
বাংলার লোকসংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল কৃষি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। বর্তমান সময়ের মত আগের দিনের কৃষকেরা জমিতে তিন-চার ফসল ফলাতে পারতো না। এক কিংবা দুই ফসলের উপর তারা নির্ভর করত। এরপর দীর্ঘ অবসর আর মৌসুম বদলের অপেক্ষা। জমিতে কোন কাজ নেই অথচ বিনোদনেরও কোন ব্যবস্থা ছিল না, এই শূন্যতা পূরণ করতে গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম আকর্ষণ হয়ে ওঠে যাত্রা।
পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর অভিনয় কিংবা পালাগানকে পুঁজি করে বিভিন্ন শিল্পী-গোষ্ঠী দীর্ঘ দিন অবস্থানের জন্য দেশের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যাত্রা করতো। গরুর গাড়ি, নৌকা কিংবা পায়ে হেঁটে এভাবে যাত্রা করা থেকে সম্ভবত “যাত্রা” শব্দটির উৎপত্তি। আবার অনেকে মনে করেন ‘সূর্যপূজা’ থেকে যাত্রা পালাগানের শুরু। রাধাকৃষ্ণের প্রেম লীলা, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী, কারবালার কাহিনী, লোকজ প্রেম-কাহিনী যেমন; লাইলী মজনু, বেহুলা লখিন্দর, ইউসুফ জোলেখা, রহিম বাদশাহ রূপবানের মত কাহিনী ছিল যাত্রাদলগুলোর পছন্দের বিষয়। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে তারা মনোযোগ দেয় দেশপ্রেমমূলক কাহিনী যেমন ক্ষুদিরাম, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, বীরাঙ্গনা সখিনা কিংবা সমাজ জীবনের নিগূঢ় বাস্তবতার দিকে। এভাবেই আর দশটা শিল্প মাধ্যমের মত প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার চাহিদা মিটিয়ে এগিয়েছে যাত্রা শিল্প।
আগেকার দিনে মঞ্চ নাটকের দর্শক ছিল অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল এক শ্রেণীর লোক। যেহেতু বিনোদন উঁচু নিচু ভেদ মানে না তাই গ্রামের সাধারণ মানুষকে আনন্দ দিতে, তাদের হাসাতে কাঁদাতে যাত্রাদল গ্রাম বাংলার কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় শক্ত বিনোদন মাধ্যম হিসাবে এগিয়ে যেতে থাকে। সে সময় প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির বাড়ির উঠানে কিংবা মন্দিরের আঙ্গিনায় অথবা খোলা মাঠের উপর যাত্রা শিল্পীদের জন্য মঞ্চ তৈরি করা হত। বেশিরভাগ সময় মঞ্চের তিনদিক খোলা রাখা হত যেন মঞ্চকে ঘিরে পুরুষ মহিলাদের সবাই অভিনীত দৃশ্য দেখতে পায়। মঞ্চের পেছনে সামান্য দূরত্বে গ্রিনরুম থাকার কারণে অভিনেতা অভিনেত্রীরা গ্রিনরুম থেকে দৌড়ে দৌড়ে মঞ্চে আগমন ও প্রস্থান করত। গ্রাম-গঞ্জে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় মঞ্চে আলোর কারুকাজ দেখানো সম্ভব হত না। মশাল, হারিকেন এবং হ্যাজাক জ্বালিয়ে মঞ্চকে আলোকিত করা হত। আর যেহেতু মাইকের প্রচলন ছিল না তাই সকলকে উচ্চস্বরে সংলাপ বলতে হতো। কাহিনীর সাথে সঙ্গতি রেখে কণ্ঠস্বর উঁচুনিচু করে সংলাপ বলার ক্ষেত্রে যে যত দক্ষ হত যাত্রা শিল্পী হিসেবে তার জনপ্রিয়তা ততো বেড়ে যেত। যাত্রার আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হল প্রায়ই প্রতিটি পালাতে একটি করে বিবেকের চরিত্র থাকতো। ‘বিবেক’ চরিত্রের অভিনেতা ঘটনার জটিল অংশকে কিছুটা হাল্কা করে দিত এবং প্রয়োজনবোধে ঘটনার ক্লাইম্যাক্সে তৈরি করতো।
