
বুদ্ধদেব বসু আড্ডা শব্দটির বিশ্লেষণ করেছেন এভাবে- আওয়াজটা অসংস্কৃত- মুসলমানি। যদি ওকে হিন্দু করে বলি সভা, তাহলে ওর কিছুই থাকে না। যদি ইংরেজি করে বলি পার্টি, তাহলে ও প্রাণে মরে। আড্ডা জিনিসটা সর্বভারতীয় কিন্তু বাংলাদেশের সজল কালো মাটিতেই তার পূর্ণবিকাশ। আমাদের ঋতুগুলি যেমন কবিতা জাগায় তেমনি আড্ডাও জমায়।”
বাঙালি আড্ডাপ্রিয় জাতি। বিদেশে আমাদের আড্ডায় পাব কিংবা ক্লাব কালচার গড়ে না উঠলেও সামাজিক আড্ডা জমজমাট। ক্রিসমাসের এই অখন্ড অবসরে দলে দলে বিভক্ত হয়ে চলে এই সামাজিক আড্ডা।
প্রত্যেক আড্ডার একটা স্বাদ আছে, গন্ধ আছে, আবহাওয়া ও চরিত্র আছে। সব আড্ডায় রাজনৈতিক আলোচনা হয়। আড্ডায় অসহিষ্ণু আড্ডাবাজের কারনে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পাশাপাশি পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। প্রত্যেক আড্ডাধারীর উচিত আড্ডার আবহাওয়া ও চরিত্রকে ধরে রাখা। আড্ডায় পাঁচজন লোক আসলে পাঁচরকম কথা হবেই। তবে সবার উচিত এই পাঁচ কথা যাতে এক পথে এসে মিলিত হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা।
পুরো কানাডা জুড়ে এখন ক্রিসমাসের বন্ধ। এই অখন্ড অবসরে তাদের অন্যতম বিনোদন আড্ডা। তাদের আড্ডা জমে মুলত পাব এবং ক্লাবগুলোতে। তাদের সামাজিক আড্ডা নেই বললেই চলে। পারিবারিক আড্ডায় স্থান পায় পরিবারের নিকটতম সদস্যরা।
আমাদের যেহেতু ক্রিসমাসের ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের তাড়া নেই তাই গতকাল ক্রিসমাসের রাতে আড্ডা বসেছিল দুলাল ভাই নুরজাহান ভাবীর বাড়িতে। কানাডিয়ানদের মতো দু-এক পিস মিট কিংবা টোস্ট, এক পেগ ওয়াইন কিংবা স্যাম্পেন দিয়ে বাঙালির আড্ডা জমে না। আমাদের আড্ডার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ভুড়িভোজ, অবশ্যই তা দেশীয় খাবারে।
গতকালের আড্ডায় দুলাল ভাই নুরজাহান ভাবী যত্ন করে আয়োজন করেছিলেন এই ভুরিভোজের। আমি সাধারণত খাবারের বর্ননা দিতে অভ্যস্ত নই। তারপরও তাদের এই আয়োজনের বর্ননা না দিলে তাঁদের আন্তরিকতাকে অশ্রদ্ধা করা হবে।
ডিনারের স্টার্টারটি গতানুগতিক ছিল না। হাঁসের ভুনা মাংস সাথে চিতই পিঠা আর চা। এরপর আড্ডা, গল্প, রাজনীতিতে গমগম করে ড্রয়িং ডাইনিং। খাবারের মুল কোর্স এর জন্য দুলাল ভাই বরাবরই প্রায় সত্তুর কিলোমিটার দুর থেকে নিয়ে আসেন টানা পরোটা, তার সাথে কাবাব, গরুর মাংসের ভুনা, বারবিকিউ চিকেন। সাদা ভাত পোলাও সাথে আমাদের রাজনৈতিক মাছ ইলিশ, উচ্চ মাধ্যমিকে পড়া ভোরাসিয়াস ওমেনের প্রিয় দামী খাবার এসপারাগাসকে বাঙালি খাবার বানিয়ে ফেলেছিলেন চিংড়ি মাছ দিয়ে, খাসির মাংস দিয়ে বুটের ডাল, বগুড়ার লাল পাকড়ি আলু দিয়ে ভুনা করেছিলেন মুরগীর স্পেয়ার পার্টস, সালাদসহ ডেজার্ট পর্বে ছিল হরেকরকম মিষ্টি, দই ফিরনিসহ শীতের পিঠাপুলি। খাওয়া শেষে পান সুপরি মিষ্টি জর্দা, এ যেন ১২ হাজার কিলোমিটার দুরে থেকেও দেশের কোলে অতিথি আপ্যায়নের ঐতিহ্যবাহী আয়োজন।
শেষ পর্বটা উল্লেখ করবো বলেই এ লেখা। দুলাল ভাই সংগীতপ্রিয় মানুষ। নিজে গান করেন, অন্যকে গান শুনিয়ে আনন্দ পান। সবকিছুর শেষে এসে শুরু হলো তাঁর গান। বলা যায় একক সংগীত রাত। তার সুরের মুর্ছনায় ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গিয়েছিল রাত ১২ টা।
ধন্যবাদ দুলাল ভাই নুরজাহান ভাবী এমন একটি সন্ধ্যারাতকে জমজমাট করে তোলার জন্য।
গুয়েল্ফ, কানাডা