
গতকালকে আমার কানাডায় বসবাসের পনের বছর পূর্ন হল। সময় হিসেবে বেশ বড় একটা সময়। ব্যক্তিগতভাবে কানাডায় আসার পর প্রথম পাঁচ বছর খুব লাভ-লোকসানের হিসেব কষতাম। এখানে এসে কী পেলাম আর কী পেলাম না সেই হিসেব।
নতুন দেশে এসে মন খারাপ হয়েছে। অনেকবার বাংলাদেশে ফিরেও যেতে চেয়েছি। কিন্তুু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। অবশ্য সে হিসেব এখন আর করিনা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন লক্ষ্য স্থির করে জীবনকে অন্যভাবে সাজিয়েছি। জীবনকে যাপন করছি। কানাডার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, ও আবহাওয়ার সাথে নিজেকে ধীরে ধীরে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছি।
শীত প্রধান এদেশটিকে এখন ভালোই লাগে। এ দেশটাকে এখন ভালোবাসি। বাংলাদেশকেও ভালোবাসি।জন্মভূমিকে তো কখনো ভোলা যায়না। সেজন্য এখনো বাংলাদেশের অস্থিরতা আমাকেও অস্থির করে তোলে। তার জন্য ফেসবুকে বাংলাদেশকে নিয়ে নানান বিষয়ে লিখি। কেউ কেউ পছন্দকরে, কেউ কেউ করেনা। তার জন্য কোন দুচিশ্চন্তা করিনা। বাংলাদেশকে যেমন অন্যকোনো দেশ হুমকি দিলে মন খারাপ হয়। তেমনি কানাডাকেও কোন দেশ হুমকি দিলে মন খারাপ হয়।
আমেরিকা, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সাথে কানাডার নানা টানাপোড়েন চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। সে সমস্ত বিষয় মাঝে মাঝে মনকে অস্থির করে তোলে। কারন ওগুলোর সাথে নিজের ও সন্তানদের বর্তমান আর ভবিষ্যত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কানাডায় যখন প্রথম আসি তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন স্টিফেন হার্পার। উনি ছিলেন কনজারভেটিভস্ পার্টি থেকে আসা। তখন ঐ দলই সরকার গঠন করেছিল। তখন কানাডায় অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল। চাকুরীবাকুরী পেতে হিমশিম খাচ্ছিলাম।
তখন বুঝতে পারলাম অর্থনৈতিক মন্দা কাকে বলে? কারন তখন কোন মতে দিনগুজরান করছিলাম। তারপর কনজারভেটিভসরা গেল। জাস্টিন ট্রুডোর নেতৃত্বে লিবারেল পার্টি ক্ষমতায় এলো। অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হল। বাড়ির দাম হুরহুর করে বাড়তে লাগল। বাইরে থেকে অভিবাসীরাও বানের মত আসতে লাগল। দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও লিবারেলরা সরকার গঠন করল। ২০১৯ সালে আসল কভিড এলো। তাও গেল। কভিড মোকাবেলা করতে গিয়ে জাস্টিন ট্রুডো কানাডার অর্থনীতিকে অনেকটা দুর্বল করে ফেলল।
কভিড পরবর্তি সরকারের অভিবাসন নীতিও কানাডার আবাসন সমস্যাকে বেশি প্রকট করে তুলল। সেটা এখনো তা বিদ্যমান। অনেকটা সে জন্যই জাস্টিন ট্রুডোকে আজ বিদায় নিতে হল। তবে অভিবাসীরা জাস্টিন ট্রুডাকে মনে রাখবে তার প্রোঅভিবাসী নীতির কারনে। এখন নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন মার্ক কার্নি। এক সময় তিনি কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। ব্যা্ংক ইংল্যান্ডেরও গর্ভনর ছিলেন। কারন তিনি ব্রিটিশ নাগরিকও। আগামী অক্টোবরে কানাডার সাধারন নির্বাচন হওয়া কথা। তিনি হয়ত তার আগেই পার্লামেন্ট নির্বাচন দিবেন। কারন পার্লামেন্টে তার সদস্য পদ।নেই। মানে নির্বাচিত নন। উনি টেকনোক্রাট হিসেবে প্রধানমন্ত্রী হবেন।
সেজন্য খুব দ্রুতই হয়ত নির্বাচন হবে। অনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কানাডার জনগন পছন্দ করেনা। তা গনতন্ত্রের জন্য ভালোনা।খুব খারাপ অভ্যাস। বাংলাদেশে এখন একটি অনির্বাচিত অন্তরবর্তি সরকার ক্ষমতায়। গত সাত মাসে তাঁরা তেমন কোন পরিবর্তনই দেখাতে পারলনা। তেলেসমাতি তো দূরের কথা। স্বাভাবিক যে সমস্ত কার্যক্রম, যেমন দ্রব্যমূল্যও নিয়ন্ত্রন ও আইনশৃংখলা রক্ষা করতেও তারা ব্যার্থ হলেন। যদিও অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের সামনে।
সংস্কারের দোহাই দিয়ে সরকার এখন জাতীয় নিবার্চন দেয়া নিয়ে গড়িমসি করছে বলে মনে হচ্ছে যা অনাকাংখিত। পাঁচ অথবা চারবছর পর পর নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠ নির্বাচন হলেই বাংলাদেশের অর্ধেক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা মিটে যাবে। সেই সাথে সংস্কারও হবে। কাজেই নির্বাচন দিয়ে দেয়াই ভালো। কিন্তুু সমস্যাহল বাংলাদেশে সব সরকারের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার প্রবনতা দৃষ্টিকটু হলেও ক্ষমতায় থাকা লোকজনের লজ্জা শরমের বালাই দেখা যায়না। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত না হওয়াও আমার দেশ ছাড়ার একটা বড় কারন ছিল।
বাংলাদেশে এক এগারোর পরে সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকার দেখলাম। তারপর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসল। আওয়ামীলীগ সেই যে ক্ষমতায় গেল আর ক্ষমতা ছাড়লনা। পনের বছর পর জনগণ আওয়ামীলীগকে জোর করে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করল। গত পনের বছরে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলনা। গত সাত মাসেও না। সামনে হবে কীনা সন্দেহ। জুলাই-আগষ্ট গনঅভ্যুত্থানের পরে দেশ যেভাবে অস্থিতিশীল হচ্ছে, তাতে আশাহীন হচ্ছি দিন দিন।
এদিকে শুনছি ডনাল্ড ট্রাম্প আগামী জুলাইয়ে কানাডাতে ৫১তম ষ্টেট বাসানোর ফাইনাল ট্রাম্প কার্ডটা খেলবেন। পহেলা জুলাই কানাডার স্বাধীনতা দিবস মানে কানাডা ডে। সেটাও একটা কনসার্ন। অবশ্য বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তার বিদায়ী ভাষণে বলেছে, কানাডার গনতন্ত্র ও স্বাধীনতা কারো দানে পাওয়া নয়। এটা আমরা অর্জন করেছি।
এটাকে টিকিয়ে রাখতে সব কানাডিয়ানকে এক সাথে কাজ করতে হবে। নতুন হতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নির সুর আরো চড়া। নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য শুনে ভালো লাগে। আশা জাগে মনে। দেশ নেতাদের বক্তব্য তো এরকমই হতে হয়। আমার দুটো দেশ। বাংলাদেশ ও কানাডা-উভয়েই এখন সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আশা করি দুটো দেশই পথ হারাবেনা। সব সংকট কাটিয়ে উঠবে।
স্কারবোরো, কানাডা