যুগ পরিবর্তনের সাথে পাল্লা দিয়ে যাত্রাপালা মূল অবস্থান থেকে অনেক সরে এসেছে। ইংরেজ শাসন পর্যন্ত যাত্রা শিল্প কোন বড় বাঁধার সম্মুখীন না হলেও ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হওয়ার পর সরকারী প্রশাসন এবং ধর্মীয় ফতোয়া জারি করে যাত্রাদলের কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পর যাত্রাদলগুলোর মধ্যে প্রাণ ফিরে এলেও আশির দশক থেকে প্রিন্সেস লাকি, প্রিন্সেস জরিনা নামধারী চরিত্রগুলোকে যাত্রা মঞ্চে তুলে দেয় একদল উশৃঙ্খল ব্যবসায়ী। একটা শিল্প মাধ্যম যখন উশৃঙ্খল ব্যবসায়ীদের হাতে উঠে যায় তখন তারা রুচির অবক্ষয় নিয়ে ততোটা ভাবেন না যতোটা ইনভেস্টমেন্টের মুনাফা নিয়ে ভাবে। যাত্রা শিল্পকে ডুবাতে ডুবাতে অথবা অন্যভাবে যদি বলি যাত্রার আয়োজন থেকে মুনাফা উঠাতে উঠাতে এরা যাত্রাকে সমাজের অন্ধকার জগতে নিয়ে যায়। এখন যাত্রা মঞ্চে অভিনয় বহির্ভূত ডজন খানেক মেয়েকে দিয়ে রাতভর দাপাদাপি করানো ছাড়া তেমন কিছু করা হয় না। আগে যেমন গ্রামে-গঞ্জে রাত জেগে মানুষ যাত্রা দেখত এখন তেমনটা নেই বললেই চলে। ইদানীং প্রশাসনের নাকের ডগায় যাত্রা অনুষ্ঠানে যে অশ্লীলতা দেখানো হয় সেটা অবাক করার মত। যাইহোক বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিভাগ সহ দেশের একদল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী এই অধঃপতনের হাত থেকে ঐতিহ্যবাহী যাত্রাকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। ২০১২ সালের যাত্রা নীতিমালা অনুসরণ করে তারা নিত্যনতুন যাত্রা নামাচ্ছে। যার ফলে নতুন করে সম্ভাবনার মুখ দেখছে যাত্রা শিল্প।
যেদিন মানিক চন্দ বলল টরেন্টোতে সে একটি যাত্রা মঞ্চায়ন করতে চায়। কথাটা শুনে খুব খুশি হয়েছিলাম। খুশির মাত্রা বেড়ে গেল যখন শুনলাম সে নবাব সিরাজউদ্দৌলা করতে চায়। মানিক চন্দের অভিনয় আমি দেখেছি। একত্রে আমরা একটি নাটকে কাজও করেছি। অভিনয় ব্যাপারে ওর তৃপ্তির যায়গাটা আমি ধরতে পেরেছি বলেই তাকে বাহবা দিয়েছিলাম কিন্তু সাথে সাথে এও বলেছিলাম খুব বড় একটা চ্যালেঞ্জ নিতে যাচ্ছেন আপনি। চ্যালেঞ্জ এই জন্য যে টরেন্টোর সম্ভাব্য দর্শকদের মধ্যে কতজনের যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা আছে সেটা আমি জানি না। বয়সে তরুণ এবং শিল্প সংস্কৃতির উৎকর্ষতা নিয়ে ভাবে এমন কেউ ইদানীং যাত্রা দেখে বলে বিশ্বাস হয় না। যেহেতু টরন্টোর দর্শকদের মধ্যে যাত্রা দেখার অভিজ্ঞতা খুব কম তাই যাত্রাকে দর্শকদের কাছে প্রাথমিক উপস্থাপনের পর তার থেকে সৃষ্টির তৃপ্তি তুলে দেয়া খুবই কঠিন হবে। একই মঞ্চে সীমিত সময়ের মধ্যে অভিষেক এবং গ্রহণযোগ্যতা আদায়ের আকাঙ্ক্ষা, চ্যালেঞ্জটা এখানেই। সে বলল আশীর্বাদ করবেন। বুঝে নিলাম মানিক চন্দ এবং তার টিম চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত আছে।
যে সমস্ত দর্শক নবাব সিরাজউদ্দৌলা দেখতে যাবেন আশা করি তাদের মধ্যে ইতিহাস জানা লোকই বেশি থাকবেন। ‘টরন্টো থিয়েটার প্লাস’ এর প্রথম প্রযোজনার সুনিপুণ উপস্থাপনা এবং সম্মানিত দর্শকদের প্রাজ্ঞ আলোচনার মধ্য দিয়ে বাকীরা হয়তো বুঝতে সমর্থ হবে এক পরাজিত নায়কের জীবনী নিয়ে লেখা পালাগান বা যাত্রা এত বছর পরও কানাডার মত একটি দেশে মঞ্চায়নের গুরুত্ব কতটুকু। একজন সাধারণ দর্শককে কোন কাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট করতে পারাতেই কাহিনী রচয়িতার এবং উপস্থাপনের দায়িত্বে থাকা লোকগুলোর সার্থকতা। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনী আমদের দুটি বিষয় গভীর ভাবে ভাবতে শেখায়। প্রথমত অন্যায়ের কাছে মাথা নিচু না করে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিলে অমরত্ব আসে। দ্বিতীয়, কুচক্রী ও বিশ্বাসঘাতকদের দল স্বল্পকালীন সময়ের জন্য জয়ী হলেও, ইতিহাস দেশ সমাজ কখনোই তাদের গ্রহণ করে না।
দাদা নবাব আলীবর্দি খানের খানের মৃত্যুর পর (১০ এপ্রিল, ১৭৫৬) মির্জা মুহাম্মদ সিরাজ-উদ দৌলা বা সংক্ষেপে সিরাজউদ্দৌলা বাংলা বিহার এবং উড়িষ্যার নবাবী লাভ করেন। তখন তাঁর আনুমানিক বয়স ছিল ২৪ বছর। ক্ষমতায় বসার আগেই সিরাজউদ্দৌলা বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজ ব্যবসায়ীরা (ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি) অন্য সব দেশের ব্যবসায়ীদের মত নয়। তারা ব্যবসার নামে দেশ দখল করতে এসেছিল। নবাব খবর পেলেন যে রবার্ট ক্লাইভের সৈন্যরা কলিকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কেল্লাকে মজবুত ও যুদ্ধ উপযোগী করে গড়ে তুলছে। কেল্লা সংগঠিত করার বিধিনিষেধ অমান্য করাকে কেন্দ্র করে নবাব এবং ইংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং পরবর্তীতে পলাশীর প্রান্তরে শুরু হয় ঐতিহাসিক পলাশীর যুদ্ধ। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধ বিকাল ৩ টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে মিরমদন ও মোহন লাল প্রাণ দিলেও ইংরেজদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে এবং ইংরেজদের প্রলোভনে নবাব হবার বাসনায় প্রধান সেনাপতি মীরজাফর আলী খান বিশ্বাসঘাতকতা করে বসে। তিনি তার কুচক্রী দলের সদস্য ইয়ার লতিফ, রায় দুর্লভের মত বন্ধুদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোন হাতিয়ার না উঠিয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকতে হুকুম দেন। কাজেই চারিদিক থেকে যে আক্রমণ করার কথা ছিল সেই কৌশলে যুদ্ধ না হওয়ায় ইংরেজরা মাত্র তিন হাজার সৈন্য নিয়ে নবাবের আঠারো হাজার সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে সহজ জয় লাভ করে। যুদ্ধে পরাজিত হবার পর পাটনার দিকে যাবার পথে নবাবকে গ্রেফতার করা হয় এবং মীরজাফরের পুত্র মীরনের হুকুমে মোহাম্মদ বেগের হাতে তিনি নিহত হন। মীরজাফরের এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য দুইশত বছর গোলামি করতে হয়েছিল ভারতবাসীকে। পলাশীর যুদ্ধের একশো বছর পর ১৮৫৭ সালে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বড় আকারে বিদ্রোহ শুরু হলেও ১৯৪৭ এর আগে ইংরেজ তাড়ানো সম্ভব হয় নি। এই দুইশ বছর ধরে যারা স্বাধীনতার পথ দেখিয়ে গেছেন তাঁরা সকলেই এখন ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁরা দেশ প্রেমের অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে যুগে যুগে মীরজাফরের মত বিশ্বাসঘাতকেরা হয়েছে নিন্দিত। প্রশ্ন হল মাত্র ২৪ বছরের একজন যুবক, যিনি মাত্র এক বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং একদিনের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিহত হলেন তাঁকে আজো কেন সকলে মনে রেখেছে? আরো প্রশ্ন আছে, মসনদের বসার আগে সিরাজের দুশ্চরিত্র ও মদ পানের আসক্তি নিয়ে দুর্নাম ছিল। অনেক ঐতিহাসিক তাঁকে বদ মেজাজি এবং বেপরোয়াও আখ্যায়িত করেছেন। তবে কেউ কেউ বলেন এগুলো ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তিদের চরিত্র স্খলনের প্রক্রিয়া। যাতে করে ক্ষমতার হাত বদল হলে জনসাধারণ একে স্বাগত জানায়।
কথ হল; বিশ্বের উন্নততর একটি গণতান্ত্রিক দেশে বসে প্রবাসী দর্শাকেরা বাংলার সামন্তযুগের এক নাবাবের কাহিনী থেকে কি অভিজ্ঞতা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ দখল করতে এসেছিল ইংরেজরা এ কথা নবাবী গ্রহণ করার আগেই বুঝতে পেরেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রও তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাহলে কি একজন হৃদয়বান মানুষ কিংবা মানবিক গুণের কারণে নবাব তাঁর নিকট আত্মীয় মীরজাফরের প্রতি কঠোর হতে পারেন নি? এই ভাবনা সত্য হলে আরো প্রশ্ন জাগে। তা হলে কি নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশপ্রেম বড় ছিল না কি মানবিক গুণ? সে কি গণ মানুষের মুক্তির দিশারী নাকি মহা ভুলের প্রাপ্য পরিণতি। একজন মহানায়কের জীবনীকে কাহিনীকার উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতম করে অবশেষে ট্রাজেডির মধ্যে যখন সমাপ্তি টানেন তখন কি শেষ দৃশ্যে সেই মহানায়কের মৃত্যু হয়? না কি তাঁকে ফিরে পাবার আশাবাদ জাগে পাঠক ও দর্শকদের হৃদয়ে।
স্কারবোরো, কানাডা