0.2 C
Toronto
বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

অন্যের অ্যাকাউন্টে লেনদেন হাসিনা-রেহানার সন্তানদের

অন্যের অ্যাকাউন্টে লেনদেন হাসিনা-রেহানার সন্তানদের
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা

আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল হিসেবে পরিচিত সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) নেতৃত্বে রয়েছেন গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার বোন শেখ রেহানার ছেলে-মেয়েরা। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ভাইস চেয়ারম্যান এবং শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। আর শেখ পরিবারের বাইরের একমাত্র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার ছেলে-মেয়েরা সিআরআইয়ের নেতৃত্বে থাকলেও পাঁচটি স্থায়ী আমানতের (এফডিআর) হিসাব খোলা হয় প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন শেখ শের-এ-আজাদ শামসের নামে। গণঅভ্যুত্থানের চার মাস পর গত ১২ ডিসেম্বর মাহফুজুর রহমান নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে সিআরআইয়ের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে থাকা ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৮ টাকা উত্তোলনের চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সিআরআইয়ের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনের চেষ্টা এবং চাঁদাবাজি, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন জমার জন্য দুদকের বিশেষ তদন্ত শাখাকে দায়িত্ব দিয়েছে কমিশন। শিগগিরই অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে।

এ প্রসঙ্গে দুদকের দুজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, সিআরআইয়ের অনুকূলে বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন অনিয়ম এবং দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ অনুসন্ধান হচ্ছে। অনুসন্ধানে যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত থাকার তথ্য-প্রমাণ মিলবে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

- Advertisement -

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে যাত্রা শুরু হলেও সিআরআই ট্রাস্ট ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয় থেকে অনুদান গ্রহণের পাশাপাশি বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের একটি টিম গত ৪ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (নতুন ১১) রোডের ২ নম্বর বাড়িতে সিআরআইয়ের অফিস হিসেবে উল্লিখিত ঠিকানায় অভিযান পরিচালনা করতে যায়। কিন্তু ওই ঠিকানায় গিয়ে সিআরআইয়ের অফিসের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

সেদিন ওই অভিযান চলাকালে দুদকের সহকারী পরিচালক রাজু আহমেদ সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিআরআইয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় বা ক্ষতিসাধন করা হয়েছে কি না সেটা যাচাই করতে এখানে এসেছি। ধানম-ির কয়েকটা জায়গা ঘুরেও সিআরআইয়ের অফিস খুঁজে পাইনি। আমরা প্রাথমিকভাবে তথ্যগুলো সংগ্রহ করার চেষ্টা করছি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযানে আসছি। ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে আমরা সেটা জেনেছি। সেই তথ্য যাচাই করতে ব্যাংক স্টেটমেন্ট সংগ্রহের প্রক্রিয়া চলমান।’

অভিযান শেষে ওইদিন বিকেলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সিআরআইয়ের ধানমন্ডির অফিসে অভিযান পরিচালনা করতে যায় দুদক টিম। তারা অভিযানে গিয়ে ধানমন্ডির অফিসের কোনো অস্তিত্ব পায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নামে আইএফআইসি ব্যাংকে থাকা ৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকার এফডিআরের ডকুমেন্ট উদ্ধার করেছে।’

দুদকের তথ্য অনুযায়ী, দুদকের এনফোর্সমেন্ট ইউনিট তাদের অভিযানে পাওয়া ফলাফল ও নথিপত্র যাচাই-বাছাই করে অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ পেয়ে এ বিষয়ে প্রকাশ্য অনুসন্ধান শুরুর সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে। এরপরই কমিশন ওই প্রতিবেদন আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়।

দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়েছে, ‘যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে সিআরআইয়ের কোনো নিবন্ধন নেই। তবে ২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে একটি চুক্তির মাধ্যমে সিআরআই প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর জুন মাসে ধানমন্ডিতে সিআরআইয়ের প্রোপাগান্ডা দপ্তর খোলা হয়। প্রতিষ্ঠানটির অফিশিয়াল ঠিকানা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (নতুন ১১) রোডের ২ নম্বর বাড়ি। শেখ হাসিনার ওই গুজব তৈরির কারখানার চেয়ারম্যান ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, ভাইস-চেয়ারম্যান মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য তার বোন রেহানার ছেলে ববি ও মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক। শেখ হাসিনা ও রেহানার ছেলে-মেয়ের বাইরে একমাত্র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। আর সাক্ষী হিসেবে আছেন মোহাম্মদ শাহরিয়ার আলম, মো. আবুল হাসেম ও মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন।’

অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তখন থেকে সিআরআইয়ের অফিস বন্ধ রয়েছে। সিআরআইয়ের প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানার ছেলে-মেয়ে হলেও ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন শেখ শের-এ-আজাদ শামসের নামে। তিনি গণঅভ্যুত্থানের চার মাস পর গত ১২ ডিসেম্বর সিআরআইয়ের নামে ব্যাংকের এফডিআরের ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৮ টাকা নগদায়নের (উত্তোলন) জন্য মাহফুজুর রহমান নামে এক ব্যক্তিকে নমিনি মনোনীত করে ব্যাংক ব্যবস্থাপককে (ম্যানেজারকে) চিঠি দেন।

ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘আমি শেখ শের-এ আজাদ শামস, এফডিআরের অনুমোদিত স্বাক্ষরকারীদের একজন। আমরা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন-এর পক্ষে বিভিন্ন তারিখে এক বছরের জন্য পাঁচটি স্থায়ী আমানত (এফডিআর) খুলেছিলাম। উক্ত এফডিআরগুলোর ফটোকপি সংযুক্ত করে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো। বর্তমানে আমাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানে জরুরিভিত্তিতে নগদ অর্থের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে উক্ত এফডিআরগুলো নগদায়ন করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমি নিজে ব্যাংকে উপস্থিত হতে সক্ষম নই। তাই আমি মাহফুজুর রহমানকে (জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর- ১৯৮৫৯১৫৬২৯৮৫৯৫৭৩৩) আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উক্ত এফডিআরসমূহ নগদায়নের জন্য অনুমোদন প্রদান করছি। তার পরিচয়পত্রের অনুলিপি সংযুক্ত করা হলো। তিনি ব্যাংকে উপস্থিত হয়ে প্রয়োজনীয় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবেন। এফডিআর নগদায়নের পর দয়া করে পেমেন্ট অর্ডার (আরটিজিএস/ইএফটি), নগদ অর্থ প্রদান বা অনুমোদিত ব্যক্তির নির্দেশনা অনুযায়ী পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমাদের এই কঠিন সময়ে আমাদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে এফডিআরগুলো নগদায়নে আপনার সদয় সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছি।’

এই চিঠির বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল বুধবার বিকেলে এফডিআরগুলোর মালিক প্রতিষ্ঠানটির হেড অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন শেখ শের-এ-আজাদ শামস এবং তার মনোনীত নমিনি মাহফুজুর রহমানের মোবাইল ফোনে কল করা হলে দুটো নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।

এদিকে, গত ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আইএফআইসি ব্যাংকের ধানম-ি শাখার ম্যানেজারকে সিআরআইয়ের ব্যাংক হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন বা স্থানান্তর স্থগিত রাখতে চিঠি দেওয়া হয়। এনবিআরের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলের উপপরিচালক তোফায়েল আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ‘আয়কর আইন ২০২৩-এর ২২৩ ধারা অনুযায়ী আপনার ব্যাংকে সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (টিন-৫৭৫৯৪১৯১৬৩০৪) করদাতার নামে পরিচালিত সব হিসাব থেকে অর্থ উত্তোলন ও স্থানান্তর স্থগিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হলো। স্থগিতাদেশ তাৎক্ষণিক কার্যকর করে হিসাবের সর্বশেষ স্থিতি উল্লেখসহ এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।’

ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আইএফআইসি ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় সিআরআইয়ের নামে একটি সেভিংস (সঞ্চয়ী) হিসাব ও পাঁচটি স্থায়ী আমানত (এফডিআর) রয়েছে। চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব ব্যাংক হিসাবে ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৮ টাকা ৩৪ পয়সা স্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে সঞ্চয়ী হিসাবে ২ কোটি ৬ লাখ ৩৯০ টাকা ৮৪ পয়সা এবং পাঁচটি এফডিআরে ৩৩ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার ১৮৭ টাকা ৫০ পয়সা রয়েছে। ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত এসব অর্থ জমা হয়েছে।

অলাভজনক ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগের গবেষণা সেল হয়ে কাজ শুরু করে সিআরআই। আওয়ামী লীগ সরকারের হয়ে দেশের জনগণের চিন্তার জগৎকে যান্ত্রিক উপায়ে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ২০১০ সালে কাজ শুরু করে সিআরআই। প্রতিষ্ঠানটিতে বিদেশে প্রযুক্তিজ্ঞানে উচ্চপ্রশিক্ষিত একঝাঁক অভিজ্ঞকর্মী, সাবেক আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগের নেতা-মন্ত্রীদের বিদেশে থাকা ছেলে-মেয়েরা কাজ করতেন। এ প্রতিষ্ঠান মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করত, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফেসবুক পেজ, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, মেসেঞ্জার গ্রুপ, ব্লগ ও ভিডিও কনটেন্ট ইত্যাদি। ‘লেটস টক’ এবং ‘জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড’-এর মতো কিছু অনুষ্ঠান করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles