মন ফ্রেশ করার মোক্ষম উপায় হলো বিকেলে হাঁটতে বের হওয়া। আর মাথায় যদি থাকে কোন প্রিয় গানের কলি, তাহলে সোনায় সোহাগা। গুনগুন করতে করতে
যেখানে খুশি, যেদিক খুশি চলে যাওয়া যায়। ক্লান্ত হলে ভ্যান কিম্বা রিকশা; তাড়া নেই। শরীরও হয় চাঙ্গা।
হাঁটার উপযুক্ত জায়গা হলো শহরের যান্ত্রিক কোলাহল ছেড়ে একটু আশপাশে যাওয়া। কিছু দূরে চোখে পড়বে বিস্তীর্ণ সর্ষে ক্ষেত, আইলে সারি সারি খেঁজুর গাছ।
কিলোমিটার পরপর রাস্তার মোড়ে ছোট বাজার; মানুষের কোলাহল। ভাগ্য ভালো থাকলে পেয়ে যাবেন সাপ্তাহিক হাট। ঘুরে ঘুরে সদাই, সবজি, মাছ দেখা আর মানুষের কর্মকান্ড দেখার চাইতে মজার কিছু নাই। বিকেলবেলার ভাজাভুজি খিদেতে পেয়ে বসবে। মনটা অস্থির হয়ে খুঁজবে গরম সিঙ্গারা, পেঁয়াজু, বেগুনি।
সিঙ্গারা সবচাইতে ভালো হয় যে দোকান হোটেলও না, আবার পুরোপুরি মুদির দোকানও না; সেখানে। ছোট দোকানে একপাশে মুদি, আরেকপাশে রেস্টুরেন্টে। কড়াইয়ে ডুবো তেলে ভাজা হয় সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি, বেগুনি। আর থাকে গরম জিলাপি।
এসব দোকান সাধারনত শহরের এক প্রান্তে থাকে। শুধু মুদি কিম্বা খাবার বেচে তাদের পোষায় না। তাই দুই ধরনের বিজনেস। আশপাশে থাকে কিছু ফটোকপি, স-মিল, পোষা পাখি-মাছ আর লোহা লক্করের দোকান। রাত পর্যন্ত চলবে বাসা বাড়ির গ্রিল কিম্বা মেইন গেইট বানানো। এঙ্গেল কাটার ভোঁতা আর টুং-টাং আওয়াজ আর ঝালাই করার ছ্যাঁৎ ছ্যাঁৎ আওয়াজ। স’মিলের কাঠ ফাঁড়ার আওয়াজ। কাঠের গুঁড়োর কাঁচা গন্ধ।
এরা খুব যত্ন নিয়ে খাবার পরিবেশন করে। বেচা বিক্রি কম; হাতে প্রচুর সময়। আতিথেয়তায় কার্পণ্য করে না। পাতলা টিনের হাফ প্লেটে সিঙ্গারা-পুরির সাথে কাঁচা পেঁয়াজের পাতলা কুঁচি, মিষ্টি শসা আর ফাইনালি উপরে ছিটিয়ে দেবে বিটলবণ মেশানো চাট মসলা। সাথে আমড়ার টক। ভাজা সিঙ্গারার বাষ্পের সাথে মিশে তৈরী হবে অসাধারণ খিদে ধরানো আবেদন, আবেশ। মুখ পুড়ে পুড়ুক; তৎক্ষনাৎ ভরা চাই।
খুব ভালো ব্যাবহার করে আদর-যত্নে খাওয়াবে। গ্লাস ভালো করে ধুয়ে টিউবয়েল থেকে ফ্রেশ পানি নিয়ে আসবে। খাবারের এতোই স্বাদ, বাধ্য হয়ে আপনাকে আরেকদফা নিতেই হবে। সিঙ্গারার ভংগুর চামড়ায় দেখা মিলবে কিছু কালোজিরা। পাঁচফোড়ন মেশানো আলুর মধ্যে থাকবে ধনিয়া পাতা, কিছু চীনা বাদাম। স্বাদ বাড়িয়ে দেবে কয়েকগুন। সন্তুষ্ট হয়ে প্লেট শেষ করার পর অর্ডার দেবেন চারটা আগুনগরম জিলাপি। এতোই রস রে বাবা; কামড় বসানোর পর গরম রস ছিটকে জামার বারোটা বাজাবে।
দোকান থেকে উঠতেই মন চায় না। মনে হয় বেঞ্চে আরও কিছুক্ষন বসে রাস্তার লোকজনের চলাচল দেখি, ছাগল-কুকুরের কান্ডকারখানা দেখি। শেষ পর্যায়ে দোকানদার খুব বিনীত গলায় বলবে, স্যার চা খাবেন?
– আছে?
– আইনা দিতাছি
– টাকা নিয়ে যাও?
– একবারে দিলেই হবে।
চলে আসবে ছোট্ট কাঁচের গ্লাসে ঘন করে জ্বাল দেয়া দুধের মধ্যে খড়ি পোড়া গন্ধ মেশানো অবিশ্বাস্য নেশা ধরানো চা। প্রতিটা চুমুক মন ভালো করে দেবে। আরেক কাপ খেতেই হবে। হাজার খেয়েও ষাট-সত্তর টাকার বেশি বিল তোলা যায় না।
তারা হাসি মুখে বিদায় দেবে।
খুব অমায়িক। আবার আসতেই হবে। ভালবাসা অস্বীকার করা কঠিন।
মনে পড়বে বাজারে যাবার কথা। মায়ের জন্য ওষুধ আনতে হবে ফার্মেসি থেকে।
পায়ে চালানো ভ্যানের পেছনে খালি সিটে চলন্ত অবস্থায় টুক করে উঠে পড়বো পা ঝুলিয়ে। পাশে চেয়ে দেখবো কোনো ফেরিওয়ালা চাচা তার ঝুড়ি ধরে রেখেছে বুকের মাঝে। ব্যবসা শেষে বাসায় যাচ্ছে; হয়তো গড়াই নদী পার হয়ে হরিপুরে যাবে।
ততক্ষণে সারা শহর বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করে উঠবে। ঐ দূরে ছয় রাস্তার মোড়ের জামে মসজিদের দিকে দ্রুত হাঁটা শুরু করবে বেশ কিছু মানুষ। দোকানে দোকানে জ্বলে উঠবে ধুপ, আগরবাতি, মশার কয়েল।
আমি ওষুধ পকেটে নিয়ে ফিরতে থাকবো পায়ে হেঁটে।
নিজ শহর মানেই মুগ্ধতা, স্বাধীনতা, ভালোবাসা, তৃপ্তি।
আর খুব মায়া!
অটোয়া, কানাডা