
দেশে প্রতিটি মানুষের মনে হয় পছন্দের একজন ডাক্তার থাকে। পছন্দের ডাক্তার নির্ধারণে রোগীর মনোস্তাত্বিক কিছু কারন আছে। রোগীর প্রতি ডাক্তারের ব্যবহার, আন্তরিকতা, ডাক্তারের রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে এটি গড়ে ওঠে। দেশে থাকতে আমাদের বড় ছেলে অসুখ বিসুখ হলেও সে বলতো – আমাকে ডাক্তার রফিকের কাছে নিয়ে যাও। উত্তরা থেকে ধানমন্ডি ৯/এ যাওয়া চাট্টিখানি বিষয় নয়।
তিনচারদিন রোগে ভোগার পর তাকে হয়তো নিয়ে যেতাম ডাক্তার রফিকের কাছে। সে এমনভাবে মুহিবের সাথে ব্যবহার করতো, ঔষধ খাওয়ার আগেই তার রোগ ভাল হয়ে যেত। জটিল কোন রোগে এম আর খান স্যারের কাছে গেলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো।
৯৫/৯৬ সালের ঘটনা। একজন স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম আমার কোন রোগ নিয়ে। ডাক্তাররা যা করেন- গলায় ঝোলানো স্টেথেসকোপ দিয়ে প্রথমেই রোগীর রক্তচাপ পরীক্ষা করে নেন। তিনি আমার রক্তের চাপ দেখে প্রায় আঁতকে উঠলেন। নিজে ধাতস্থ হয়ে একগাদা টেষ্ট এবং সাথে সাথে আরেকগাদা ঔষধের ব্যবস্থাপত্র লিখে আমায় বিদায় করেছিলেন।
ডাক্তারের কথা শুনে আমিও ভয়ের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম। ঔষধ খাওয়া এবং টেষ্ট করানোর আগে কেউ একজন পরামর্শ দিয়েছিল বিষয়টি নিয়ে এবিএম আব্দুল্লাহ স্যারের সাথে কথা বলতে।
এবিএম আব্দুল্লাহ স্যার তখন পিজি হাসপাতালের ইন্টারন্যাল মেডিসিনের এসোসিয়েট প্রফেসর, গ্রীণরোডের একটি চেম্বারে তিনি নিয়মিত রোগী দেখেন। তখনি তাঁর সিরিয়াল পাওয়া বেশ কঠিন। সাতদিনের ব্যবধানে তাঁর সিরিয়াল সংগ্রহ করেছিলাম।
তিনিও আমার রক্তের চাপ পরীক্ষা করে খানিকটা বিস্মিত হয়েছিলেন তবে প্রথম ডাক্তারের মতো তার প্রকাশ করলেন না। গাইবান্ধার আঞ্চলিক ভাষায় বললেন- রক্তের চাপ একটু বেশি, সাতদিন একটু রক্তের চাপ পরীক্ষা করে দেখেন তো, ফার্মেসিতে না, প্রতিদিন একটু কষ্ট কর্যা ডাক্তারের কাছেই যান। কথায় গাইবান্ধার এই আঞ্চলিক টান শুনে ভাল লেগেছিল। পরে জেনেছিলাম তার বাড়ি গাইবান্ধা লাগোয়া ব্রক্ষ্মপুত্র নদীর অপর পাড়ে জামালপুরে।
আমি তাঁর পরামর্শ মোতাবেক উত্তরা রেল লাইনের অপরপাশে জয়নাল মার্কেটে গিয়ে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে প্রতিদিন ৩০ টাকার বিনিময়ে রক্তচাপ পরীক্ষা করি এবং তা লিখে রাখি। আশ্চর্য জনক ঘটনা হলো ছয়দিনের রক্তচাপ স্বাভাবিক এবং কোন অসংগতি নেই।
এই রিপোর্ট নিয়ে গিয়েছিলাম আব্দুল্লাহ স্যারের কাছে। স্যার রিপোর্ট দেখার আগে নিজে রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হলো আমার রক্তচাপ স্বাভাবিক পাননি। সাতদিনের রিপোর্ট দেখে তিনি যদিও সন্তুষ্ট হয়েছিলেন- সিদ্ধান্তে আসার আগে কয়েকটি টেষ্ট করতে বললেন। সেই টেষ্টগুলো করে পরের সপ্তাহে তাঁর সাথে দেখা করলে আমাকে জানিয়েছিলেন আমার যে সমস্যা সেটিকে ডাক্তারের ভাষায় বলে “হোয়াইট কোট সিনড্রোম।” তিনি তার ভাষায় বুঝিয়ে বলেছিলেন-A condition where a person’s blood pressure is abnormally high in a healthcare setting, but normal in other settings.
