
‘ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে আমাকে আগামী বুধবার,’ পৃথা চোখে একরাশ দুঃখ নিয়ে বলে, ‘ছেলে দশম গ্রেডের সরকারি চাকরি করে।’
আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে বলি, ‘আচ্ছা, ভালো তো।’
‘ভালো তো মানে? তুমি কিছু করবে না?’
‘কি করবো?’
‘তোমার চাকরির কি অবস্থা?’
‘নাই। কোনো খবর নাই।’
‘আমাদের বিয়েটা হবে না। তাই না?’ পৃথা অনেক কষ্টে কান্না আঁটকে বলে।
আমি আকাশ দেখি। শরতের গাঢ় নীল আকাশ। এরকম গাঢ় নীল আকাশের নিচেই প্রথম আমাদের দেখা হয়েছিলো। সেদিন আকাশটা কি সুন্দর লাগছিলো দেখতে। অথচ আজকের আকাশটা ভীষণ কুৎসিত, নির্মম।
প্রথম যখন পৃথার সাথে দেখা হলো, একবারও ভাবিনি এতোটা জড়িয়ে পড়বো ওর সাথে। ফেসবুকে পরিচয় আমাদের। অনেকটা কৌতুহলের বসেই ওর সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। সম্পর্কটা হবারও কথা ছিলো না। পৃথা প্রথম থেকেই বলতো, তার বাবা মা যেমন ছেলে পছন্দ করে, আমি কোনোভাবেই সেই ক্যাটাগরিতে পড়ি না। তার বাবা মা সরকারি চাকরিজীবী পাত্র চায়। আমার কপালের দুশো কিলোমিটারের আশেপাশে সরকারি চাকরি লেখা নেই।
আমি ব্যাপারটা নিয়ে প্রথমে ভাবিনি। ধুর, এতো কথা কে ভাবে? একটা মেয়ের সাথে কথা বলছি, কথা বলতে ভালো লাগছে, এই তো। তার সাথে প্রেম , বিয়ে, এতোটা চিন্তাও করিনি। পৃথাও মনে হয় আমাকে সিরিয়াসলি নেয়নি প্রথমে। আমাদের বন্ধুর অভাব ছিলো, দুজন দুজনের কাছে সব কথা শেয়ার করতাম।
এভাবে কথা বলতে বলতেই একসময় মনে হলো, আমরা খুব বেশি জড়িয়ে যাচ্ছি। পৃথাই প্রথম বললো, ‘আমাদের কথা বলা উচিত না। জড়িয়ে গেলে বিপদ।’ আমিও সায় দিলাম। কথা বন্ধ হয়ে গেলো দুজনের। ভেবেছিলাম ওকে ছাড়া সুন্দরভাবে চলতে পারবো। জীবনে আরো কতো পৃথা আসবে, তার হিসেব নেই। কিন্তু…
কিন্তু সারাদিনের কথাগুলো কাউকে বলতে না পারার কষ্ট হঠাৎ করে আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেতে লাগলো। রিমঝিম বর্ষার দিন কারো কণ্ঠ শুনতে চাওয়ার তৃষ্ণা যে এতো কঠিন হতে পারে, আমার জানা ছিলো না। একজনের অভাব এতো বেশি করে অনুভব করছিলাম আমি, যে সারাটাদিন শুধু তার কথাই ভাবছিলাম।
আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। পৃথাকে ছাড়া আমার এক মুহুর্তও চলা সম্ভব না।
পৃথাকে জানানোর দরকার ছিলো ব্যাপারটা। কিন্তু আমি জানাতে পারিনি। সংকোচ লাগছিলো। পৃথা যে কারণে ছেড়ে গেছে আমাকে, সেই কারণটি তো এখনো আছে। আমার পক্ষে কখনোই সরকারি চাকরি পাওয়া সম্ভব না। ছাত্র হিসেবে আমি একদমই নিম্নমানের, এতো মেধাবী স্টুডেন্টদের সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারি চাকরি বাগিয়ে নিবো, সেই দু্ঃসাহস বা অলীক কল্পনা কোনোটাই করি না। সরকারি চাকরির ইচ্ছাও আমার নেই। পৃথার সঙ্গে জড়ালে আমাদের সম্পর্ক পরিণতি পাবে না, শুধু কষ্টই পাবো দুজন।
তার উপর পৃথা নিজেই কথা বন্ধ করেছে। ওর সাথে আবার কথা বলতে চাওয়াটা অভদ্রতার মধ্যে পড়ে যায়। পৃথা না চাইলে তো আর কথা বলা যায় না।
আমি যখন নিজেই নিজের মধ্যে গুমড়ে মরছি, তখন একদিন ম্যাসেজ এলো। পৃথার ম্যাসেজ। ‘আমরা কি দেখা করতে পারি কালকে, রমনা পার্কে?’
