
আজ কর্মদিবসের শুরুটা যে ঠিক কেমন ছিল, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। তবে প্রবল অস্বস্তি মিশ্রিত শংকায় ভরা অপরিচিত এক অনুভূতি।
আমরা দু’জন কর্মী ইন্সপেকশনে গেলাম সরকারি সোশ্যাল হাউজিং এর একটা এপার্টমেন্টে। এ বিল্ডিং আমার খুব অপছন্দের হলেও প্রায় বছরখানেক এ এলাকায় আমার কাজ থাকবে। তারপর আরেকজনের ঘাড়ে যাবে।
এখানে প্রতিদিনই পুলিশের উপস্থিতি থাকে। মাঝেমধ্যে গোলাগুলি, মারামারি, সুইসাইড চলে। বেশিরভাগ এপার্টমেন্ট ড্রাগ প্যারাফার্নালিয়া ইউনিট; অর্থাৎ সেখানে চলে অবৈধ ড্রাগ গ্রহণ, সরঞ্জাম এর ব্যাবহার, কেনা-বেচা। এ ধরনের ইউনিটে আমরা খুব সাবধানে ঢুকি; কারণ মেঝেতে পড়ে থাকে ব্যবহৃত সিরিঞ্জ, কাঁচের ভাঙা ক্র্যাক-কোকেন পাইপ, ধারালো বস্তু। কোনো ইউনিট আবার এতটাই বিভৎস নোংরা, যে ভেতরে ঢোকাও সম্ভব নয়। একসাথে দু’জন যাবার কারন সেখানে সিকিউরিটি বা ভায়োলেন্স ইস্যু/সম্ভাবনা আছে।
নক করার পর দরজা খুললো এক লোক। পরনে টি-শার্ট আর জাঙ্গিয়া। অনেকের অবশ্য এটুকুও থাকে না। ছোট্ট ইউনিটের ভেতর থেকে তীব্র গাঁজার গন্ধ নাকে ধাক্কা দিলো। লোকটা বিরক্ত, তবে খুব শান্ত গলায় বলল- “আমি তো কালকেই এপয়েন্টমেন্ট বাতিল করেছি, তোমরা জানো না? তোমরা আরেকদিন এসো, আজ আমার সুইসাইড করবার দিন”।
শুনে আমরা থ হয়ে গেলাম।
আমার কলিগ নতুন আর অল্প বয়স্ক তরুণ। সে নাস্তিক, নাকি আস্তিক; তা জানি না। তবে সে দুই হাত একসাথে মুঠি মেরে উপরে তুলে বারবার প্রার্থনা করতে লাগলো- “গড, লোকটাকে বাঁচায়ে দাও.. প্লিজ!”
আমরা তড়িৎ ব্যবস্থা নিলাম।
আমি ছুটলাম পাশের বিল্ডিং এর সমাজকর্মীর কাছে, যারা এদের দেখভাল করে। তারা প্রতিটা এপার্টমেন্ট সম্পর্কে অবহিত। আমার কলিগ আমাদের ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজারকে অবহিত করার পর পুলিশকে খবর দিতে লাগলো।
পুলিশ ‘আসতেছি বললেও তাদের টিকিটিরও দেখা পেলাম না। আমি পনেরো মিনিট পর হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, যাওয়া যাক। আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করেছি, এবার যাদের দয়িত্ব তারা করুক?
– কিন্তু আমাকে যে পুলিশ থাকতে বলল? গেইট খোলা লাগতে পারে
– ওদের গেইট খুলতে সমস্যা হয় না
– তবুও..
আমি আর কথা না বাড়িয়ে অপেক্ষা করি। অল্প বয়সী ছেলেটার আবেগ বেশি। হঠাৎ এ এলাকার প্রপার্টি ম্যানেজারকে পেয়ে গেলাম। উনি এসে বললেন- তোমরা এখনো এখানে? এক ঘন্টার বেশি হশে গেলো!
– আমরা কি চলে যাবো?
– মনে হয় না তোমাদের আর অপেক্ষা করার কোনো যুক্তি আছে।
আমরা চলে গেলাম।
তবুও সারাটা দিন মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। কাজে মন বসাতে পারলাম না। লোকটার কি অবস্থা? আছে না গেছে? চোখের সামনে এসব পরিস্থিতির সাথে যুক্ত হওয়া আর খবর/গল্পে পড়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক। খারাপ কিছু ঘটে গেলে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হবে। মনে হবে রিস্ক নিয়ে লোকটার সাথে আলাপের চেষ্টা করে সময় ক্ষ্যাপন করলেও হয়তো সে বাঁচতো।
এদের দিকে তাকালে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে। তখন বোধোদয় হয়; আমরা নিজেরা আসলেই কতটা ভালো আছি!
.
বিকালে অফিস ফিরবার পথে কর্তৃপক্ষের ফোন- জাভেদ কেমন আছো?
– এইতো ভালো
– সবকিছু ঠিক আছে, তুমি ঠিক আছো?
– আমি ভালই আছি। আচ্ছা, ঐ লোকটার কোনো খবর আছে?
– সে আছে একরকম। তার সাথে মানসিক সাস্থ্য কর্মী, সোশ্যাল কর্মীরা যোগাযোগ রাখছে
– যাক, এটা ভালো খবর
– আর শোনো জাভেদ, আমরা জানি তোমাকে কতটা মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। তুমি যদি মনে করো তোমার কোনোপ্রকারের সাপোর্ট দরকার; মেন্টাল বা জব সংক্রান্ত, তবে সব ব্যবস্থা আছে। প্রয়োজনে যোগাযোগ করবা। আমরা তোমাকে যেকোনো সাপোর্ট দিতে প্রস্তুত
– ধন্যবাদ
– এখন বাসায় ফিরে নিশ্চিন্তে আরামে ঘুম দিবা। কোনোপ্রকার দুশ্চিন্তা মাথায় রাখবা না…
ঘটনাস্থল থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে কানাডার মহান পার্লামেন্ট ভবন। ওখানে গেলে মনে হবে যেন স্বর্গের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। কি ভয়াবহ সুন্দর, মাস্টারপিস স্থাপত্যের অতুলনীয় নিদর্শন। পরিচ্ছন্ন, চোখ জুড়ানো অটোয়া সংসদ ভবন। আর অহংকার নিয়ে পতপত করে তার চূড়ায় উড়ছে লাল-সাদা পতাকা!
অটোয়া, কানাডা