2.1 C
Toronto
রবিবার, এপ্রিল ১৩, ২০২৫

আব্বার জন্য ভালবাসা

আব্বার জন্য ভালবাসা - the Bengali Times
স্বাধীনতার বেশ কবছর পর আব্বা বদলি হয়ে আসেন গাইবান্ধায়

স্বাধীনতার আগের বছরগুলোতে আমরা থাকতাম বদরগঞ্জে, আব্বার কর্মস্থলে। রেভিনিউ অফিসের বড়সড় একটি টিনের বাড়িতে। মাঝে মধ্যে দাদুর বাড়ী আসতাম। মনে পড়ে সেখানে যাওয়ার মাধ্যম ছিলো ট্রেন, বাস ও গরুর গাড়ী। কোথা থেকে কীভাবে যেতাম, চারপাঁচ বছরের একটি শিশুর তা মনে থাকার কথা নয়। শুধু মনে আছে ট্রেনের কামড়ায় আমাদেরকে বসিয়ে আব্বা নীচে নামতেন। আমরা জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখতাম আব্বা স্টেশনে পায়চারি করছেন। ট্রেনের গার্ড হুইসেল বাজালে আমরা বুঝতাম ট্রেন ছেড়ে দিবে। তখন কখনও জানালা দিয়ে, কখনও কামড়ার দরজার দিকে অস্থির হয়ে তাকাতাম। কু ঝিকঝিক করে ট্রেন চলতে শুরু করলে আমি কেঁদে ফেলতাম। মনে হতো আব্বাকে ছেড়েই ট্রেন চলে যাচ্ছে। মা তখন বকা দিয়ে চুপ করিয়ে রাখতেন। পরের স্টেশনে ট্রেন থামার একটু পরেই আব্বাকে দেখতাম আমাদের কামড়ার দিকে হেঁটে আসতে। তখন রাজ্যের ভীতি ঠেলে মনের মাঝে উঁকি দিতো একরাশ আনন্দউচ্ছাস।

যুদ্ধের আগেভাগে আব্বার পোস্টিং হলো নীলফামারীতে। আমাদেরকে বাড়িতে রেখে আব্বা জয়েন করেছিলেন সেখানে। ৭ মার্চের ভাষণ শুনে আব্বা বাড়ী চলে আসেন। বেশ লম্বা সময় ছিলেন আমাদের সাথে। যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর সরকার কঠোর আদেশ জারি করেন সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগদানের জন্য। আব্বা বুঝতেন দাদার যে জমিজমা আছে তা দিয়ে আমাদের খাওয়া হবে কিন্তু এতগুলো সন্তানের পড়াশুনা করানো সম্ভব নয়। আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্তে নিয়েছিলেন কর্মস্থলে যাওয়ার। যেদিন রওনা দিবেন সকাল থেকেই আমাদের সবার মনে কাল মেঘে ঢেকে আছে। বাড়ীর সামনে রিক্সা দেখে মাঝে মাঝেই কান্না চলে আসতো। যখন আব্বার রিকসা চলতে শুরু করলো, সে রিক্সার পিছনে দাদা দাদী, মা আর আমরা ক’ভাই কাঁদতে কাঁদতে অনেকদুর হেঁটেছিলাম। সন্ধ্যার পর আমরা যখন পড়তে বসেছিলাম, বাড়ীর সামনে রিকসার টুংটাং শব্দে দৌঁড়ে বের হয়ে দেখি আব্বা ফিরে এসেছেন। সেসময় মনে হয়েছিল এমন অপ্রত্যাশিত স্বর্গসুখ খুব কম এসেছিল ঐ ছোট্ট জীবনে। স্বাধীনতার জন্য উন্মুখ জনতা রাস্তায় গাছ কেটে ব্যারিকেট সৃষ্টি করেছিল বিধায় আব্বা তাঁর কর্মস্থলে যেতে না পেরে ফিরে এসেছিলেন।

- Advertisement -

স্বাধীনতার বেশ ক’বছর পর আব্বা বদলি হয়ে আসেন গাইবান্ধায়। তিনি বাড়ি থেকেই অফিস করতেন। তিনি কোনদিন আমাদের নিয়ে পড়তে বসেননি, তবে মনে প্রাণে চাইতেন আমরা পড়াশুনা করে মানুষ হই। অনেকগুলো ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ যোগাতে তিনি হিমশিম খেতেন। অফিস যাওয়ার সময় কোন ভাই হয়তো বলতো পরীক্ষার ফিস এর কথা, কেউ হয়তো বলতো খাতা, বই, কলম কালি কথা। কোনকিছু না বলে তিনি অফিস চলে যেতেন। আসার সময় বই, খাতা কলম কিনে এনে হাসিমুখে ডেকে হাতে দিতেন, কোনদিন না দিতে পারলে মন খারাপ করে থাকতেন। আমরা চেষ্টা করতাম মন দিয়ে পড়াশুনা করে আব্বাকে খুশি রাখতে। ভালো ফলাফল করলে তাঁর খুশি দেখার মতো ছিলো। পঞ্চম শ্রেণীতে আমি যখন বৃত্তি পেলাম, তিনি খুশির আতিশয্যে আমার স্কুল ও তাঁর স্কুলের সব শিক্ষককে দাওয়াত করে খাইয়েছিলেন।

আব্বা তাঁর সন্তানদের পড়াশুনা করানো ব্যতিরেকে তেমন কোন বৈষয়িক সম্পত্তি করতে পারেন নি। আমাদের গ্রামের বাড়িতে দাদার একটা ঘর ছিলো, আব্বা দুরুমের আর একটা ঘর করেছিলেন। অবসরের পর সেই বাড়ী নিয়ে আব্বার কত শ্রম। ঈদে আমরা যখন বাড়ী যেতাম, তার এক সপ্তাহ আগে থেকে বাড়ীঘর পরিস্কার করতেন, বাড়ীর সামনের প্রতিটি গাছের গোড়ায় চুন লাগাতেন। জানালা দরজায় নতুন করে রং করতেন। আমরা সবাই গিয়ে বিছানা মেঝেতে গাদাগাদি করে থাকতাম। বিছানার চেয়ে মেঝেতে শোয়ার জন্য আমাদের সন্তানদের মাঝে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। তখন আব্বা মা গিয়ে থাকতেন রান্নাঘরে। এমন অবস্থায় বাড়িতে গিয়ে আমরা আনন্দ করলেও আব্বার মনে হয়তো সামান্য দু:খবোধ ছিলো। শেষ বয়সে এসে তাই তিনি আর একটা ঘর তোলার কাজে হাত দেন। তিনরুমের সে ঘর অর্ধেক তোলার পর তাঁর সব টাকা ফুরিয়ে যায়। একবার বাড়ি গিয়ে দেখলাম, এ নিয়ে তাঁর বেশ মন খারাপ। আমরা তাঁর সে অসমাপ্ত কাজ শেষ করে দিয়েছিলাম। তিনি যে পরিমান খুশি হয়েছিলেন তার রেশ এখনও অন্তর ছুয়ে আছে।

২০০৯ সালে আমার একটা বই বের হয়। ডাকটিকেট নিয়ে লেখা সে বই নিয়ে আব্বার সে কী উচ্ছাস! সকালে হাঁটতে গিয়ে হাতে করে বই নিয়ে যান। গাইবান্ধা কলেজের মাঠে হাঁটা শেষ করে কোথাও বসে সে বই তিনি তার প্রাতঃভ্রমনের সাথীদের দেখান। তা শুনে আমার লজ্জা লাগে। এটা শুধু আমার ক্ষেত্রেই নয়। তাঁর সব ছেলে এবং তাঁর নাতিনাতনিদের সাফল্যে তিনি এমনই উচ্ছসিত হয়ে পড়তেন। তার প্রতি সন্মান দেখিয়ে বইটির ভুমিকায় আমি লিখেছিলাম “এ বই প্রকাশের পর প্রথম কপিটি পাঠাবো তাঁকে। তাঁর হয়তো বইয়ের বিষয়ের প্রতি আগ্রহ নেই, তবুও মোটা লেন্সের চশমা দিয়ে প্রতিদিন বইটির ২/১ পৃষ্টা কষ্ট করে পড়বেন ও পরম যত্নে রেখে দিবেন শিয়রে। বাসায় কেউ আসলে শিশুর মতো উচ্ছাস নিয়ে বইটি দেখাবেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় অশীতিপর আব্বাকে বইটি উৎসর্গ করতে পেরে আমি ধন্য”। আমার মনে হয় তাঁকে জানানো এটিই আমার সবচেয়ে বড় শ্রদ্ধা।

ছেলেদের বৈষয়িক উন্নতির খবরে আব্বা ভীষন খুশি হতেন। সে খুশির খবর তিনি আত্নীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের আগ বাড়িয়ে জানাতে ভুলতেন না। আমরাও যে কোন বিষয়সম্পত্তি করার আগে আব্বা মাকে জানাতাম, তাদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে তারপর সে কাজে হাত দিতাম। ২০১৬ সালে কানাডায় যখন বাড়ী কেনার কথাবার্তা হচ্ছিল তখন বিষয়টি নিয়ে রুমু কথা বলে আব্বার সাথে। আব্বা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু জানতে চাইতেন। কতটুকু জমির উপর বাড়ীটি, কয়টি রুম, দক্ষিণমুখী না পূর্বমুখী এসব আরও অনেক কথা। বাড়িতে উঠে রুমু আব্বাকে ফোন করে বলেছিলো, খুব তাড়াতাড়ি আপনাদেরকে বাড়ী দেখাতে নিয়ে আসবো। আব্বা সেদিন বলেছিলেন, বৌমা, আমি স্বপ্নে তোমাদের বাড়ী ঘুরে এসেছি। রুমুর কাছে বাড়ীর বর্ননা শুনে সেটি চিন্তা করতে করতেই হয়তো আব্বা ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। আব্বা মাকে না জানিয়ে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তাদেরকে কিছুদিনের জন্য এখানে নিয়ে আসার। এটা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এর মাঝেই আব্বা অসুস্থ্য হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ২০১৭ সালের ৮ এপ্রিল। যে অতৃপ্তির বোঝা আমাদের উপর রেখে আব্বা চিরদিনের জন্য চলে গেলেন, তা আর পুরণ হবার নয়।

গুয়েল্ফ, কানাডা

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles