-0 C
Toronto
বুধবার, মার্চ ১২, ২০২৫

৭ মার্চ

৭ মার্চ
এই উন্মাদনার যে রোগ ইদানিং প্রকট আকার ধারণ করিয়াছে এইটি যে কেবলি মধ্যপ্রাচ্যে বা পাক আফগানে সীমাবদ্ধ তাহা নয় ইহার বিস্তৃতি উত্তর থেকে দক্ষিণ পূর্ব থেকে পশ্চিম সকল গোলার্ধেই ছড়াইয়া পড়িয়াছে I

শুনেছি, কালকে একদল কীর্তিমান দেশে ৭ মার্চ পালন করবে ভিন্নভাবে।  সেই সব কীর্তিমানদের নিয়ে দশ বছর আগে ২০১৫ সালে লিখেছিলাম এই রম্য রচনা।

ভাবলাম আপনাদের সাথে শেয়ার করি।

- Advertisement -

বেশ কিছুদিন ধরিয়া আমাকে একটি নোতুন বাতিকে পাইয়া বসিয়াছে I একটু বাদে বাদে আমার ডান হস্তটি উত্তোলিত হইয়া মাথার কাছে চলিয়া  আসে I ধড়খানার সহিত মাথাটি আস্ত আছে কিনা , হাতটি বারংবার সেইটিই পরীক্ষা করিয়া দেখে I কারণ আর কিছুই নহে , ইদানিংকালে যেইভাবে মাথার উপর চাপাতির কোপ চালানো শুরু হইয়াছে , দেশে বা বিদেশে কোথাও আপনি নিরাপদে বহাল তবিয়তে আছেন , সেইটি হলফ করিয়া বলিবার আর যো নাই I বিশেষ করিয়া আমরা যাহারা এক আধটু লেখালিখি করি ,  কোদালকে কোদাল না বলিয়া ইনাইয়া বিনাইয়া অন্য কিছু বলিতে পারি না , তাহাদের  জন্য ব্যাপারটি ইদানিং আরো ঘোলাটে হইয়া দেখা দিয়াছে I তাই বলিতেছিলাম , অভিজিৎ এর খুনের রেশ কাটিতে না কাটিতেই গতকাল আরো একজনের খুনের খবর দেখিতে পাইয়া ভাবিলাম , এইটিই কি তাহা হইলে নিয়মে পরিণত হইয়াছে , যুক্তিতে কুলাইয়া উঠিতে না পারিলে চাপাতি বা ক্ষুর দিয়া তাহার দফারফা করিব I এইটির সর্বশেষ বলি ওয়াশিকুর রহমান , মাত্র সাতাশ বছর বয়স , শুধু নিজের পছন্দমত লেখার কারণেই খুন হইয়া গেলো I

এই উন্মাদনার যে রোগ ইদানিং প্রকট আকার ধারণ করিয়াছে , এইটি যে কেবলি মধ্যপ্রাচ্যে বা পাক আফগানে সীমাবদ্ধ তাহা নয় ; ইহার বিস্তৃতি উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সকল গোলার্ধেই ছড়াইয়া পড়িয়াছে  I ইংরেজিতে ফ্যাড বলিয়া একটি শব্দ আছে , আজকাল নাকি এই ব্যাপারটি ফ্যাড হিসাবে দাড়াইয়া গিয়াছে I যুবতীরা জিহাদী যুবক ছাড়া বিবাহ করিতে রাজি নয় I যদি আপনাদের বিশ্বাস করিতে কষ্ট  হয়, তাহা হইলে লন্ডনের ডেইলি মেইল পত্রিকার অনলাইনে গিয়া ১৫ ফেব্রুয়ারির “জিহাদী কনের পদচিহ্ন (জিহাদী ব্রাইড’স ট্রেইল) শিরোনামের রিপোর্টটি পড়িয়া দেখিতে পারেন।