‘পারবো। কালকে কখন?’
‘বিকেল সাড়ে চারটায়।’
‘আচ্ছা।’
পরদিন সাড়ে চারটায় রমনায় পৌঁছে গেলাম। পৃথাও আসলো। ওর পরনে আকাশের মতো গাঢ় নীল শাড়ি। আকাশের রঙটাও সেদিন ওর শাড়ির মতোই ছিলো। অদ্ভুত মায়াবী আকাশ।
পৃথা দীঘির স্বচ্ছ জলের মতো টলমল চোখ নিয়ে বলেছিলো, ‘তোমার সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না। এমন কেন হচ্ছে, বলো তো?’
আমি মুচকি হাসি, ‘আমি কিভাবে বলবো?’
‘তোমার দোষ। তুমি একটা শয়তান। আমাকে ফাঁদে ফেলে আটকে ফেলেছো।’
‘ফাঁদে ফেলতে পারলে তো ভালোই। সারাজীবন এইভাবে আটকে রাখতে চাই ফাঁদে। তুমি কি রাজি?’
পৃথা লাজুক হাসে, ‘না, রাজি না। একদম রাজি না।’
আমি পৃথার জন্য একজোড়া কানের দুল নিয়ে এসেছিলাম। ‘এটা নাও, প্লিজ নাও।’
পৃথা আনন্দে ঝলমল করে উঠলো, ‘ইশ, কি সুন্দর এটা। তোমার জন্য যে কিছু আনিনি।’
‘তোমার চুলের কাঁটাটা দাও। ওটা হলেই চলবে।’
পৃথা চুলের কাঁটাটা খুলে আমায় দিলো। একরাশ ঘন কালো চুল ওর মুখটা ঢেকে দিলো বর্ষার কালো মেঘের মতো।
আমরা যে সম্পর্কে জড়াতে চাইনি, সেই সম্পর্কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেলাম।
সম্পর্কে জড়ানোর পর নতুন এক ভয় আমাকে ঘিরে ধরলো। পৃথাকে হারানোর ভয়। সত্যি যদি ওকে হারিয়ে ফেলি? সত্যিই যদি সরকারি চাকরি করি না বলে ওর বাবা মা আমাকে মেনে না নেন?
