
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ পনেরই এপ্রিলে হবে এবার । কিন্তু বাংলা একাডেমীর হিসাবে চৌদ্দই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয় প্রতি বছর ।
বাংলা দিনলিপি, মাসের হিসাব দিন, ক্ষণ হিসাব করে সাজানো হয়েছিল বাংলা ক্যালেন্ডার। এরফলে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের কখনো তের কখনো চৌদ্দ বা পনের তারিখেও পহেলা বৈশাখ পরত। কিন্তু নিজস্ততা ছেড়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সমন্বয় করার জন্য বাংলা ক্যালেন্ডার পরিবর্তন করা হয়েছিল ১৯৮৭ সনে। তখন থেকে শুধু বাংলাদেশেই এপ্রিল মাসের চৌদ্দ তারিখে পালিত হয়ে আসছে বর্ষশুরুর দিন পহেলা বৈশাখ। এতে যারা বাংলা ক্যালেন্ডার হিসাবে চলেন, তাদের সমস্যা হয়েছে। নিরবে তারা নিজেদের মতনই পহেলা বৈশাখের দিন চৈত্র সংক্রান্তি বা বর্ষ শেষের দিনটি পালন করেন। আর যখন নববর্ষ শেষ হয়ে যায় জাতীয় আয়োজনে তার পরের দিন বা আগের দিন হয় তো হিসাব অনুযায়ী তারা দিনটি পালন করেন। কখনো হয়তবা ক্যলেন্ডারের হিসাবে একই দিনেও হয়।
বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার আরো দেশ, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে এই নববর্ষ উদযাপিত হয়।
এছাড়া ভারতের অনেক অঞ্চলে পালিত হয় নববর্ষ পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষের প্রথম দিন হিসেবে। পহেলা বৈশাখ শুধু বাংলাদেশের বাঙালীদেরই উৎসব তা নয়। এশিয়া মাহাদেশের অনেক কয়টি দেশেই বাংলা নববর্ষ পালন করা হয়। এবং বিচ্ছিন্ন বাংলাদেশ ছাড়া আর সব দেশই কিন্তু আগের ক্যালেন্ডারের হিসাব মতন ঐতিহ্য অনুসরণ করে একই দিনে পালন করে।
বৎসরের শুরু সব জাতির মধ্যেই আনন্দ উৎসবের এবং সেই জাতির ভাষাভাষীর পঞ্জিকা, নিয়ম অনুসারে সেটা পালিত হয় । পৃথিবী জুড়ে নয়টি নববর্ষ আছে বিভিন্ন জাতিগুষ্টির।
এর মধ্যে প্রথম অবস্থানে আছে গ্রেগরিয়ান নববর্ষ, যা শুরু হয় পহেলা জানুয়ারী। পৃথিবী ব্যাপী প্রচলিত এই গ্রেগরিয় নববর্ষ। পৃথিবীর সকল কাজকর্ম এই গ্রেগরিয়ান হিসাবেই চলছে বর্তমান সময়ে। যদিও নিজেদের ভাষা এবং নিয়মে সবাই নিজেদের ক্যালেন্ডার অনুসরন করে।
চীনারা পালন করে নববর্ষ, চন্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডার চাঁদের হিসাবে অনুযায়ী ।
পশ্চিমা ক্যালেন্ডার অনুসারে একুশে জানুয়ারী থেকে বিশে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত অমাবস্যার পরে যে নতুন চাঁদ উঠে সেদিন থেকে শুরু হয় নববর্ষ পালনের উৎসব। এবং পরের পূর্ণিমা পর্যন্ত স্থায়ী হয় এই উৎসব।
ইংরেজি ক্যালেন্ডার হিসেবে একই তারিখে প্রতিবছর নববর্ষ শুরু হবে তার কোন নিয়ম নেই। তাদের হিসাব অনুযায়ী যেদিন চাঁদ উঠবে বছর শুরুর সেই দিনই তারা উৎসব শুরু করে।
চাইনিজ নববর্ষ শুধু চাইনিজরা পালন করে না, বৃহত্তর চীনের ভিতরে এবং বাইরে মিলে পঞ্চান্নটি জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে উনত্রিশ জাতি, চীনা নববর্ষ উদযাপন করে। জাপানিজ, কোরিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া,থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইন এটিকে একটি সরকারী উৎসব হিসেবে উদযাপন করে। বিদেশে চাইনিজ কমিউনিটির সাথে আমিও তাদের উৎসব আনন্দ উপভোগ করি এখন,যা আগে আমার কখনো জানা ছিল না।
নওরোজ পারস্য নববর্ষ।
চৌদ্দশ বছর আগে ইরানে, ইসলামীকরণ এবং ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লব সত্ত্বেও, নওরোজ একটি সংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে রয়ে গেছে, যা কেবল ইরানেই নয়, আফগানিস্তান, আজারবাইজান সহ প্রতিবেশী দেশগুলিতে এবং তুরস্ক ও ইরাকের কুর্দিরাও পালন করে। উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান এবং কিরগিজস্তান পাশাপাশি ককেশাস, মধ্যপ্রাচ্য এবং বলকান অঞ্চলের কিছু অংশ পারস্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলগুলিতে নওরোজ ব্যাপকভাবে পালিত হয়।
