
একটি ভিডিও দেখে এই কথাগুলো লিখতে ইচ্ছে হলো। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে ভিডিওটি করা হয়েছে। অর্ধেক দেখে আর দেখতে ইচ্ছে হলো না। একজন আপাত জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিষ্টের ভিডিও। অনলাইন এক্টিভিষ্টদের মধ্যে একজন আছেন যিনি সত্যিই মেধাবী মানুষ বলে আমি মনে করি। তবে বাকী যারা আছেন তারা অর্ডিনারী পার্সন যদিও তাদের পোষ্টে লাইক কমেন্ট লক্ষাধিক থাকে। কিন্তু সার্বিক বিবেচনায় কেউ একজন মিলিয়ন লাইক পেলেও তাকে মেধাবী বলা চলে না। অনেকেই বলে থাকেন মানুষ যেটা শুনতে চায় সেটাই সে খুঁজে বেড়ায় এবং সেরকম পোষ্ট দেখলে লাইক কমেন্টের ছড়াছড়ি চলে। সেটা ভিন্ন প্রসংগ। মুল কথায় আসি। যে কোন বিষয়ে আপনি ইচ্ছে করলেই ঘটনার নানা রকম ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়েও এখন অনেকে সাহস করে প্রকাশ্যে তা করছেন। এই যে বলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দিন সরকারের সাথে মনি, তোফায়েল, সিরাজুল আলম খাঁন, রাজ্জাকদের দ্বন্দ ছিল, ভারত ইচ্ছে করে এসব দ্বন্দ তৈরী করেছে, ভারতের ইশারায় পাকিস্তান ভাংগা হয়েছে, মুজিব ভারতের ক্রীড়নক ছিলেন এসবই নুতন পুরাতন ন্যারেটিভ মাত্র।
সংক্ষেপে বলি, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কুকুর লেজকে নাড়ায় নাকি লেজ কুকুরকে নাড়ায়। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বৈষম্যমুলক আচরণের কারণে, ভৌগোলিক বাস্তবতার কারণে, ভাষাগত বৈপরীত্য এবং উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের কারণে পাকিস্তান এক রাষ্ট্র থাকা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ সেদিন না হলে অন্য একদিন হতো এবং হতোই। কারণ পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ছিল একটি অবাস্তব কাল্পনিক রাষ্ট্র। এখন এই রাষ্ট্রটি ভেঙে গেলে ভারতের সুবিধা হয়, হতেই পারে। তারা সেই সুবিধা নিতেই চাইবে এবং নিয়েছেও। তাই বলে আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র চাওয়া, সেটা অর্জন করতে গনআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান এবং সর্বোপরি লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসবতো মিথ্যা নয়। আমার চাওয়া, আমার স্বাধীকার কাউকে যদি সুবিধা দেয় বা অসুবিধা দেয় তাতে আমার কী করার আছে? যেমন এখন চীনকে আমাদের প্রয়োজন। ভারত তিস্তা এবং মিয়ানমার ইস্যুতে আমাদেরকে হেল্প করে না, একতরফা বাণিজ্য সুবিধা নেয়, বর্ষায় বাঁধ খুলে দিয়ে আমাদেরকে ডুবিয়ে মারে, সীমান্তে পাখির মত গুলি করে হত্যা করে, এসবের প্রতিকার পেতে আমরা যদি চীনের কাছে যাই, আমেরিকার কাছে যাই আর তাতে যদি চীন আমেরিকা সুবিধা পায়, তাতে আমার কী করার আছে? আর তাতে ভারত কী মনে করলো না করলো সেটা আমি বুঝতে যাবো কেন? আমি জানি চীন বা ভারত তার স্বার্থ দেখবে, তাহলে আমার কাজ হলো আমাকেও আমার স্বার্থ দেখতে হবে। আমি ভারতকে নাড়াবো নাকি ভারত আমাকে নাড়াবে সেটাই বড়ো প্রশ্ন। আমি আমেরিকা চীনকে নাড়াবো নাকি চীন আমেরিকা আমাকে নাড়াবে তা নির্ভর করে আমার নেতা কে, তার ব্যক্তিত্ব কেমন, তাঁর দেশপ্রেম কেমন তার উপর।
কাজেই নুতন করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের ষড়যন্ত্র বা তথাকথিত বা কথিত বলার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু, মুজিব নগর সরকার, বিএলএফ বা তৎকালীন ছাত্র নেতাদের যেমন খাটো করে দেখার সুযোগ নেই তেমনি জিয়াউর রহমান সহ সেক্টর কমান্ডারগণ, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, জেনারেল ওসমানীদের অবদানকেও খাটো করার কোন সুযোগ নেই।
৯০ এর গণআন্দোলন, ২৪ এর গণঅভ্যুত্থান, ৫২ এর ভাষা আন্দোলনসহ যে কোন মহান ঘটনাকেই আপনি ইচ্ছা করলে আপনার মনের মাধুরী মিশিয়ে ভিডিও করতে পারেন তবে তা কোন্ ন্যারেটিভের হবে তা নির্ভর করবে আপনি কোন পক্ষের লোক সেটার উপর। কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যদি বেঁচে থাকতেন এবং তাকে যদি ৫২ এর ভাষা আন্দোলন নিয়ে জিজ্ঞাসা করা যেত, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই এমন বয়ান দিতেন যা হতো আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের সম্পুর্ণ বিপরীত। আর যারা জিন্নাহর সমর্থন করতেন বা উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা সমর্থন করতেন তাদের লাইকের কি অভাব পড়তো? মনে হয় না। ঠিক তেমনী আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টো বা ইয়াহিয়া খানকে জিজ্ঞেস করলে পরিস্কার বলতো উল্টো কথা।
অতএব আমাদের উচিত না আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনরকম বাজে কথা বলা। রাজনীতি, গনতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, দেশ পরিচালনা নিয়ে আমাদের বিভেদ থাকতে পারে তাই বলে ৭১ নিয়ে কোন বিভেদ থাকা উচিত নয়। ভারতের, পাকিস্তানের, আমেরিকার যেমন স্বাধীনতা দিবস আছে, সেটা নিয়ে তারা গর্ব বোধ করেন, বিতর্ক করেন না, একসাথে সেলিব্রেট করেন, আমাদেরও আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে গর্ববোধ করা উচিত, বিতর্ক পরিহার করে ন্যুনতম সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধের জায়গায় মিলিত হওয়া উচিত। যে কোন দেশে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিরোধী কিছু লোক থাকতেই পারে, তাদেরকে সেইসব দেশের মানুষ কোন চোখে দেখে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
স্কারবোরো, কানাডা