3.7 C
Toronto
সোমবার, মার্চ ৩১, ২০২৫

হাবু ভাই

হাবু ভাই - the Bengali Times
হাবু ভাই কিছুদিন চুপ থাকে আবার মিটিং করে মায়ের সাথে

হাবু ভাই কিছুদিন চুপ থাকে আবার মিটিং করে মায়ের সাথে। হাবু ভাইয়ের বক্তব্য, এ বছর না সে বছর মানুষ বাঁচে কয় বছর মামী। মা বাধ্য হয়ে হাবু ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করলেন। মেয়ে দেখা হলো, মেয়ে পছন্দ হলো। হাবু ভাইয়ের বাবা এলেন বিয়ের কথা পাকাপাকি করতে। পাকা কথা হলো পানচিনি হলো, সবই হলো। বিয়ের তারিখ ঠিক হলো ছয় মাস পর। এর মাঝে হাবু ভাইকে চাকরি থেকে কুষ্টিয়া বদলি করা হলো। হাবু ভাইয়ের মনের কষ্ট আবার শুরু হলো। বিয়ের আগে হবু বউয়ের সাথে একটু দেখা সাক্ষাৎ করবে, গল্পগুজব করবে, তা আর হলো না। কী আর করা, ছুটি নিয়ে এসে বিয়ে করবে, তারপর বউ নিয়ে কুষ্টিয়া চলে যাবে, সে সিদ্ধান্ত হলো।

হাবু ভাই চলে গেলেন কুষ্টিয়া। এদিকে ঘটনা ঘটে গেল অনেক। হাবু ভাইয়ের বাবা, আমাদের ফুপা মেয়েপক্ষকে বিরাট চিঠি পাঠালেন, তিনি যৌতুক ছাড়া ছেলেকে বিবাহ করাবেন না। মেয়েপক্ষ ক্ষিপ্ত হয়ে বিয়ে ভেঙে দিল। আমার মা বহু চেষ্টা করলেন বিয়েটা যেন না ভাঙে সে ব্যাপারে। ছেলের বাবা একটু পাগল গোছের মানুষ, তার কথায় যেন তারা আমল না দেন, তাও বললেন। কিন্তু মেয়েপক্ষকে আর রাজী করান গেল না। মা হাবু ভাইকে চিঠি লিখে পাঠালেন, হাবু দু চারদিনের জন্য এসে ঘুরে যা, তোর সাথে বিয়ে সংক্রান্ত ব্যাপারে কথা আছে। হাবু ভাই চিঠি পাওয়ার দুদিন পরই হাসিমুখে কুষ্টিয়ার আম, মিষ্টি শ্বশুরবাড়ি ও আমাদের জন্য নিয়ে হাজির হলেন। এসেই মাকে হাবুভাই বউয়ের কথা নানাভাবে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। মা হাবু ভাইকে আসল ঘটনাটা জানালেন। হাবু ভাই রাগে দুঃখে কেঁদে ফেললেন। হাত তুলে আল্লহ্কে বললেন, হে আল্লাহ্ এমন কুৎসিত মনের পিতা তুমি দুনিয়াতে পাঠিও না, যে পিতা তিনবারে বিএ পাশ করা ছেলের জন্য যৌতুক দাবী করে। হাবু ভাই মেয়ে পক্ষর সাথে দেখা করে পিতার পক্ষ থেকে তাদের কাছে মাফ চাইলেন, কিন্তু মেয়েপক্ষ রাজী হলো না। হাবু ভাই মনে এক রাস ব্যথা নিয়ে কুষ্টিয়া ফিরে গেলেন। হাবু ভাই দুই বছর আর কুষ্টিয়া থেকে ফিরে এলেন না। মাঝে মধ্যে মাকে দু-একটা চিঠি লিখে কুশল সংবাদ জানিয়েছেন এই যা। এবার মার কাছে হাবু ভাইয়ের অন্যরকম একটা চিঠি এলো। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন-

- Advertisement -

মামী,

সালাম নিবেন। মামাকেও আমার সালাম জানাইবেন। দীর্ঘদিন আপনাদের খোঁজ খবর নিতে পারি নাই বলিয়া মনে কষ্ট নিবেন না। মামী আমার বয়স দিন দিন বন্যার অবরুদ্ধ পানির মত বাড়িয়া চলিয়াছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আপনি এবং মামা কোনোরূপ চিন্তিত না। তাই আমি নিজে সিদ্বান্ত নিয়া গত সপ্তাহে বিবাহ করিয়া ফেলিয়াছি। মেয়েটি উচ্চ শিক্ষিতা। একটি বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষিকার পদে নিয়োজিত আছে। মেয়েটি তেমন সুন্দরী না হইলেও কুৎসিত নয়। তাছাড়া আমার এখন সুন্দরী মেয়ের জন্য বসিয়া থাকিবার সময় নাই। একাকী জীবনে আমি ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি। আগামী মাসের প্রথম রবিবার আপনাদের বউমাকে নিয়া আপনাদের কাছে আসিতেছি। ট্রেন কয়টায় পৌঁছাইবে সে খোঁজ নিয়া স্টেশনে গাড়ি পাঠাইবেন।

আপনাদের স্নেহের

হাবু

বি.দ্র. মামি আমার কুৎসিত মনের পিতাকে আমার বিবাহের এবং বউ নিয়া আসিবার খবর জানাইবেন না, তাহা হইলে তিনি হয়তো যৌতুকের জন্য আমার বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ছুটিয়া আসিবেন।

যথাদিন যথাসময়ে স্টেশনে গাড়ি পাঠানো হলো। মা, ভাগ্নে বউয়ের জন্য রান্নাবান্না করে তৈরি। আমরা ভাই-বোনরাও ভালো কাপড় চোপড় পরে কাগজের ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম নতুন ভাবীর জন্য। আমাদের যেন উত্তেজনার শেষ নেই। গাড়ি এসে দাঁড়ালো। হাবু ভাই হাসিমুখে নামলেন গাড়ি থেকে। হাতে দুই বাক্স মিষ্টি। হাবু ভাইয়ের সাথে নামলেন একজন বেশ মোটাসোটা কুচকুচে কালো না হলেও মোটামুটি কালোর পর্যায়ে ফেলা যায়, শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দেয়া একজন মহিলা। আমরা ধরে নিলাম ভাবীর সাথে হয়তো মহিলাটি এসেছে ভাবীর কোনো আত্মীয়া। আমরা ভাবীর নামার অপেক্ষায় উঁকিঝুঁকি দিতে লাগলাম। মা-ও মিষ্টির প্লেট নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকলেন বউকে মিষ্টিমুখ করাবেন বলে। নাহ্ গাড়ি থেকে আর কেউ নামলো না। হাবু ভাই হৈ চৈ করে বললেন, এই দেখ তোদের ভাবীকে নিয়ে এসেছি। ভাবীকে দেখে আমরা ঘাবড়ে গেলাম। যে মালা ভাবীকে পরাবো বলে দাঁড়িয়েছিলাম, সেগুলো আমরা হাবু ভাইকে পরিয়ে দিলাম। হাবু ভাই হায় হায় করে উঠলেন, করিস্ কী? করিস্ কী? মালা তো তোদের ভাবীকে পরাবি, আমাকে পরাচ্ছিস্ কেন? এই বলে নিজেই ভাবীকে নিজের গলা থেকে মালা খুলে পরিয়ে দিল। মা ¤øান হাসি দিয়ে ভাগ্নে বউকে মিষ্টি মুখ করালেন।

আমরা তখন ছোট। আমাদের আগ্রহের শেষ নেই কোনো ব্যাপারেই। হাবু ভাই আর ভাবীর থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল উপর তলার গেস্টরুমে। আমরা ভাই-বোনরা গুটিশুটি পায়ে উপর তলায় উঠে এলাম ভাবীর কার্যকলাপ অবলোকন করার জন্য। সিড়ি থেকেই হাবু ভাইয়ের নাসিকা গর্জন শুনতে পেলাম। দরজা খোলাই ছিল। ভাবী শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলেন। আমরা খুব সাবধানে উঁকিঝুঁকি দিলেও ভাবী সেটা বুঝে গেলেন। ভাবী ভেতর থেকে ভারী গলায় বলে উঠলেন, ‘কে ওখানে? ভাবীর সাথে ফাজলামো? সামনে আস কান মলে দেব’। আমরা ভাই-বোনরা ভয়ে দুমদাম শব্দ করে নিচে নেমে গেলাম। আমরা বুঝে গেলাম, ওরে বাবা এত ভাবী না, এ যে আমাদের স্কুলের অঙ্কের মাস্টার।

হাবু ভাই প্রচণ্ড আনন্দ-ফুর্তি করে আমাদের এখানে সাতদিন বেড়িয়ে গেলেন। হাবু ভাইয়ের মাঝে যেটা আমরা দেখেছিলাম, তিনি কুষ্টিয়ার ভাষা ছাড়া আর সব ভাষা ভুলে গেছেন। আমাদের ভাবী সাতদিনে শুদ্ধ বাংলায় আমাদের সাথে অনেক মাস্টারি করে গেলেন। আমরা উনাকে মোটেও পছন্দ করলাম না। হাবু ভাই বউ নিয়ে চলে যাবার পর আমরা ভাই-বোনরা কুষ্টিয়ার ভাষার চর্চা চালালাম কিছুদিন। সেটা আমাদের একটা মজার খেলা হয়ে উঠেছিল।

তারপর বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। হাবু ভাই বার দুয়েক এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে, ভাবী আর কখনো আসেননি। আমরাও ধীরে ধীরে হাবু ভাইয়ের অস্তিত্বটা প্রায় ভুলেই গেছিলাম। আমরা তখন কেউ কলেজে কেউ ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। এক ছুটির দিনের সকালে মহাহট্টগোল করে কে যেন বাড়িতে ঢুকলো শুনলাম। আমাদের সব ভাই-বোনদের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। আমরা সবাই বাইরে বেরিয়ে আসলাম। বেরিয়ে দেখলাম একজন লম্বা কোর্তা পড়া ও সাদা লম্বা দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। আমাদের দেখে মহা-আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলেন, এই তোরা আমাকে চিনতে পারছিস্ না? আমি তোদের হাবু ভাই। হাবু ভাইয়ের এই পরিবর্তন দেখে আমরা অবাক হলেও ভীষণ আনন্দিত হলাম। আমরা যেন সেদিন হাতে চাঁদ পেয়েছিলাম। বাবা-মাও খুব খুশি হলেন এতদিন পর হাবু ভাইকে পেয়ে। আমাদের দিনটা দারুন আনন্দে কাটলো হাবু ভাইকে নিয়ে। হাবু ভাই আমাদের রসিয়ে রসিয়ে শোনালেন আধুনিক জীবন থেকে এ জীবনে আসার কাহিনী। তিনি ঢাকায় এসেছেন একটি ইসলামিক সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য এবং সেখানে তিনিও একজন বক্তা। হাবু ভাই মাকে অনেক অনুরোধ করে গেলেন আমরা যেন সম্মেলনে যাই। মহিলাদের বসার ভালো ব্যবস্থা আছে তাও জানালেন। সম্মেলনের পর হাবু ভাই আমাদের এখানে এসে বেড়াবেন সে আশ্বাসও দিলেন। আমরা মহা-আনন্দে রাজী হয়ে গেলাম। কিন্তু হাবু ভাই চলে যাবার পর আমাদের সম্মেলনে যাবার আগ্রহও চলে গেল। হাবু ভাইকে কথা দিয়েও আমরা শেষ পর্যন্ত কেউই হাবু ভাইয়ের ইসলামি আলোচনা শুনতে গেলাম না। এতে হাবু ভাই মনে অনেক কষ্ট পেলেন এবং সে জন্য তিনি আর আমাদের বাসায় থাকতে এলেন না। কুষ্টিয়ায় যাবার আগে সে কথা তিনি আমাদের ফোন করে জানিয়ে গেলেন। আমরা সেদিন খুব লজ্জিত হয়েছিলাম হাবু ভাইয়ে কাছে। সম্মেলনে যাইনি বলে হাবু ভাই আমাদের বাসায় এলেন না, সেটা আমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছিল।

ম্যাল্টন, অন্টারিও

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles