
সকালে শলার ঝাড়ু হাতে নিয়ে রাহির মা তারা কে বললো –
-উঠানে এমন পাতা পরে আছে। নিজে দেখে কি ঝাড়ু দেয়া যায় না এক বেলা?
তারা বিচলিত হয়ে উঠলো। বিশাল উঠান এই উঠান যে ঝাড়ু দিতে হয় এই কথা টা তো মাথাতেই আসেনি। বাসায় মাঝেমধ্যে একবার দু’বার রুম ঝাড়ু দিয়েছে তাও নিয়মিত নয়।
রাহির মায়ের কাছ থেকে চুপ করে ঝাড়ু টা হাতে নিয়ে উঠান ঝাড়ু দিতে নেমে গেলো তার। নিজের উপর নিজেরই রাগ জন্মে গেছে। এই সময়ে প্রাইভেট পড়তে যেতো,প্রাইভেট না থাকলে স্কুলের পড়া টা রিভিশন দিত। মা কফি দিয়ে যেতো। নিজের হাতে ধরে নিজে জীবন টা এভাবে ও নষ্ট করা যায়। এই কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কয়েক ফোঁটা চোখের জল মাটির উঠানে পারতেই শুকিয়ে গেল।
কিছুক্ষণ পরে রাহি রেডি হয়ে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর থেক বের হয়ে এসেছে।
রাহি কে দেখলে কে বুঝতে পারবে গ্রামের এই পরিবেশে এই ছেলেটা বড় হয়েছে।
তারা বিস্ময় চোখে জিজ্ঞেস করলো-
-কোথায় যাচ্ছো?
-ঢাকা।
-কই আমাকে তো কিছু বলোনি,ঠিক আছে সমস্যা নেই আমি রেডি হয়ে আসছি। মাত্র দুই মিনিট লাগবে।
-তুমি এখানেই থাকো। আমি পনেরো দিন পরে আসবো।
– কিন্তু তুমি বলেছিলে, আমরা কেউ কাও কে ছাড়া এক মুহূর্তের জন্য কোথাও থাকবো না। তাছাড়া তুমি চলে গেলে এখানে আমি একা একা কি ভাবে থাকবো?
-তুমি এই বাড়ির বউ। একা থাকা শিখতে হবে। আমি ইনকাম না করলে চলবে কি করে।
-আমি তোমার সাথে চলে যাবো। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
-দেখো তারা পাগলামি করো না। তাছাড়া তোমার মা-বাবা কি কোন খোঁজ খবর নিয়েছে তোমার। তুমি ঢাকা গিয়ে কোথায় থাকবে?
-আমি তোমার সাথে থাকবো।
-ওফ্ফ একদম ন্যাকামি করবা না বলে দিলাম। যাও আম্মা শুনলে কিয়ামত হয়ে যাবে।
তারা রাহির হাত শক্ত করে ধরে বললো –
-আমি এখানে একা থাকতে পারবো না। আমি তোমার সাথে যাবো, যাবো।
রাহি রাগ করে তারাকে ধাক্কা দিতেই,তারা ছিটকে পরলো টিনের ছাউনি দেয়ে হাঁস মোরগের ঘরের উপর। সাথে সাথে মাথা কেঁটে রক্তে চারপাশ ভরে গেলো।
গ্রামের বাজারে ফার্মেসিতে বসে প্যারামেডিক ডাক্তার দেবেন্দ্রনাথ পাল। সেই ডাক্তারের খোঁজে বের হলো রাহি। রাহির মা তারার মাথা চেপে ধরেছে ঠিক,দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলছে –
-আমার হইছে জ্বালা। নাটক সাজাইছে। নিজের নাটকই শেষ করতে পারি না।
ডাক্তার কে ফার্মেসি তে পাওয়া গেলো না। বাড়ি থেকে রিকশা করে নিয়ে আসলো। তারা কে দেখো ডাক্তারের চুক্ষুচরক গাছ। তারার চিকিৎসা শেষ করলো। রাহির মা এক গ্লাস গরম দুধ ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বললো-
-দেখেন তো দেব বাবু কি একটা ঝামেলায় ফেলছে পুলা ডা।
ডাক্তার রাহির পিঠে ঠাস করে একটা থাপ্পর দিয়ে বললো-
-রাহি, এই মেয়ে কে রে?
-কাকা বাবু বউ। বিয়ে করছি।
-কবে বিয়ে করলি,কিছু তো জানলাম না।
-করছি আর কি, বুঝেন না।
-দেখে তো মনে হচ্ছে অনেক বড়লোকের মেয়ে। তুই এতো বড় সাহস করলি কি করে?
-জানি না কাকা বাবু।
-এই পরিবেশে ও থাকতে পারছে? মেয়ে টা অসুস্থ হয়ে যাবে তো।
-পারবে কাকা বাবু।
-তোরা এখনকার পোলাপান কি বুঝে, কি করিস বলতো? একটা বড়লোকের মেয়ে পেলি, পটিয়ে বিয়ে করে ফেললি। মেয়েটা কে সেই অবস্থায় রাখতে পারবি কি না। মেয়ের মা বাবা যদি কোন ব্যাবস্থা গ্রহণ করে কুলিয়ে উঠতে পারবি কি না এসব ভেবছিস।
– আস্তে কথা বলেন কাকা,চলেন আমার সাথে বাহিরে গিয়ে কথা বলি।
-নিজের মা-বাবার কথা তো ভাবিস না। অন্তত মেয়েটার মা-বাবার কথা চিন্তা কর। এই মেয়ের তেল সাবানের খরচ বহন করার ক্ষমতা তোর আছে।
-এজন্যই তো ঢাকা যাচ্ছি। তাছাড়া মেয়ে খারাপ আছে শুনলে মা-বাবা কি সাহায্য করবে না।
-তোদের মাথায় এসব কু-বুদ্ধি দেয় কে? কেউ নিশ্চয়ই সম্পাদ গড়ে কাউ কে দান করে দেওয়ার জন্য না।
রাহি ডাক্তারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো –
– কাকা বাবু আসেন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
তারা কারো সাথে কোন কথা বলছে না। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় এই যে ব্যাথা পেলো, এতো কিছু হয়ে গেলো সে একদম কান্না করেনি।
এইসব ভাবতে গিয়ে তারা অনুভব করতে পারলো একটা সময় মানুষ আর কান্না করে না। তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে এই জায়গা থেকে বের হয়ে নিজে কে বাঁচাতে।
তারা চিন্তা করতে থাকলো,যে সম্পর্কে গায়ে হাত তোলা হয় সেটা আসলে কোন সম্পর্কের পর্যায়ে থাকে না। কত টা হিংস্র আর অমানুষ হলে গায়ে হাত তুলে। এখানে আর কোন মায়া বা টান রাখা যাবে না। এই জায়গায় কোন ভবিষ্যত নেই। সবচেয়ে বড় কথা মায়ের মনে এতো বড় আঘাত দেয়ার পরে কি ভাবে ফিরে যাবে। তারার ভাবনার রেশ কাটলো খট্ করে একটা শব্দ শুনে
রাহির মা একবার এসে একটা ডিম সেদ্ধ আর মুড়ির বাটি কাঠের ভাঙা চেয়ারের উপর রেখে দ্রুত পায়ে বের হয়ে গেলো।
——-
তারার বাবা তরু কে কল দিয়েছে-
– হ্যালো,তরু কেমন আছো?
– ভালো না।
– ভালো থাকার জন্য তো বিয়ে করছো,তবে এখন ভালো নেই কেন?
তরু তার প্রাক্তনের স্বামীর কথা শুনে মারাত্মক রকম রেগে গেছে। পা’য়ের রক্তে টা জেনো চট করে মাথায় উঠে গেছে।
– শোন জোনায়েদ, খারাপ থাকার সকল ব্যাবস্থা করেছো তুমি। আজকে এই দিন আমার দেখা লাগতো না। আমাদের মেয়েটা সুন্দর একটা জীবন উপভোগ করতে পারতো। বিয়ে টা আমি নিশ্চয়ই আনন্দে করিনি। একটা সময় দেখলাম মেয়ে কে নিয়ে একা থাকা যাচ্ছে না,তখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর তোমাকে নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না,তোমরা পুরুষ রা কত সুযোগ সন্ধনী।
-তরু তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো? শোন তুমি চাইলে তারা কে নিয়ে আমরা আবার এক সাথে সংসার শুরু করবো।
-ছিঃ তুমি কি মানুষ। যখন যা মনে আসে তখন তাই করো। তোমার সাথে কথা বলা টা ও তো পাপ।
ফোন রাখ,তোমার সাথে কোন কথা বল তে চাইছি না।
-তরু,শোন পৃথিবী তে এমন অনেক কঠিন ঘটনা ঘটে৷ তার মধ্যে এই ঘটনা তেমন কঠিন কিছু না। তুমি চাইলে তানভীরের সাথে কথা বলতে পারি। তারা নিজের মা-বাবা পাবে।
-তোমার বউ কোথায়?
-বারো ভাতারি টা চলে গেছে।
-তোমারা পুরুষ রা পার ও বটে। বারো ঘাটের পানি ও তো তুমি কম খাওনি। তোমার বউ যদি বারো ভাতারি হয় তুমি বারো ভাইত্তা। সমস্যা কি জানো তোমরা গালিগালাজ উদ্ভাবন করো। মহিলারা উদ্ভবন করে না বিধায় তোমাদের নিয়ে কোন গালি নাই বাংলা অভিধানে।
তরুর কথা শুনে জুনায়েদ চুপ করে চিন্তা করছে এটা কি সেই তরু?