
ছুটি নিয়েছিলাম গাড়ি মেরামত করবার জন্য।
মেরামত হয়ে গেলে হঠাৎ কি মনে ছুটলাম হসপিটালে; এ সুযোগে ডাক্তার দেখানো হলে সময়টা কাজে লাগবে। অটোয়ায় আমাদের ফ্যামিলি ডাক্তার নাই। সারা কানাডা জুড়ে ডাক্তারের জন্য হাহাকার। ইমার্জেন্সীতে শুধু বড়ো নয়, ছোট সমস্য নিয়েও যাওয়া যায়; কারন ফ্যামিলি ডাক্তার না পেলে এ ছাড়া উপায়ও নাই। সেখানে অসুখের গুরুত্ব আর ক্যাটাগরী হিসাবে ট্রিট করবে। যেমন- হার্ট এটাক হলে সাথে সাথে চিকিৎসা করবে, হাতে ব্যাথা নিয়ে গেলে বেশ কয়েকঘন্টা বসিয়ে রাখবে।
বিকাল চারটা থেকে হসপিটালের ইমার্জেন্সীতে অপেক্ষা করতে থাকি। এক ঘন্টা যেতে না যেতেই দখিনার ফোন- বাবা, ডাক্তার দেখাইছো?
– না, অপেক্ষা করছি
– আর কতক্ষন?
– এক ঘন্টাও লাগতে পারে, চার ঘন্টাও লাগতে পারে..
– আমি সাথে থাকলে তোমার সময় কাটতো। আচ্ছা বাবা, ফোন দিবা। আই লাভ ইউ!
সময় কাটানো আমার জন্য অবশ্য কোনো সমস্যা নয়। বরাবরের মতোই লিখতে বসে গেলাম। সমস্যা হলো, দুই ঘন্টার মধ্যে মোবাইলের চার্জ হয়ে গেল পঞ্চাশ পার্সেন্ট। ব্রাইটনেস কমিয়ে রাখলাম। আবার মেয়ের ফোন- বাবা, ডাক্তার দেখাইছো?
– না
– এখন সাতটা বাজে তো!
– আমার তো তেমন কিছু হয়নি, তাই লেট করে দেখবে
– তাই বলে তিন ঘন্টায়ও হবে না?
– কিচ্ছু করার নাই। রাখি
– তোমার সাথে কথা বলা যাবে না?
– মোবাইলের চার্জ কমে যাচ্ছে
– আর কতটুকু আছে?
– পঁয়তাল্লিশ পার্সেন্ট
– তাহলে রাখো। লাভ ইউ!
ভিড়ের মধ্যে চোখাচোখি আর মোবাইল টেপা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। একজন উঠে গেলে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকজন এসে বসে পড়ছে। প্রায় সত্তর-আশিজন তো হবেই। চার ঘন্টা হয়ে গেল। আহা, কত মানুষের নাম ডাকছে! একজন কর্মী এসে “মিস্টার ইসলাম” বলে ডাকাডাকি করতে লাগলো। পনেরো মিনিট পর আবার এসে ডেকে পেলো না। মনে হয় রুগী হতাশ হয়ে চলে গেছে বাসায়। আবার, ইকবাল কে ভুলে ইসলাম ডাকছে না তো? এরকম হয়েছিল টরন্টো ফ্যামিলি ডাক্তারখানায়। এসিস্ট্যান্ট ‘ইসলাম’ বলে দুইবার করে ডেকে গেল। আমার সন্দেহ হওয়াতে জিজ্ঞেশ করেছিলাম, দেখেন তো আমার সিরিয়াল কতদূর? সে চোখ কপালে তুলে বলেছিল- আপনাকে তো একটু আগেই দু’বার করে ডাকা হলো, কোথায় ছিলেন!
খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে।
কাউন্টারে জিজ্ঞেস করে জানলাম আমার সামনে আর দশজন আছে। ঘন্টাখানেকের বেশি লাগবে।
হসপিটালের ভেতরে টিম হর্টন্স কফি শপে গিয়ে মাফিন আর কফি নিয়ে লাউঞ্জে বসে খেতে থাকি। মেয়ের ফোন- বাবা , তুমি কি এখনো হসপিটালে?
– আরও মিনিমাম দুই ঘন্টা তো লাগবেই! তুই ঘুমায়ে পড়
– এটা ফেয়ার না আব্বু! চার্জ কতটুকু?
– বিশ পার্সেন্ট
– কিছু খাইছো?
– খাচ্ছি। মাফিন-কফি
– আচ্ছা, লাভ ইউ!
আমার ডাক পড়ল ছয় ঘণ্টা পর।
নিয়ে যাওয়া হলো কেবিনে। সেখানে পর্দা দিয়ে আড়াল করা চারটা বেড। কেবিনে প্লাস্টার করার সামগ্রী রাখা। তারমানে হাড়-ভাঙা কেবিনে রাখছে। সময় যাচ্ছে না। লেখালেখি বন্ধ, চার্জ শেষ হবার ভয়ে। এক ঘন্টার মতো বেডে বসে থাকার পর একজন কর্মী এসে কম্বল দিয়ে গেল। এর মানে ক? ঘুমাতে বলছে? সারা রাত থাকতে হবে? রাত বারোটা বেজে গেছে।
যা হয় হোক; বিসমিল্লাহ বলে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। পনেরো মিনিটও ঘুমাইনি। হঠাৎ হট্টগোলের মধ্যে ঘুম ভেঙে গেলো। পাশের বেডে ইএমএস এর লোকজন স্ট্রেচারে করে হাড়ভাঙ্গা রুগী নিয়ে এসেছে। রুগীকে জাগিয়ে রাখার জন্য তারা টুকটাক গল্প করে যাচ্ছে। ছেলেটা হয়তো হাই স্কুলে পড়ে। আইস হকি খেলতে গিয়ে পায়ের গোড়ালি ভেঙে ফেলেছে বেশ খারাপভাবে। ওরা ছেলেকে রেখে চলে গেলো। একজন নার্স এসে দেখে যাচ্ছে। ছেলেটা ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে পূর্বে দেয়া ব্যাথানাশক ওষুধের ধক শেষ হয়ে আসছে।
সে তার বন্ধুদের ফোন করা শুরু করে দিলো। মোবাইল স্পিকারে দেয়া; তাই সব কেথা শোনা যাচ্ছে। কাজ নাই তো খৈ ভাঁজ; পরের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছি। প্রচন্ড শক্ত তার নার্ভ। তার কথার ধরণ অনেকটা এরকম- দোস্ত, আমি হসপিটালে
– কি হইছে?
– পা ভাঙছি ফা.. (এফ ওয়ার্ড) বলে কঁকিয়ে উঠলো
– ফা.. (এফ ওয়ার্ড)। কীভাবে ভাঙলি?
দুজনের খোশ গল্প শুরু হয়ে গেলো। যেন পা ভাঙার মতো বীরত্বের কাজ দুনিয়ায় নাই। যার হাত পা ভাংগে নাই, তার জীবনটাই বৃথা।
আরো কয়েকজনের সাথে আলাপ চলল। ফোনের ওপাশ থেকে সবাই নির্লিপ্তভাবে কথা বলে যাচ্ছে, শান্তভাবে। একজনও উত্তেজিত বা উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল না- “ওমা, কি সর্বনাশ, কীভাবে হলো!”
এবার তার মায়ের ফোন আসাতে বন্ধুরটা কেটে দিলো। তার মা আরো শান্ত, নিচু গলায় যেন কিছুই হয়নি; এভাবে শুধু বলল- আমি রাস্তায়, আসতেছি; মিনিট বিশেক লাগবে।
তাকে নিয়ে যাওয়া হলো এক্সরে রুমে। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে যন্ত্রনায় কাতরাতে লাগলো। তার হাতজোড় অনুরোধে ডাক্তার এসে মরফিন দিয়ে গেলো। শান্ত হতে বেশ কয়েকমিনিট লেগে গেলো। আবার সব শান্ত। তার মা এসে হাজির। মা কে দেখে ছেলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বাচ্চা মানুষের মতো। শক্ত নার্ভের সিংহ হয়ে গেলো ভেজা বেড়াল!
হায় রে, মা কি জিনিস!
মায়ের কাছে সন্তান সবকিছু সপে দেয়। সেখানে থাকে না কোনো মিথ্যে অহংকার, গোপনীয়তা, হঠকারিতা। সত্যিকার ভালোবাসার কাছে সবকিছু হার মানতে বাধ্য। বোঝা যাচ্ছে মা তার ছেলের ঘেমে যাওয়া শরীর পরম আদরে মুছে দিচ্ছে, গায়ের কম্বল ঠিক করে দিচ্ছে।
কিছুক্ষনের জন্য চোখ বুজেছিলাম। হঠাৎ ডাক্তার আসলো। সাথে এসিস্ট্যান্ট, একটা আল্ট্রাসনো মেশিন নিয়ে। আমার লিম্ফ নোড স্ক্যান করে বলল, তোমাকে এখানে কে আসতে বলছে?
– কেউ না, আমি নিজে এসেছি। সন্দেহ হচ্ছিলো খারাপ কিছু, সেজন্য
– তোমার কিচ্ছু হয় নাই। হয়তো কোথাও ইনফেকশন হয়েছে। শরীরের লিম্ফ নোড ফুলতেই পারে। পরবর্তীতে এসব ক্ষেত্রে তুমি ফ্যামিলি ডাক্তারের কাছে যেও
– অটোয়া তে ফ্যামিলি ডাক্তার নাই। টরন্টোতে তে আছে
– ওখানেই দেখিও। টরন্টো যাও না?
– যাই.. খুব কম। দু-তিন মাস পরপর
– তারমানে ভালোই তো যাওয়া হয় [বলে মেশিনপত্র গুটিয়ে চলে যেতে লাগলো]
– আমি কি চলে যাবো?
– তোমার ইচ্ছা..
এদেশের ডাক্তার বা নার্স কখনোই সরাসরি বলে না যে বাসায় চলে যাও।
এখানকার সাস্থ্য ব্যাবস্থার প্রধান আর ভালো দিক হলো কারও পয়সা থাকুক বা না থাকুক, সবাই সমান চিকিৎসা পাবে। ধনী-গরীব সবাই সমান। বেশিরভাগ চিকিৎসা ফ্রি, যত টাকাই লাগুক।
বর্তমানে এদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা বেশ খারাপ। দিনকেদিন আরও খারাপ হচ্ছে। কারণটা হলো ডাক্তার সঙ্কট। অনেক ক্যান্সারের রুগীকেও মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় অপারেশনের সিরিয়াল পাবার জন্য। কারও মেটাস্টাসিস হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বেশি দেরি সহ্য করতে না পেরে আশপাশের দেশে যাচ্ছে চিকিৎসা নিতে। অপেক্ষমান এ সময়টাতে জটিল রুগী আর তার পরিবারের মানসিক অবস্থা কেমন দাঁড়ায়, সেটা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানে। তবুও আমি আর আমার পরিবার এদেশের চিকিৎসার ওপর মারাত্মক কৃতজ্ঞ। আমার গিন্নি ক্যানসারকে পরাজিত করে থার্ড স্টেজ থেকে এখন পুরোপুরি ক্যান্সারমুক্ত। ডাক্তারদের কি অসাধারণ প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা, ধৈর্য্য! এদেশে এসে আমাদের প্রাপ্তিটাই বেশি!
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাসার দিকে এগোতে থাকি। রাস্তা ফাঁকা। স্পিড বাড়িয়ে দেই। রাত তখন দেড়টা বাজে।
হায় কানাডা!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে..
অটোয়া, কানাডা