এইগুলি আমাদের মত পশ্চাদপদ দেশ হইতে যাইতেছে, তাহা কিন্তু নয় ; তাহারা উত্তর আমেরিকা , ইউরোপ এর মত উন্নত মহাদেশ হইতে পাড়ি জমাইতেছে I এইত সেইদিনের ঘটনা , খোদ কানাডা হইতেই জিহাদিরা রওনা শুরু করিয়াছে , এবং তাহাতে অনান্যদের মত আমাদের দেশী বংশোদ্ভূত বালক বালিকারাও জিহাদী জোসে পাগলপারা হইয়া ‘আগে বাড়াও আগে বাড়াও’ গাহিতে গাহিতে অমরত্বের উদ্দেশ্যে  বিমানে চড়িয়া বসিতেছে I

যাই হোক , এতক্ষণ যাহা বলিয়াছি, তাহা শুধু রোগের লক্ষণ , রোগের আসল কারণ জানিতে হইলে অভিজিতের কাছেই ফিরিয়া আসিতে হইবে I  আমেরিকা হইতে দেশে যাইবার পূর্বে সেখানকার ‘সেন্টার ফর ইন্কুয়ারী ‘   নামের এক প্রতিষ্ঠানে বিশ্বাসের ভাইরাস নিয়া ইংরেজিতে জব্বর এক লেখা দিয়া আসিয়াছিল I নিয়তির কি পরিহাস , সেইটি ছাপাখানায় যাওয়ার মুহুর্তেই তাহারা জানিতে পারিল , অভিজিৎকে খুন করা হইয়াছে I এইবার লেখাটির প্রসঙ্গে আসি I অভিজিৎ কি রকম দৈবচয়নের মত করিয়াই সেই লেখাটিতে তাহার উপর ঘাতকদের রোষ , মৃত্যু হুমকি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখিয়া গিয়াছে I বলিয়াছে , বিশ্বাস ভিত্তিক সন্ত্রাস ভাইরাস ছাড়া আর কিছুই নহে , ইহাকে যদি বিস্তার লাভের সুযোগ করিয়া দেওয়া হয়, তাহা হইলে ইহা সমাজে মহামারীর মত ছড়াইয়া পড়িবে ; বিশ্বের দেশে দেশে ইসলাম , ক্রিস্টান , হিন্দু সর্ব ধর্মের লোকেদের উন্মাদনার কারণে বিভিন্ন সময় প্রাণ ও সম্পদহানির  উদাহরণ টানিয়া বলিয়াছে , এইসবের কারণের পিছনে রহিয়াছে বিশ্বাসের ভাইরাস এবং এইগুলা আমাদের চারপাশে হরদম ঘটিতেছে I

অভিজিৎ আরো লিখিয়াছে , ‘ আমি ‘বিশ্বাসের ভাইরাসে ‘ নতুন বা মহতী কোনো ধারণা আবিষ্কার করিয়াছি বলিয়া দাবি করি না I সে তাহার ধারণার উৎস হিসাবে রিচার্ড ডকিন্স , ক্রেগ জেমস , ডারেল উইলিয়াম রে প্রমুখ মনীষীর লেখনীর উল্লেখ করিয়াছে I দার্শনিক ড্যানিয়েল সি দানেট এর মতবাদের সূত্র উল্লেখ করিয়া বলিয়াছে , পরজীবী যেইভাবে অনুজীবকে আক্রমন করে , ঠিক একই কায়দায় ধর্মও মানুষের ব্যবহারকে কব্জা করিয়া লয় I  পাগলা কুকুর বা শেয়ালের কামড়ে জলাতঙ্ক রোগ হয় , আমরা সকলেই জানি I ইহারই উদাহরণ টানিয়া সে লিখিয়াছে , এইটি একটি র‍্যাবিস ভাইরাস , এবং এই ভাইরাস স্তন্যপায়ী প্রাণীর বিশেষ একটি স্নায়ুকে আক্রান্ত করে আর সেই আক্রান্ত প্রাণী সেই ভাইরাস এর শিকার হইয়া অন্যদেরকে আক্রমনের জন্য উদ্যত হয় I এইজন্য আগেকার দিনে মানুষ মাত্রই জলাতঙ্ক রোগের কথা শুনিলে আতঙ্কগ্রস্ত হইয়া পড়িত I হেয়ারওয়ার্ম নামের  আরেকটি পরজীবীর উদাহরণ টানিয়া লিখিয়াছে ,  এই পরজীবী ঘাস ফড়িং এর মগজে এমনভাবে আক্রমন করে , ঘাস ফড়িং নিজের অজান্তেই দাপাদাপি করিয়া পানিতে লাফাইয়া পড়ে আর নিজেই নিজের আত্মহত্যার পথ বাছিয়া লয় I জীববিজ্ঞানের এইসব গবেষনার নানান উদাহরণ টানিয়া অভিজিৎ প্রশ্ন তুলিয়াছে , মনুষ্য সমাজেও কি আমরা একই ঘটনার সামঞ্জস্য দেখিতে পাই না ?

