সকলকে শীতল করে সে কতোটা নাতিশীতোষ্ণ। কিংবা সে কি আমার মতো। তোমার মতো। না আমাদের অন্য কারোর মতো। যে পাত্রে যায়, তার মতো হয়ে পড়ে।

আমি হেঁটে হেঁটে কমিয়ে এনেছি পথ। সে যেন ফিরে এসে একবার বসে থাকে নাতিশীতোষ্ণ কুটিরে। কোন কথা না বলে। শুধু চোখে চোখ রেখে, রাতজাগা পাখি হয়ে। আমরা ফিরে যাব অপেক্ষার যুগে। বলবো, ভোর হয়ে এলো, একটুকরো কাগজ দাও, লিখে দেই প্রিয় সর্বনাম।

 

স্কারবোরো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles