
সন্ধ্যামালতী যত্ন করে সময়কে তুলে দিয়েছে ঢেউয়ের ওপর। দোল দোল বলে যাচ্ছে তার দিন-ক্ষণ রাত্রি যাপন।
এক হাতে মিহি সূর্য কিরণ অন্য হাতে জ্যোৎস্নার আলো নিয়ে প্রতিদিন সে একই সাথে অনুভব করেতে চায় প্রিয় মানুষের উপস্থিতি এবং দূরত্ব। ফুলতোলা কাপে মিশে যাওয়া গাঢ় বাদামি রঙ তার দৃষ্টি কাড়ে। সেখানে পায় জোয়ারভাটার টান। টুং টাং জীবন ঘণ্টা বাজে চায়ের কাপে। যতটা হয়নি পাওয়া তাও যদি অপূর্ণ থেকে যায় বাকী জীবন ক্ষতি নেই তবে, রয় যেন কাছে কাছে পাবার সহজ তরিকা। এর নামই স্বপ্ন। এও এক ধরনের একা থাকা থেকে উত্তরণ।
সন্ধ্যামালতী সম্প্রতি তার ডায়রিতে লিখেছে উড়ন্ত ঘুড়ির মতন একহাত রঙিন জীবন চাওয়া মোটেও ভুল নয়। যাপিত চলাচল আর বারেক ফিরে দেখা দুটোই বিশ্বাস। আসুন একটু দেখে আসি তার বর্তমান সময়।
আলসেমো দেহ জানালা থেকে সরিয়ে এনে সন্ধ্যামালতী আবারো যখন ফিরে আসে বিছানায়, সেইসমস্ত ছুটির দিনে সে আর একা থাকে না। মাঝ বয়সী সন্ধ্যামালতী একটি ছায়া মুখ কল্পনা করে আদর দৃষ্টি নিয়ে চেয়ে থাকে নিজ বালিশে মাথা রেখে। স্বপ্ন আর দিনক্ষণ গোল্লাছুট খেলে তার দৈনন্দিন কাজে। এরই মাঝে ফুলতোলা ভালোলাগা তুলে রাখে অদ্ভুত জাদুমন্ত্রে। কেউ বঞ্চিত হয় না তাদের অধিকার থেকে আবার স্বপ্নকেও ফিরিয়ে দেয় না সে। রাখে যত্ন করে।
এমন চাওয়া-পাওয়া একধরনের অহংকার বলে তার মনে হয়। নাই নাই এর মাঝেও মিলন সম্ভাবনার ভাঁজ ভেঙ্গে দেখে অবসরে। দূরবীন পত্র লেখে ভগ্ন ঠিকানায়। যায় কি না যায় তা নিয়ে ভাবে না অতোটা বেশি।
বেশ কিছুদিন হলো স্বপ্ন উঁকি দেয় না, কথা কয় না। চিরকুট আসে না। এভাবেই গেল অনেকগুলো দিন।
তাই একদিন টুকটাক তথ্য ঠিকানা জোড়াতালি দিয়ে ভ্রমণে নেমে পড়ে। ছোটবেলা থেকেই সে চঞ্চল, খানিকটা এক রোখা। পাত্তাটাত্তা দেয় না অনেক ভারি মাপের ভদ্রতা। যে আমার মতন হতে পারবে না থাকুক সে তার মত করে, এই তার শেষ কথা।
সন্ধ্যামালতী বিশ্বাস করে আকাশের ওই চাঁদ বুঝি তার বুকের একটি পাঁজর দিয়ে গড়া। নয়তো চাঁদ কেন এতো সাদাকালো? জীবনের রঙ যেমন এলোমেলো অথবা সে নিজে যেমন সম্পূর্ণ রঙিন হতে পারলো না কখনো। তাই পড়ন্ত বিকেলে পুরোপুরি না ভেঙ্গে কিছুটা খুলে দিয়েছিল নিজেকে। জানালা যেমন চায় আসুক কিছুটা বাতাস ভেতরে।
ঠিকানা বলে তেমন কিছু ছিল না হাতে শুধু স্থান কাল পাত্র। এথায় ওথায় গিয়ে খুঁজে নেবে তার স্বপ্নের চালাঘর। এখন সব দেশেই স্কুল সহপাঠীরা থাকে কিংবা মহল্লার বন্ধুবান্ধব। তারা কি কেউ সাহায্য করবে না। অথবা তার এক্স? এতোটুকু পেলেও তো তাকে মানুষ বলা যায়। তাই নয় কি?
যাকে খুঁজতে আসা তার বয়স এগিয়েছে সময়ের সাথে সাথে। আগের থেকেই তিনি ছিলেন কিছুটা অগ্রজ। জীবনের পুরোটা সময় শুধু বিশ্রাম আর প্রস্থান আসে তড়বড়িয়ে। সমুদ্র উড়ে ভিনদেশে এসে সে জানতে পারে জোড়া লাগানো ঠিকানা এখন গিয়ে মিলেছে কবরস্থানে।
গুলিস্তান আর কবরস্থান কি একই কবির আবিষ্কৃত শব্দ? স্মরণ থাকে যেন, সন্ধ্যামালতী নিজেও আর আগের বয়সে নেই। সঙ্গত কারণে তাকে বলা যায় রজনীগন্ধা। সে ভাবছে কবরও একটা ফুলদানী। কিন্তু যিনি জীবন্ত ফুল হাতে তুলে নিতেন না কখনো তারই বুকে ফুল দেওয়া কি ঠিক হবে? তিনি বলতেন ফুল ছিঁড়লে মা গাছ অভিশাপ দেবে। হাতের ফুল বড্ড বেশি অনাথ।
রজনীগন্ধা লাল গোলাপ কবরে না রেখে কবরীতে গুঁজে নেয়। তারপর বিড়বিড় করে পড়তে থাকে মিহি কালো সমাধি লিপি।
‘সবাই ভুলে গেছে তুমি কেন কষ্ট করতে গেলে’
হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না রজনীগন্ধা। তবুও মুখ ফুসকে বেরিয়ে গেল, ইশ কি বিশ্বাস ছিল, কবে বলেছিলাম আমি আসবো?