আই এস আই এল বা ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তৃত নতুন খিলাফত এর লবকুশদের কথা বলিতে গিয়া মার্কিনিদের মোড়ল বারাক ওবামার উপরও একচোট দেখাইয়া দিয়াছে I তাহার মতে , খিলাফতিরা যে হাজার বছর আগের প্রথা অনুসরণ করিতেছে মাত্র , সেইটিকে অস্বীকার করিয়া বারাক ওবামা রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য রাজনৈতিক কূটকচালির আশ্রয় লইয়াছে I সম্প্রতি অভিজিতের সম্পর্কে অনেকের বক্তৃতা দেখিয়া শুনিয়া  মনে হয় , হয়ত প্রচারভুকের দল অভিজিতের লেখা না পড়িয়া নিতান্ত অজ্ঞানতাবশত  হাস্যকরভাবে মঞ্চের উপর দাড়াইয়া পড়িয়াছেন  অথবা সেই অভিজিতের কথাতেই বলি , ফ্যাক্চুয়ালি রাইট বলিতে না চাহিয়া  কথার মারপ্যাচে ধরি মাছ না ছুই পানির মত  পলিটিকালি কারেক্ট কিছু বলিয়া মঞ্চ হইতে নামিয়া পড়িতেছেন I অভিজিৎ যাহা লিখিয়া গিয়াছে , তাহার বিন্দুবিসর্গ পড়িয়া থাকিলে  তাহাদের অনেকেই রাম রাম বলিয়া শত হাত দুরে থাকিতেন , আমি হলফ করিয়া বলিতে পারি I তাহা না হইলে বীরপুঙ্গবেরা অভিজিতের লেখার যে মূল ভাষ্য, তাহার বিন্দুমাত্র  উল্লেখ না করিয়া তোতাপাখির মত কখনো হাসিনা , পরক্ষণে খালেদার মুন্ড চটকানোর কাজে সারাটি সময় ব্যয় করিবার কথা নহে I যাহাই হোক, অভিজিৎ বাচিয়া থাকিলে এইসব বালখিল্য আচরণ দেখিয়া পেট পুরিয়া হাসিয়া লইত I

