
আজ ৪ জুলাই। স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) ১১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁকে প্রণাম।
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী যেসকল পাঠকের জানা আছে তাঁরা স্মরণ করতে পারবেন মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় ভারতীয় এ ধর্মপ্রচারক আহুত না হয়েও ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমেরিকার শিকাগোতে গিয়েছিলেন। যে সম্মেলনে বক্তৃতা করতে তিনি যান তার নাম ছিল ধর্ম মহাসভা। ১৮৯৩ সালের ১৩ মে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে জাহাজে ওঠেন এবং বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ১১ সেপ্টেম্বর ধর্ম মহাসভায় প্রথম দিনেই কথা বলার সুযোগ পান। ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১৬ দিন দীর্ঘ সে সম্মেলনে তেমন সুযোগ তাঁর মোট দশবার ঘটেছিল। মূল সম্মেলনে ছয়বার আর মহাসভার বৈজ্ঞানিক বিভাগে চারবার। সম্মেলনে তাঁর সেসকল অভিভাষণ তাঁকে এমন একটি গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছিল যে তিনি সেবারের মতো আমেরিকাতেই থেকে যান। দীর্ঘ সাড়ে চার বছর ধরে তিনি আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন শহর ভ্রমণ করেন এবং তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। ভারতে ফিরে আসার পর ১৮৯৯ সালে তিনি পুণরায় পাশ্চাত্যগামী হন যার স্থায়ীকাল হয়েছিল দেড় বছর।
যে ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ যোগ দিয়ে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি অর্জন করেন তাতে উদ্যোক্তারা ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই খ্রিস্টান। অ-খ্রিস্টান যে কটি ধর্ম সেখানে আলোচিত হয়েছিল সেগুলো হলো জৈন ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, তাওবাদ, ইহুদী ধর্ম, কনফুসিয়াসের ধর্ম, শিন্টো ধর্ম, ইসলাম, পারসিক ধর্ম এবং হিন্দুধর্ম ইত্যাদি। ১৫ সেপ্টেম্বর সম্মেলনে বিভিন্ন ধর্মের বক্তারা যখন বাগবিতণ্ডায় যুক্ত হন তখন তিনি আমাদের দেশে এখনও গ্রামাঞ্চলে বহুলভাবে প্রচারিত কুয়োর ব্যাঙের গল্পটি বলে তাদেরকে বিতণ্ডা থেকে নিবৃত করেন। যে ব্যাঙ নিজের কুয়োটাকে সর্ববৃহৎ বিবেচনা করতো এবং সমুদ্রের ব্যাঙকে প্রশ্ন করেছিল সমুদ্র কুয়ো থেকে কত বড়। বিবেকানন্দ তাঁর সফল সে বক্তৃতা শেষ করেছিলেন এই বলে যে ‘হে ভ্রাতৃগণ, এইরূপ সঙ্কীর্ণ ভাবই আমাদের মতভেদের কারণ। আমি একজন হিন্দু – আমি আমার নিজের ক্ষুদ্র কূপে বসে আছি এবং সেটাকেই সমগ্র জগত বলে বিবেচনা করছি। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা তাঁদের নিজেদের কূপে বসে আছেন এবং সেটাকেই সমগ্র জগত মনে করছেন। মুসলমানও নিজের কূপে বসে অছেন এবং সেটিকেই তাঁর জগত বিবেচনা করছেন।’ ধর্ম মহাসভাকে তিনি সেই ক্ষুদ্র বস্তুজগতগুলোর বেড়া ভাঙবার জন্য ধন্যবাদ দেন।
বিবেকানন্দের মূল বক্তব্য ছিল সব ধর্মের মধ্যেই যে কিছু না কিছু সত্য আছে সেগুলোকে আমাদের শ্রদ্ধা করতে শিখতে হবে। নিজের ধর্মকে আশ্রয় করে থাকলেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান তাঁর ছিল শতাধিক বছর পূর্বের আমেরিকাতে।
বিবেকানন্দ মনে করতেন “ প্রতিটি ধর্মকে অন্যান্য সব ধর্ম থেকে সারবস্তু গ্রহণ করে সেগুলিকে মিলিয়ে নিয়ে নিজের স্বাতন্ত্র্য অক্ষুণ্ন রেখে নিজস্ব বৃদ্ধির স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী উঠতে হবে।”
পৃথিবীকে অধিক শান্তির অধিক বাসযোগ্য একটি জায়গাতে পরিণত করতে প্রথম শর্ত হল অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তৈরী যা আন্তঃধর্মীয় সংলাপের মাধ্যমে হতে পারে। অন্য ধর্মের ত্রুটিকে বড় করে না দেখে তাঁর গুণকে বড় করে দেখলেই সেটি সম্ভব। বিবেকানন্দ সেই কাজটিই করেছিলেন। তিনি মনে করতেন ‘প্রত্যেক ধর্মই মহান বিশ্বসত্যের একটি দিককে নিয়ে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সত্যের সেই দিকটিকে রূপ দান করে তার বিশেষীকরণ করছে। সুতরাং সেটি হয়েছে সংযোজন, বিয়োজন নয়।’ পৃথিবীর সব ধর্মকে তিনি পরস্পরবিরোধী না ভেবে সম্পুরক মনে করতেন।