আরবি চন্দ্র ক্যালেন্ডার
তবে ইরানি ক্যালেন্ডার তার নতুন বছর উদযাপন করে ভার্নাল ইকুইনক্সের সঠিক মুহূর্তে, এবং
চন্দ্র-সৌর ক্যালেন্ডারের নতুন বছর সাধারণত শীতকালীন অয়নকালের পরে প্রথম, দ্বিতীয় বা এমনকি তৃতীয় অমাবস্যা দিন হিসাব করে নির্ধারিত হয়। তাই গ্রেগরিয় ক্যালেণ্ডারের ভিন্ন ভিন্ন তারিখে শুরু হয়। তাতে তাদের কোণ সমস্যা হয় না। নিজস্ব নিয়ম রক্ষা করেই পালন করা হয় নববর্ষ।
ইসলামী নববর্ষ যাকে হিজরি নববর্ষ বলা হয়। মহররম মাসের পহেলা তারিখে শুরু হয়। ইসলামী ক্যালেন্ডার নির্ধারিত হয়, যা সম্পূর্ণরূপে চাঁদের হিসাবে।
প্রতি বছর প্রায় দশ এগারো দিন পরিবর্তিত হয়। এই হিসাবেই পালিত হয়ে আসছে। কখনো পরিবর্ত করা হয়নি।
সম্রাট অগাস্টাসের জন্মদিন, তেইশে সেপ্টেম্বর থেকে নববর্ষ গননার শুরু করার জন্য রাজকিয় নির্দেশ আসলে।
এই নির্দেশের ফলে বেশ কয়েকটি স্থানীয় প্রাদেশিক ক্যালেন্ডার মিলিয়ে, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা, বাইজেন্টাইন বছর পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়। এই তারিখটি এখনও পূর্ব অর্থোডক্স চার্চে ধর্মীয় বছরের শুরুর জন্য ব্যবহৃত হয়।
সোংক্রান
তের থেকে পনের এপ্রিল নববর্ষ আসে পঞ্জিকার হিসাব অনুয়ায়ী । বাঙালীর নববর্ষ দক্ষিণ ভারত থেকে নেপাল শ্রীলঙ্কায় সোংক্রাইন উৎসব নামে পরিচিত।
সংস্কৃত ভাষায় “চলাচল” বা “আন্দোলন” অর্থ, সোংক্রান সৌর ক্যালেন্ডারের সাথে কাজ করে। রাশিচক্রের মীন থেকে মেষ রাশিতে সূর্যের গতিবিধি চিহ্নিত করে। সোংক্রান থাইল্যান্ড জুড়ে পালিত হয়, দেশের অঞ্চলের উপর নির্ভর করে রীতিনীতি পরিবর্তিত হয়। বৌদ্ধ ক্যালেন্ডারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে এটি একটি, যার কেন্দ্রবিন্দুতে জল থাকে।
সোংক্রানকে আধ্যাত্মিকভাবে শুদ্ধিকরণ এবং পূর্ববর্তী বছরের দুর্ভাগ্য দূর করার জন্য বিবেচনা করা হয়। নববর্ষে তরুণরা তাদের পরিবারের বয়স্ক প্রজন্মের কাছে শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে বয়স্কদের হাত ও পায়ে জল ঢেলে দেয়। উৎসবে এবং বাণিজ্যিক দিক হল , জনগন রাস্তায় একে অপরের উপর জল ছুঁড়ে মারে। ভীষণ গরম পরে এইসময়ে তাই জল দিয়ে ঠান্ডা রাখার কৌশল উৎসবে পরিণত হয়েছে।বর্তমানে জলের বন্দুক ব্যবহার করে আনন্দ করে তারা।
হিব্রু চান্দ্র মাসের তিন তারিখে, রোশ হাশানাহ প্রথম এবং দ্বিতীয় দিনে ইহুদি নববর্ষ হিসেবে পালিত হয়। যার অর্থ “বছরের প্রধান”, এটি প্রতিফলনের একটি সময়, সারা বছর ধরে যেকোনো অন্যায়ের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এবং অন্যদের ক্ষমা করার জন্য। রোশ হাশানাহের আগে এবং সময়কালে একটি, শিংগা বাজানো হয়, এবং সময়ের শেষে, যা আগামী বছরের জন্য আত্মা-অনুসন্ধান এবং বৃদ্ধিকে অনুপ্রাণিত করার আহ্বান হিসেবে কাজ করে। ঐতিহ্য এবং রীতিনীতি পরিবার থেকে পরিবারে পরিবর্তিত হয়, তবে প্রতীকী খাবার এই সময়ের অন্যতম। রোশ হাশানাহর বেশিরভাগ সময় সিনাগগে বা বাড়িতে কাটানো হয়।
প্রতিটি জাতির নববর্ষের অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানতে গেলে দেখা যায় সবাই পুরাতনের ভুল গুলো সুধরে নিয়ে নতুন শুরু করতে চায়। সেখানে পরিশুদ্ধির চিন্তা থাকে। এবং খাদ্য, পানিয়, হাসি আনন্দে,পরিবার, আত্মিয়, প্রতিবেশি, পরিচিত সবার সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করতে চায়। শুদ্ধতা সব দিক দিয়ে পাওয়ার আশা করে। পবিত্র ভাবে নতুন দিনটি শুরু করার ভাবনা বিরাজ করে।
প্রতিটি নববর্ষের সাথে রাশিচক্রের একটা হিসাব আছে।
কয়েক শত বৎসর আগে বিভিন্ন দেশে বসে নিজেদের মতন হিসাব করে পণ্ডিত ব্যাক্তিগণ নিজেস্ব হিসাব অনুযায়ী যে বৎসরের হিসাব করেছেন। বারো মাস বারো রাশি চক্রের হিসাব মিল আছে আলাদা হওয়ার পরও।
টরন্টো, কানাডা