কিন্তু আমার আর কি করার? ছোট বেলা থেকেই একদম ডাল ব্রেইনওয়ালা স্টুডেন্ট আমি। ক্লাসে সবসময় লাস্ট দশজনের মধ্যে আমার নাম থাকতো। বাবার ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হবো, ক্লাস এইটে ম্যাথে করলাম ফেইল। স্যাররা হাসিমুখে কমার্সে ঢুকিয়ে দিলেন। এসএসসিতে জিপিএ এসেছিলো ৩.৫। যেখানে আমার আশেপাশের সবাই ৪ – ৫ জিপিএ নিয়ে হাসিমুখে নাচনকুদন করছিলো। আমাদের পাশের বাসার আন্টি তো একদম বলেই দিয়েছিলো আব্বু আম্মুকে, ‘ছেলেকে আর পড়িয়ে কি করবেন? কোনো একটা ব্যবসায় ঢুকিয়ে দিন। পড়ালে টাকা আর সময়, দুটোই লস।’
আমার বাবা এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলের টিচার ছিলেন। টিচারের ছেলে মূর্খ হবে, এটা তিনি ভাবতেই পারছিলেন না। আমাকে এক অখ্যাত কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়ে বললেন, ‘একটু মন লাগিয়ে পড়ো বাবা। তোমার ভালো করতে হবে।’
বাবার মোটিভেশনে হালকা পড়ালেখা শুরু করেছিলাম। যে কলেজ, স্যাররাই ক্লাসে আসতেন না ঠিকমতো। পরীক্ষায় লিখলেই পাশ হয়ে যেত। দেখলাম কষ্ট করে পড়ালেখা করে লাভ নাই। প্যারা নাই চিল টাইপ লাইফ কাটাচ্ছিলাম। এইচএসসিতে জিপিএ আসলো ৩.৫৮।
বাবা সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি করে দিলেন। পাশের বাসার আন্টি বিমর্ষমুখে বললেন, ‘আগেই বলেছিলাম, শুধু শুধু টাকা খরচ করছেন। ওকে একটা ব্যবসায় ঢুকায় দিলে এতোদিনে ভালো টাকাপয়সা ইনকাম করে ফেলতো। এখন তো একটা ভালো চাকরিও পাবে না। দেশে ভালো চাকরির যা আকাল।’
এই যে পড়ালেখার সাথে আমার যোজন যোজন দূরত্ব, এই নিয়ে আমি কিভাবে সরকারি চাকরি পাবো? পৃথা তাও কিছুটা মোটিভেশন দিতো, আমি গায়ে মাখতাম না। ধুর, কিছু হবে না আমাকে দিয়ে। একদিন জোর করে আমাকে নিয়ে নীলক্ষেত থেকে কিছু বই কিনে দিলো। জব প্রিপারেশনের বই। বললো, ‘পড়ো।কালকে একটা কোচিং এও নিয়ে যাবো তোমাকে। আমার কাজিনরা কোচিং করতো ওখানে। ভাইয়াদের পরিচিত।’
বইগুলো নিয়ে এসে পড়ার টেবিলে ফেলে রাখলাম। যা আমাকে দিয়ে হবে না, তা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই।
একদিন মাঝরাতে হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিসের জন্য, জানি না। কোনো ভয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু ঘুম থেকে ওঠার পর আরো বড় ভয় আমায় জেঁকে বসেছিলো। পৃথাকে হারিয়ে ফেলবো আমি, এরকম একটা চিন্তা হঠাৎ মাথার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলো বিচ্ছিরি শুঁয়োপোকার মতো। আমি সেদিন উঠে লাইট জ্বালিয়ে টেবিলে বসলাম। একটা বই হাতে নিলাম। দেখি না একটু পড়ে, কি হয়। চেষ্টা করতে কি দোষ। পড়া শুরু করেছিলাম সেদিন থেকে। এরপর একটু একটু করে পড়ার পরিমাণ বাড়িয়েছিলাম।
আমার পরের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো পড়ার মধ্যেই। যে আমি লাইফে কখনো সিরিয়াস ছিলাম না, এই চাকরির পড়া নিয়ে হঠাৎ কেন যেন সিরিয়াস হয়ে গেলাম। রুটিন করে ফেলেছিলাম পড়ার জন্য, রুটিন মাফিক পড়তাম। আব্বু আম্মু আমার এই পরিবর্তন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভিমড়ি টিমড়ি খেয়ে একাকার করে ফেললেন।
পৃথা হাসতে হাসতে বলতো, ‘শুধু কি আব্বু আম্মুকে ভিমড়ি খাওয়াবে? আর কাউকে খাওয়াবে না?’
‘অবশ্যই খাওয়াবো। পাশের বাসার আন্টিকে খাওয়াবো। খুব জ্বালিয়েছেন মহিলা।’
‘আর? আর কাউকে খাওয়াবে?’
‘অবশ্যই। তোমার বাবাকে খাওয়াবো।’
‘আমার বাবা? আমার বাবা আসছে কেন এর মধ্যে?’
‘আসবে না আবার? নিজের মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার জন্য অদ্ভুত শর্ত বেঁধে দিয়েছেন। যেদিন চাকরিটা পাবো, উনার মুখের সামনে রেজাল্ট শিট ছুঁড়ে মেরে বলবো, ‘সুলেমান সাহেব, আপনার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি। আপনি পারলে ঠেকান।’
‘আসছে। জীবনেও এরকম ভাবে বলতে পারবে না।’
‘দেখা যাবে।’
সামনে কোনো সরকারি চাকরির পরীক্ষা নেই। সার্কুলার আসছে না। বিসিএসের সার্কুলার আসতে পারে এই বছরের শেষে, তাও পুরোপুরি নিশ্চিত না ব্যাপারটা। পৃথা একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছে। ‘বাবা ছেলে দেখছে বিয়ের জন্য। আমি অনেক কষ্টে আটকে রেখেছি। তুমি প্লিজ কিছু একটা করো।’
আমি কিছু বেসরকারি জবের ভাইবা দিলাম। লাভ হলো না। ডাকলো না কোথাও।
পিএসসির একটা জবের সার্কুলার এলো।নন ক্যাডার জব, নবম গ্রেডের। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়লো আবেদন করার জন্য। পোস্ট কম, ক্যান্ডিডেট বেশি। চাকরির সার্কুলারের খরার জন্যই এই অবস্থা। সবাই বলাবলি করছে, এই পরীক্ষায় যারা টিকবে, তাদের সামনের বিসিএসও প্রায় নিশ্চিত। কারণ এতো প্রতিযোগিতা মধ্যেও এখানে টিকে গেলে আর কোনো পরীক্ষাতেই আটকানোর কথা না।
অ্যাপ্লাই করলাম। মন লাগিয়ে পড়া শুরু করলাম। পড়ি আর পড়ি। পৃথার সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। যখন খারাপ লাগে, মন খারাপ হয়, পড়তে বিরক্ত লাগে, চুপচাপ পৃথার চুলের কাঁটাটা দেখি। আমার পড়ার টেবিলেই থাকে কাঁটাটা। ওটা দেখে আবার পড়তে বসে যাই।
পরীক্ষা হলো। টিকলাম। ভাইবা হলো। তাও দিয়ে আসলাম। এরপর রেজাল্ট পাবলিশের আর কোনো নাম গন্ধ নেই।
সবাই বলাবলি করলো, ‘জোর লবিং চলছে ভাই, জোর লবিং। লবিং ছাড়া এই চাকরি পাওয়ার কোনো চান্স নাই।’
আমার কোনো হোমড়া চোমড়া আত্মীয় পরিচিত নেই। লবিং ছাড়া এই চাকরি পাওয়া না গেলে আমার এই চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা নাই।
পৃথা এরমধ্যেই একদিন আমাকে কল দিলো। দেখা করতে চায়। সেই নির্মম বিকেল। সেই নির্মম বিকেলেই সে আমাকে বললো, তাকে দেখতে আসছে আগামী বুধবার। সে কোনোভাবেই আটকাতে পারছে না।
আমার কিছুই করার ছিলো না। আর কিই বা করতাম আমি? কোনোকিছুই আমার হাতে নেই।
এক সপ্তাহ কেটে গেলো। কিছুই করতে পারলাম না। মঙ্গলবার রাতে পৃথা ফোন দিলো। কাঁদছে ও। ‘ছেলেপক্ষ কালকে পার্মানেন্ট কথা বলতে আসছে। আমার ছবি দেখে পছন্দ হয়েছে তাদের। সবকিছু ঠিক থাকলে কালকেই বিয়েই পড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমি এই বিয়ে করবো না। বাসার কেউ মানছে না। তুমি কিছু একটা করো, প্লিজ।’
‘কি করবো?’
‘আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাও। আমরা পালিয়ে যাই।’
‘সম্ভব না। পরিবারের বাইরে যেয়ে কিছু করতে পারবো না।’
‘কেন পারবে না? তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না, তুমি কি বুঝতে পারছো না?’
‘পারছি। কিছুই করার নাই পৃথা। তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে এলেও আমি তোমাকে সুখে রাখতে পারবো না। তোমার আমার ডেসটিনি আলাদা। অনেক আগেই তা লেখা হয়ে গেছে।’
পৃথা কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘এটাই যদি হয়, তাহলে কেন শুধু শুধু আশা দিয়েছিলে আমাকে? তুমি একটা কাপুরুষ। আর কখনো আমার সাথে যোগাযোগ করবে না।’ পৃথা ফোনটা কেটে দিলো। আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বিষণ্ণ রাতের আকাশ। একমুঠো বাতাস হু হু কান্নার মতো বয়ে গেলো।
পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ঘুম আসছিলো না। কেমন তিক্ত এক অনুভূতিতে ছেঁয়ে আছে মন।
মা এসে ডেকে গেলো নাস্তা করার জন্য। উঠলাম না। ভালো লাগছে না উঠতে।
মা এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘শরীর খারাপ?’
বললাম, ‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, শুয়ে থাক। আমি খাবার এখানেই এনে দিচ্ছি।’
আমি শুয়ে রইলাম। কি করছে পৃথা? হয়তো ওকে পার্লারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এখন। ওকে দেখেই সন্ধ্যায় বরপক্ষ হ্যাঁ বলে দিবে। রাতেই ও হয়ে যাবে অন্য কারো।
রায়হান ফোন দিচ্ছে অনেক্ষণ ধরে। ফোন ধরছি না। ইচ্ছা করছে না ধরতে।
নাস্তা কোনোরকম মুখে গুঁজে শুয়ে পড়লাম। মাকে বললাম আমাকে যেন আর না ডাকে। আমি এখন ঘুমাবো। লম্বা এক ঘুম।
কিন্তু ঘুমাতে আর পারলাম কই। রায়হান বাড়ি চলে এসেছে। এসেই চিৎকার শুরু করে দিলো, ‘ফোন ধরিস না কেন? এতোবার ফোন দিচ্ছি।’
‘কি হয়েছে? ফোন দিচ্ছিলি কেন?’
‘খবরটা দেওয়ার জন্য।’
‘কি খবর?’
‘আজকে নন-ক্যাডার জবটার রেজাল্ট দিবে বিকেল চারটায়।’
‘কে বললো তোকে?’
‘আমার পরিচিত একজন আছে পিএসসিতে। সেই বললো।’
‘সবাই যে লবিং টবিং করে লোক ঢুকিয়ে ফেলেছে…’
‘আরে ভুয়া কথা ঐসব। ফেয়ার সিলেকশনই হয়েছে যতোটুকু জানি।যতোগুলো পোস্ট ততোজন প্রার্থীই নেয়া হয়েছে।’
আমি উঠলাম বিছানা ছেড়ে। ফ্রেশ হলাম। আব্বু আম্মুর কাছে গেলাম। বললাম, ‘তিনচার কেজি মিষ্টি কিনে রাখ। আর ঘরটা গুছিয়ে রাখো। একজনকে নিয়ে আসবো রাতের বেলায়।’
আব্বু আম্মু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি বাইরে চলে এলাম। অনেক কাজ বাকি।
পৃথাদের বাসায় যখন পৌঁছেছি তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ওদের বাসায় ভীড়। অনেক মানুষজন। একজন দাঁড়িওয়ালা লোক হাতে রেজিস্টার খাতা নিয়ে বসে আছে। উনি মনে হয় কাজি।
আমি পৃথার বাবার সামনে গেলাম। পৃথার বাবা বললেন, ‘তুমি কে? কি চাও এখানে?’
