12.8 C
Toronto
বুধবার, মার্চ ১৯, ২০২৫

স্মৃতির পাতা থেকে

স্মৃতির পাতা থেকে - the Bengali Times
জীবনের পথে চলতে চলতে অনেকটা পথই চলে এসেছি স্মৃতির ডাকে যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন অনেক কিছুই মনে হয় ঝাপসা হলদেটে

জীবনের পথে চলতে চলতে অনেকটা পথই চলে এসেছি। স্মৃতির ডাকে যখন পেছন ফিরে তাকাই তখন অনেক কিছুই মনে হয় ঝাপসা, হলদেটে। আবার কখনো অবসর সময়ে যখন স্মৃতির খাতা খুলে বসি আর একের পর এক পাতা উল্টাতে থাকি তখন দেখি অযতেœ কত পাতায় ধুলো জমে গেছে। কত পাতার লেখা ঝাপসা হয়ে গেছে, কত পাতা ঝরেও পড়ে গেছে। আবার দেখি স্মৃতির খাতায় কোনো কোনো নাম এখনো স্পষ্ট হয়ে লেখা আছে।

‘কাজী হাবিবুর রহমান’। এটাই ছিল তার পুরো নাম। সব হাবিবুরের ডাক নাম হয় হাবিব, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। তিনি পরিচিত ছিলেন হাবু নামে। হাবু নামটা বলার সাথে সাথে একজন হাবাগোবা মোটাসোটা মানুষের চিত্র ফুটে উঠে। কিন্তু তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি ছিলেন সুদর্শন, আধুনিক, রোমান্টিক এক যুবক। দীর্ঘ দশ বছর তিনি আমাদের সাথে কাটিয়েছেন। আমাদের ছোটবেলার সমস্ত স্মৃতিই তাকে ঘিরে। আমাদের ফুপাতো ভাই ছিলেন এই কাজী হাবিবুর রহমান, আমাদের হাবু ভাই। কলেজে পড়ার জন্য আমাদের বাড়িতে তার থাকতে আসা, যেটা হাবু ভাইয়ের মামার বাড়ি। তারপর দীর্ঘ দশ বছর তিনি কাটিয়েছেন মামার বাড়িতে। আমাদের ফুপু মারা গিয়েছিলেন হাবু ভাইদের নয় ভাই-বোনকে ফুপার উপর ফেলে রেখে। নয় সন্তান নিয়ে ফুপার দ্বিতীয় বিবাহ করা সম্ভব হয়নি। এই নয় সন্তানকে লালন পালন করতে করতে স্কুলের হেড মাস্টার ফুপা কিছুটা ছিটগ্রস্থ হয়ে গিয়েছিলেন।

- Advertisement -

মামার বাড়ির কোনো অধিকারই আদায় করতে কার্পণ করেননি হাবু ভাই। কিন্তু তাকে কিছু দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। আমরা ভাই-বোনরা যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়লে আমাদের যার যার বিছানায় শোয়ানো, মশারি লাগিয়ে দেয়া, আমাদের হাত ধরে স্কুলের ভেতর পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া।  বৈশাখী মেলায় নিয়ে গিয়ে আমাদের জন্য মাটির পুতুল, মাটির ব্যাংক, কাঠের ঠুকঠুকি কিনে দিতেন। পাঁচ টাকার জিনিস কিনে মাকে বলতেন দশ টাকা খরচ হয়েছে। হাবু ভাইয়ের হাতে যখন টাকা পয়সার টানাটানি পড়তো তখন হাবু ভাইয়ের বাজারে যাবার খুব সখ হতো। মাকে বলতেন, মামী আমি আজ বাজারে যাবো। কাজের মানুষের বাজার খেতে খেতে মুখের রুচি চলে গেছে। মা বলতেন, কেন তুই বাজারে যাবি, তোর কলেজে যেতে হবে না? হাবু ভাই নির্বিগ্নে বলে দিতেন, না মামি আজ যেতে হবে না কলেজে। আজ কোনো দরকারী ক্লাস নাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাবু ভাই যেদিন বাজারে যেতেন সেদিন বাজারে বড্ড বেশি আকাল পড়ে যেত। জিনিস পত্রের দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যেত। কুড়ি টাকার বাজার এনে চল্লিশ টাকার হিসেব দিতেন। মা সবই বুঝতেন, কিন্তু কিছুই বলতেন না। শুধু বলতেন, হাবু শোন তোর টাকা পয়সার টান হলে আমাকে বলিস্ না কেন? এটা তো তোর মামারই বাড়ি। আমার মার একটা অভ্যাস ছিল বাজারের ফিরতি টাকা আঁচলে বেধে রাখা। হাবু ভাই সে সুযোগ কখনো হাতছাড়া করতেন না। মার পেছনে দাঁড়িয়ে গল্প করতে করতে টাকা খুলে নিয়ে যেতেন। মা যখন দেখতেন আঁচলের টাকা নেই তখন হাবু ভাইকে জিজ্ঞেস করতেন, হাবু আমার টাকাগুলি কোথায় গেল রে? হাবু ভাই হালকাভাবে জবাব দিতেন, কী জানি কোথাও পড়ে গেছে হয়তো। এ ছিল মোটামোটি হাবু ভাইয়ের চরিত্র।

হাবু ভাই ইন্টারমেডিয়েট পাশ করে বিএ ভর্তি হলেন। তখন হাবু ভাই ভীষণ রোমান্টিক একজন তরুণ। হাবু ভাইয়ের গানের সুরে সবার কান ঝালাপালা। কখনো উদাস হয়ে গাচ্ছেন ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’ কখনো করুণ সুরে গান ‘এত সুর আর এত গান যদি কোনোদিন থেমে যায়।’ আমাদের খালাতো বোন শিমুল আপার আসা যাওয়া খুব বেশি তখন আমাদের বাড়িতে। কলেজ শেষে প্রায়ই চলে আসতেন মার সাথে গল্প করতে। মাকে দুচারদিন না দেখলে যেন শিমুল আপার জান অস্থির। হাবু ভাই, শিমুল আপা আসলেই আমাদের সাথে খুব খাতির জমাতেন। আমাদের হাত দিয়ে শিমুল আপার কাছে চিঠি পাঠাতেন। আমাদের বলতেন দেখিস্ চিঠিটা যেন কেউ না দেখে। যদি ঠিকমত শিমুলের হাতে চিঠিটা দিতে পারিস্ তাহলে কাল স্কুলের সামনে থেকে তোদের দুই আনা দামের মালাই আইসক্রিম কিনে খাওয়াবো। আমরা ভাই-বোনরা আইসক্রিম খাওয়ার লোভে নিষ্ঠার সাথে কর্তব্য পালন করতাম। কিন্তু শিমুল আপা একটা চিঠির জবাবও কোনোদিন দেননি। কিন্তু খুব আগ্রহ সহকারে তিনি মাকে লুকিয়ে আমাদের হাত থেকে চিঠি নিতেন। শিমুল আপা বাড়িতে এলে হাবুভাই বারান্দায় হেঁটে হেটে গাইতেন, ‘ও পলাশ ও শিমুল কেন এ মন মোর রাঙালে…। ’ হাবু ভাই বিএ পরীক্ষা দিলেন কিন্তু শিমুল আপার প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে বিএ পাশ করতে পারলেন না। সে লজ্জায় হাবু ভাই গ্রামে গিয়ে তিন মাস ডুব দিয়ে থাকলেন। তিন মাস পর ফিরে এসে আবার তৈরি হতে থাকলেন পরীক্ষা পাশের জন্য। পরীক্ষার দুই মাস আগে শিমুল আপার বিয়ে ঠিক হলো অন্য জায়গায়। একমাসের মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল। শিমুল আপার বিরহে হাবু ভাই আবারো বিএ ফেল করলেন। এবার তৃতীয় বার বিএ পরীক্ষা দেবার জন্য হাবু ভাই তৈরি হলেন। এবার কোনো মেয়েকে হাবু ভাই প্রেমপত্র লিখলেন না। প্রেমের গান না শুধু, সে বছর হাবু ভাই কোনো গানই গাইলেন না। রাতদিন পড়াশুনায় ডুবে থাকলেন। সে বছর হাবু ভাই বিএ পাশ করলেন। আমার মা ভাগ্নের তিন বারে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় এতটাই আনন্দিত হলেন যে সারা পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করা হলো।

সৌভাগ্যবশতঃ হাবু ভাইয়ের একটা সরকারি চাকরিও হয়ে গেল। এখন হাবু ভাইয়ের মাথায় আরেক চিন্তা, বিয়ে করতে হবে। সবকিছু হারালে পাওয়া যায় কিন্তু বয়স হারালে কোথায় তাকে খুঁজে পাবে? এ নিয়ে দুদিন পরপরই হাবু ভাই মায়ের সাথে মিটিং বসায়। মা হাবু ভাইকে বলেন, ‘হাবু কেবলই তো চাকরিটা হলো, কিছু পয়সা জমা, তারপর বিয়ে করিস।’

ম্যালন্টন, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles