
ছবিটি বাংলাদেশে আমাদের গ্রামের বাড়ির ঠিক ঘরের সামনের ছবি। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িত এখানে। আমরা সাধারণত শীতকালে শহরে বাবার কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যেতাম। এখানে তখন কলাই, মটর কলাই শাক হতো। আমরা তার মধ্যে দৌড়াদৌড়ি এবং খেলাধুলা করতাম। এই জমির মধ্যে দিয়ে দূরে গ্রামের মধ্যে জমির শুরু আইল ধরে চলে গেছে একেবারে মধুমতি নদীর দিকে। সেই নদী পার হয়ে যেতে হতো আমার প্রিয় মেঝো ফুফুর বাড়ি। তখন রাস্তা ছিল কিন্তু আজকের মতো গাড়ি ছিল না তাই আমরা পায় হেঁটেই চলে যেতাম মেঝো আম্মার বাড়ি।
আমার খুব মনে পড়ে শীতকালে আমরা দেশে গেলে আমাদের মেঝো আম্মা যখন আমাদের বাড়িতে আসতেন তখন জমির মাঝখানের ওই শুরু পথ ধরেই আসতেন। উনি বেশ লম্বা এবং স্লিম গড়ন ছিলেন এবং উনার হাসি ছিল যেমন সুন্দর তেমনি মায়াবী। আমরা যখন দূর থেকে উনাকে আসতে দেখতাম তখন দৌড়ে যেতাম। কাছে যেতেই হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরতেন। উনি গত হয়েছেন অনেক আগে, কিন্তু দেশে গেলে ওখানে দাঁড়ালে এখনো যেনো অবচেতন মনে উনাকে দেখতে পাই, দূর থেকে হেটে আসছেন !!
আর বর্ষাকালে এখানে থাকতো অনেক পানি, তখন নৌকায় করে যেতে হতো। স্বাধীনতার যুদ্ধ শেষে, বিজয় দিবসের বেশ কিছুদিন পরে ঠিক এই জায়গা দিয়েই যুদ্ধ শেষে আমার বাবা একটি নৌকায় করে আসছিলেন। নৌকার মাঝি ছিল আমাদের বংশীয় আরু কাকা, আর পিছনে আমার বাবা একটি ধূসর রঙের কলারওয়ালা পাঞ্জবী পরা ঘাড়ে একটি স্টেনগান। আমাদের বাড়ির সবাই হয়তো ধরে নিয়েছিল উনি আর নেই। যাহোক তখন বাবার নৌকাটি যখন আস্তে আস্তে আমাদের বাড়িরই দিকে আসছিলো তখন আমার বড়ো বোন অনেক জোরে বলে উঠেছিল, “আব্বা” . সেই সময়ের এইটুকুই শুধু আমার মনে আছে। আমার বড়ো বোনের হারিয়ে যাওয়া বা নিখোঁজ বাবার ফিরে না আসার ব্যাথার মধ্যে তাকে দেখে তার হৃদয় নিঃসরিত আবেগজড়িত “আব্বা” ডাক এখনো আমার কানে বাজে। আর বিশেষ করে এই বিজয়ের দিবসে সেটি যেন বেশি বেশি করে বাজে। সৌভাগ্য আমাদের বা আমাদের বাবার হলেও শত শত, হাজার হাজার সন্তানের বা তাদের বাবা বা ভাইয়ের সেই সৌভাগ্য হয়নি। তারা আর কোনোদিন ফিরে আসে নি। তারা ফিরে আসে নি, কিন্তু আমাদেরকে দিয়ে গেছে একটি স্বাধীন দেশ।
গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেই সমস্ত বীর শহীদের যাদের জন্য আজ বলতে পারি আমার জন্মভূমি বাংলাদেশ ! দেশ যেমনিই হোক, সেখানকার পদ্ধতি যেমনিই হোক আমার একটি দেশ আছে এটি বলতে পারার সৌভাগ্য যাদের নেই তাদের কাছে জানা যাবে সেই অনুভবটা কেমন বেদনাময়।
টরন্টো, কানাডা