
বিকালে বাসায় ফিরে চা হাতে বাইরের ঘরে বসতেই মেয়েটা দই নিয়ে আমার কোলে বসে খেতে থাকলো। গিন্নি বলল, তোমার মেয়ে আজকেও গোসল করে নাই। এখন তোমার সাথে ঢং করতেছে। বেশি আদর দিয়ে মাথায় তুলছো। তুমি না পারলে আমি ঘাড় ধরে গোসলে ঢুকাবো। তখন চোটপাট নিও না আবার।
কালকে না প্রমিজ করছিলি গোসল করবি?- মেয়েকে জিজ্ঞেস করি।
– শাওয়ার ভালো না
– মানে?
– পানি ছোট হয়ে পড়ে, ওয়াইডলি পড়ে না
– এতদিন কিভাবে করতি?
– বালতিতে
– যেভাবেই হোক গোসল করবি
– রাতে করি?- বলে দৌড়ে হারিয়ে গেলো।
মেয়েটা হইছে একদম আমার মতো। হুবুহু জাভেদ। চেহারা, গায়ের রং, স্বভাব; সবকিছু। সন্ধ্যার পর বললাম, গোসলে যা?
– খিদে লাগছে। আগে খাই?
আমি দুধ-কলা-ভাত সামনে দিয়ে বললাম, গোসল না করলে আমি তোকে ঘুম পাড়ায়ে দিবো না। নো এক্সেপশন!
সে ডিনার খেয়ে মিনিট পাঁচেক দৌড়াদৌড়ি করে বলল, আব্বু আসো
– কোথায়?
– গোসল করবো, দরজার পাশে বসে থাকবা। রাতে ভয় লাগে
– রাতে বাথরুম সারিস না?
– গোসলে অনেক্ষন লাগে।
গিন্নি বলতে থাকে- ছোটকাল থেকেই দেখতেছি বাচ্চাদের “ওরে তোকে ধরলো রে!” বলে একা ঘরে রেখে পালাও। সেইযে মনের মধ্যে ভয় ঢুকায়ে দিছো..। যেরকম বাপ, সেরকম ছেলেমেয়ে। দেশে গেলে দেখতাম বিছানায় উঠার সময় তুমি দুই গজ দূর থেকে ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে বিছানায় উঠতা। শাক চুন্নি ঠ্যং টেনে খাটের তলায় নিবে?
আমি হাতে মোবাইল নিয়ে বাথরুমের দরজার আড়ালে টুল পেতে বসলাম। সে ভিতরে ঢুকেই চেঁচিয়ে উঠলো- ড্যাডি, দরজা ওপেন রাখো!
– তোর লজ্জা নাই?
– তোমাকে দেখতে চাই ড্যাডি। যদি পালাও?
– দরজা খোলা রাখা যাবে না
– তাহলে আমার সাথে কন্টিনুয়াসলি কথা বলতে হবে!
– ওকে, ও দেবদাস, দেবদাস রে.. তোর জন্য মায়া লাগে রে..
– ইশ-শ-শ-শ..! থামবা না ড্যাডি!
– আমার কাছে নাইকো বুবু ভাজা বাদাম। আমার কাছে আছে শুধু?..
– কাঁ-আ-আ-চা বাদাম!
অবাক করে দিয়ে সে ঠিক দশ মিনিট পরে বের হয়ে বেডরুমের দিকে দৌড় দিলো। আমি চক্ষু চড়কগাছ করে বললাম, গোসল শুরু করিসনি?
– ট্যাবটা চার্জে দিয়ে আসতেছি..
– এতক্ষন কী করলি?
– প্ল্যান করলাম; কোন শ্যাম্পু দিবো, কোন সাবান ইউজ করবো, টাওয়েল কোথায় রাখবো..
– আচ্ছা!
সে আবার ভেতরে ঢুকে দরজা আটকিয়ে চিৎকার ছাড়লো- ড্যাডি!
– কী
– গান গাও!
– ময়না রে, আমি আর পারবো না। তারচাইতে আমার পায়ের কেনি আঙ্গুল দরজার ফাক দিয়ে ঢুকায়ে দিচ্ছি। মাঝে মাঝে আঙ্গুল দেখলেই বুঝবি তোর ড্যাডি আছে, পালায় যায় নাই
– গ্রেট আইডিয়া!
আমি দরজার ফাঁক দিয়ে পায়ের আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে ফেইসবুকিং করতে থাকি। সে বলতে থাকে, আব্বু তোমার ‘টো’ এতো আগলি কেন? নখ কাটো না? খালি আমাদের বলো গোসল করতে তাই না? আজকেই তুমি নখ কাটবা!
এবার সত্যি শাওয়ার ছাড়ার আওয়াজ পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পনেরো মিনিট টানা শাওয়ার চলা দেখে সন্দেহ হলো। ঘুমায়ে গেল না কি! আধা ঘন্টা শক্ত টুলে বসে পিঠ ব্যাথা করতে লাগলো। একটা বুদ্ধি আটলাম। পাশেই রান্নাঘরে গিন্নি কাজ করছিল। ডাক দিয়ে বললাম, একটু শুনবা?
– রান্না করি
– এক মিনিট!
– কী?
– টুলটায় সমস্যা কী দেখো তো? বসে দেখোতো মড়মড় আওয়াজ পাও নাকি?
গিন্নি টুলে বসতেই আমি ঝেড়ে দৌড় দেই। অন্যঘর থেকে বললাম, আমি আর পারবো না। অনেক আরাম করছো, এবার তুমি দরজার ফাঁক দিয়ে পায়ের কেনি আঙ্গুল ঢুকায়ে রাখো
– কোনো সমস্যা না চান্দু, থ্যাঙ্ক ইউ!
– ওয়েলকাম!
– শুধু একটু রান্নাঘরে আসো, হাঁড়ি পুড়ে ধরতেছে..
আমি দৌড়ে রান্নাঘর যেতেই গিন্নি ইন্সট্রাকশন দিতে থাকে, দুধের সসপেনের তলা কাঠের খুনতি দিয়ে নাড়তে থাকো। নিচে যেন পুড়ে না ধরে
– কতক্ষন?
– দখিনা বের না হওয়া পর্যন্ত। দুধ ঘন হইছে?
– হু
– ওখান থেকে লিটারখানেক তুলে রাখো আরেক হাঁড়িতে, দই বসাবো। নাড়তে নাড়তেই ট্রান্সফার করো; থাইমো না
– হাসতেছো কেন? [আমি ঘামতে ঘামতে বললাম]
– ফেইসবুকের ভিডিও দেখে.. মানুষ পারেও। ও চান্দু..
– হু
– চুলার সসপেনে দুই মুঠ কালিজিরা পোলাওয়ের চাল ছাড়তে পারবা?
– ওকে
– আর পারলে একটা তেজপাতা, দুইটা এলাচ, পনেরোটা কিসমিস, আধা কাপ চিনি ঢালো। এক হাত দিয়ে নাড়ো; আরেক হাত দিয়ে ঢালো।
হঠাৎ দেখি দখিনা বত্রিশ পাটি বের করে ঠিক আমার পাশে দাঁড়ানো; ড্যাডি পায়েস বানাচ্ছ!
– তুই এখনো গোসল শুরু করিস নাই?
– বাথটাব পরিষ্কার করলাম। এখন গোসল করি?
চান্দু, ঘুঁটা দিচ্ছ তো?
– হু
– আরেক হাত দিয়ে ওভেনটা প্রি হিটে দাও তো; দেড়শো তে
– দিছি
– এবার কাঁচের ফ্ল্যাট বাটিতে আগের সেই এক লিটার দুধ ঢালো
– ঢালছি
– ওভেনে ঢুকাও। হাত থামায়ো না। আর কাঠের বোর্ডে দশটা পিস্ট্যাসিও বাদাম রেখে হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়া করো। মিহি করবা না।
দখিনা, তাড়াহুড়া করিস না, ভালো করে গোসল করবি! আর চান্দু, সাবধান! উপর থেকে কেওড়া জল যেন পায়েসে না পড়ে
– মানে?
– কিছু না; আমি কিন্তু ফেইসবুকের ভিডিও দেখে হাসতেছি.. আঁচ কমায়ে নাড়ো।
পায়েস যত ঘুঁটবা, তত টেশ!
অটোয়া, কানাডা