আমি বললাম, ‘সুলেমান সাহেব। আপনার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছি। পারলে ঠেকান।’ বলেই রেজাল্ট শিটটা তার সামনে ছুঁড়ে দিলাম।
পৃথা দরজা দিয়ে মুখ বের করে উঁকি দিয়েছে। তার চোখ এতো বড় বড় হয়ে আছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
আমি বললাম, ‘চলো পৃথা। তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার বাবার অনুমতি নিয়েই নিয়ে যাবো। আমাদের পালানোর দরকার নেই।’
সুলেমান আংকেল অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বসে আছেন। তার হাতে রেজাল্ট শিট। শিটে আমার রোল সুন্দর করে মার্ক করা।
****
পৃথা মুখ ভেংচে বললো, ‘এই যে বীরপুরুষ সাহেব, বাবার সামনে যে ড্রামাটা করলা, এটা কি ঠিক হয়েছিলো? বাবা যদি রেগে গিয়ে বলতো যে তোমার কাছে আমার মেয়ে দিবো না।’
‘বেশ করেছি। মেয়ের বিয়ের জন্য এসব আজেবাজে শর্ত দিবেন কেন উনি? একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। মেয়ে বিয়ে দিতে না চাইলে উঠিয়ে নিয়ে চলে আসতাম।’
‘তা এখনো তো প্রায় উঠিয়েই নিয়ে এসেছো। বাবা বললো একটু সময় দিতে, বড় আয়োজন করে বিয়ে করতে। তা না, বরপক্ষ যে কাজি নিয়ে এসেছিলো, সেই কাজিকে দিয়েই বিয়ে পড়িয়ে নিয়েছো। এমন কেন তুমি?’
আমি বললাম, ‘কি করবো বলো। তর সইছিলো না।’
পৃথা হাসতে হাসতে বললো, ‘ফাজিল। তা বিয়ে করার যদি প্ল্যানই থাকতো, তাহলে ঘর সাজালে না কেন? এই তোমার সাধারণ ঘরেই বাসর করতে হবে এখন। একটা ফুল পর্যন্ত নাই।’
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, ‘আরি ফুল কিনতে পারিনি পরে, কোনো দোকানেই ফুল নেই। সকালে আব্বু আম্মুকে বলে গিয়েছিলাম ঘর গুছিয়ে রাখতে। তারা আমার কথার গুরুত্বই দেয়নি। মনে করেছে যে ছেলে পাগল হয়ে গেছে।’
পৃথা হাসলো অনেকক্ষণ ধরে। ভুবনভোলানো হাসি। তারপর হাসি থামিয়ে বললো, ‘বাসররাতে বউকে কিছু গিফট দিতে হয়। তুমি কি গিফট দিবা আমাকে?’
আমি উঠে টেবিলের কাছে গেলাম। টেবিলের ওপর ওর চুলের কাঁটাটা আছে। সেটিই ওকে ফেরত দিয়ে বললাম, ‘আপাতত এটাই রাখো। এটা অনেক আপন জিনিস আমার। তোমার কথা সবসময় মনে করিয়ে দিতো। তবে এর চাইতেও আরো সুন্দর সুন্দর জিনিস আনবো তোমার জন্য, প্রমিজ। তোমার জীবনে সুখের কোনো কমতি রাখবো না।’
পৃথা লাজুক হাসলো, ‘গিফটের দরকার নাই আমার। যা দরকার ছিলো, তা পেয়ে গেছি।’