এরপর তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার পছন্দের ডাক্তার। আব্বা মা এবং বড় ভাইকে তিনি যে আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়েছিলেন তা ভুলবার নয়। তাঁর রোগ নির্ণয়ের ক্ষমতা এককথায় চমৎকার। এরমাঝে আমাদের ছোটছেলের জন্ম হয় মনোয়ারা হাসপাতালে ১৯৯৯ সালের নভেম্বরের দুই তারিখে। হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পর রুমুর বেশকিছু সমস্যা দেখা দেয়। তারমাঝে প্রধান ছিলো ঘুম না হওয়া।
তখন কদিন থেকেই চলছিল হরতাল। একদিন সকালে পোস্ট একলামশিয়ার খিঁচুনি দেখে আমার মনে হয়েছিল রুমু বুঝি হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে। এম্বুলেন্সের জন্য ফোন করেছিলাম গ্রীণরোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালে। ভাগ্য ছিলো সুপ্রসন্ন। প্রায় বিশ মিনিটেই বাসায় চলে এসেছিল এম্বুলেন্স। একই সময়ের মধ্যে আমরা চলে গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল হাসপাতালে। এমাজেন্সির ডাক্তাররা রুমুকে দেখে ভর্তি করাতে রাজী হলো না। কারন জিজ্ঞেস করলে এমাজেন্সির ডাক্তার নিরাসক্ত মুখে বলেছিল – এমন ক্রিটিক্যাল রোগী ভর্তি করালে হাসপাতালের ডেডরেট বেড়ে যায়। সেখান থেকে উদভ্রান্তের মতো রুমুকে নিয়ে গিয়েছিলাম মনোয়ারা হাসপাতালে। দুদিন আগে এখান থেকেই রিলিজ করে নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে।
আমি কিছুই জানি না। হাসপাতাল থেকেই কল দিয়েছিল আব্দুল্লাহ স্যারকে। তাঁর তত্ত্বাবধানে রুমুর চিকিৎসা চলেছিল ১৪ দিন। প্রতিদিন স্যার রাতে আসতেন- রুমুর আপডেট আমাকে বলতেন। ১৪ দিন পর রিলিজের সময় স্যার আমাকে বলেছিলেন- আপনি ভাগ্যবান যে – খুব দ্রুত রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
তখন আমার মনে হয়েছিল কোন কোন অপ্রীতিকর বিষয়ও কারো কারো জীবনে আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেখা দেয়। সেদিন যদি হরতাল না থাকতো তাহলে ঢাকা শহরের যানজট ঠেলে রোগীকে হাসপাতালে স্থানান্তর করতে তিনচার ঘন্টা দেরি হয়ে যেত। এরপর থেকে ইন্টারন্যাল মেডিসিনের এবিএম আব্দুল্লাহ স্যার হয়ে উঠেছিলেন আমার কাছে সাক্ষাৎ রক্ষাকর্তা।
ইন্টারন্যাল মেডিসিন এবং এবিএম আব্দুল্লাহ স্যারকে নিয়ে আজ এতো কথা বলার অবশ্য কারন আছে। আমাদের বড় ছেলে মুহিব হ্যামিলটনের ম্যাকমাস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে হেলথ সাইন্স থেকে ডিগ্রী নেয়ার পর ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর মেডিকেল স্কুল থেকে এমবিবিএস পাশ করেছে। এক বৎসর রেসিডেন্সি করার পর কানাডায় ফ্যামিলি ফিজিসিয়ান হিসেবে সে তার কর্মজীবন শুরু করতে পারতো। তার লক্ষ আরও একটু উপরে। স্পেশালিস্ট হিসেবে সে তার কর্মজীবন শুরু করতে চায়। কানাডায় সেটিও প্রতিযোগিতার বিষয়।
আলাপ আলোচনায় আমাদের জীবনে এবিএম আব্দুল্লাহ স্যারের অবদান এবং কানাডায় ইন্টারন্যাল মেডিসিনের প্রসপেক্ট চিন্তা করেই সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এর উপর রেসিডেন্সি করার। আজ এর উপর প্রতিযোগিতাপূর্ণ ফলাফল সে পেয়েছে। আগামী জুন থেকে কানাডার কুইন্স ইউনিভার্সিটির অধীনে সে শুরু করবে ইন্টারন্যাল মেডিসিনের উপর চার বছর মেয়াদি চিকিৎসা সেবার উচ্চতর শিক্ষার রেসিডেন্সি।
বাংলাদেশের এবিএম আব্দুল্লাহ স্যার যেমন আমাদের জীবনে সাক্ষাৎ রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছিলেন- মুহিব যেন তেমনি অনেকের জীবনে এমনভাবে সেবা করতে পারে, এই দোয়াটুকু আপনাদের সবার কাছে চাই।
গুয়েল্ফ, অন্টারিও