সেইদিন এক বন্ধুর সহিত চাপাতির কীর্তি নিয়া আলাপ করিতেছিলাম ; এক পর্যায়ে সে একটি চমত্কার কথা বলিয়া বসিল I আমি বলিলাম , বেশ তো তোমার পর্যবেক্ষণ ; সে বলিল , যে দেশ তাহার বাইশ কি চব্বিশ শতাংশ সংখ্যালঘুকে মানিয়া লইতে না পারে , সেই দেশ মধ্যযুগীয় ছাড়া আর কি I তাই তো , ১৯৭১ সালেও যেই দেশে কুড়ি শতাংশেরও বেশি সংখ্যালঘু ছিল , আজকে মাত্র চুয়াল্লিশ বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা নামিয়া আসিল সাত কি আট শতাংশে I হায়রে পোড়া দেশ , জনসংখ্যার বৈচিত্রের স্বাদ কি সেইটাই বুঝলি না I এই পরদেশে আসিয়া দেখিয়া শুনিয়াও না দেখিবার , না শুনিবার ভান চলিতেছে I এখানে বহু বৈচিত্রতাকে সংবিধান করিয়া তাহারা সুরক্ষা করিতেছে ; পান থেকে চুন খসিলো কি খসিলো না , এখানকার কর্তা ব্যক্তিরা তর্জনী তুলিয়া বসে I বৈচিত্রতার কি বাহারি ধুম , কি পোশাকে , কি ভাষায় , কি খাবারে , কি উত্সবে ; বিচিত্র জনগোষ্ঠী সরকারী আনুকূল্যে হরদম লাগিয়া আছে বৈচিত্রতাকে উদযাপন করিবার জন্য আর আমরা কিনা সম্পত্তি কিম্বা নারী ভোগের জন্য অবিশ্বাসীদের উপর চড়াও হই সময় কি অসময়ে I

বেচারা অভিজিৎ এই বলিয়া লেখাটি শেষ করিয়াছে , ‘একটি বিষয় খুবই নিশ্চিত , আর সেইটি হইতেছে , বিশ্বাসের ভাইরাস বিপদজনকভাবে সত্য I’ এই খোদ কানাডাতে থাকিয়া ও এই ভাইরাস হইতে মুক্তির কোনো উপায় আছে বলিয়া মনে হয় না I কিছুদিন বাদে বাদেই নানান জাতি গোষ্ঠির ধর্ম , বর্ণের নানান ফেকরা নিতান্ত ব্যক্তিগত না থাকিয়া রাষ্ট্রের খোদ সেকুলার ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ জানাইয়া বসে।

ভাবিয়াছিলাম, দীর্ঘদিন পরে লেখিবার কসরত করিতেছি, ওরহান পামুক এর “দ্য মিউজিয়াম অফ ইনোসেন্স” নামের  জাদুকরী বইটি পাঠকের সহিত শেয়ার করিব  ; পামুক যেন বই নয় , মানব মানবীর বুকঝিম এক ভালোবাসার দলিল লিখিয়া রাখিয়াছে।  “১৯৭৫ সাল , ইস্তাম্বুলে নিটোল বসন্ত।  দুই বিশিষ্ট পরিবারের সন্তান কামাল আর সিবেল এর গায়ে হলুদ প্রায় ঘনিয়ে।  কিন্তু যেদিন কামাল দেখতে পায়  ফুসুনকে , এক রূপসী দোকান কন্যা এবং তাঁর দুরের আত্মীয় ,  সে পুরোপুরি আবিষ্ট হয়ে যায় ।   এবং একবার যখন তাদের মধ্যে  কুমারত্বের অনুশাসন ভেঙ্গে যায়  , কামাল এবং পশ্চিমা ইস্তাম্বুলের বুর্জুয়াদের মধ্যে শুরু হয় ভাঙ্গন।  পরবর্তী আট বছর ধরে ফুসুনকে পাবার সাধনায় , কামাল হয়ে ওঠে তাড়িত এক সংগ্রাহক নানান তৈজসের, যা তাঁর প্রণয়পীড়িত সময়েরই আখ্যান – এভাবেই পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে এক জাদুঘর , যা সমাজ এবং তাঁর হৃদয় উভয়েরই মানচিত্র।  নোবেল প্রাপ্তির পর ওরহান পামুকের প্রথম এই উপন্যাস রোমান্টিক প্রেমের আলোড়ন করা এক অন্বেষণ। ”

পাঠক , চাপাতির কীর্তি নিয়া মানসিক পীড়ন এর এই দুসময়ে  ওরহান পামুক এর প্রনয়পীড়ন এর পাঠ কিছুটা হইলে ও থেরাপীর কাজ করিবে , এইটুকু গ্যারান্টি দিয়া বলিতে পারি।

 

টরন্টো, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles