0.2 C
Toronto
শুক্রবার, মার্চ ১৪, ২০২৫

যেভাবে ভারতে বসে আমেরিকায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এই যুবক, অতঃপর…

যেভাবে ভারতে বসে আমেরিকায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন এই যুবক, অতঃপর… - the Bengali Times
সাগর ঠক্কর ওরফে স্যাগি

নাম তার সাগর ঠক্কর ওরফে স্যাগি। জন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। এক রুমের কষ্টসাধ্য জীবন থেকে বনে যান কোটিপতি। আর এখন জেলবন্দি ২৮ বছরের সাগর। তবে এই অল্প বসয়েই দেখে ফেলেছেন জীবনের অনেক কিছু।

ভারতের নালাসোরের এই তরুণ দেশটির অন্যতম বড় আন্তর্জাতিক আর্থিক কেলেঙ্কারির হোতা। প্রায় সাত হাজার আমেরিকান নাগরিককে বোকা বানিয়ে লাখ লাখ ডলার হাতিয়ে নেন তিনি। ভারতীয় মুদ্রায় যার মূল্য অন্তত ৫০০ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৬৬ কোটি টাকারও বেশি।

- Advertisement -

কিন্তু কীভাবে এই অর্থ আসত? কী করেই বা ভারতে বসে আমেরিকানদের বোকা বানাতেন এই তরুণ? জবাব—কলসেন্টার। ভুয়া কলসেন্টারের বড় চক্র তৈরি করে ফেলেছিলেন তিনি। দিল্লি, মুম্বাই, আহমেদাবাদের মতো শহর থেকে চলত কাজ।
সাগরের কল সেন্টারের মূল দফতর ছিল ভারতের রাজধানী দিল্লির লাগোয়া নয়ডায়। দিল্লি পুলিশের নাকের ডগায় থেকে প্রতারণা চালিয়ে গিয়েছেন সাগর। টানা দু’বছর।

সাগরের এই কলসেন্টারে রীতিমতো নিয়ম মেনে কর্মী নিয়োগ করা হত। খাতায়কলমে তাদের বেতন ছিল মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। যদিও তদন্তকারীরা পরে জানতে পেরেছিলেন, এই বেতন মাসে লাখ টাকাও ছুঁয়ে ফেলে কোনও কোনও সময়ে।

কর্মীদের কাজ ছিল, আমেরিকার নাগরিকদের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করা। ভয় দেখানো হত কর ফাঁকি দেওয়া সংক্রান্ত বিষয়ে। নিয়ম মেনে যদি কেউ কর দিয়েও দিতেন, তবে তাকেও বোকা বানানোর উপায় ছিল। কর্মীদের সব রকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি করা কথোপকথনের স্ক্রিপ্ট দিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছিল সাগরের কলসন্টারে। কর্মীদের চোস্ত আমেরিকান উচ্চারণে আগে থেকে তৈরি রাখা সেই সব যুক্তি শুনে বোকা বনে যেতেন অনেকেই।

দিনে এমন ভয় দেখানো ফোন যেত অন্তত ১০০জন আমেরিকার নাগরিকের কাছে। তার মধ্যে ৩০-৪০ জন সত্যি সত্যি ভয় পেতেন। আট থেকে দশ জন টাকাও দিয়ে দিতেন কর সংক্রান্ত আইনি জটিলতা এড়াতে।

তাদের থেকে কমপক্ষে ৩০০ ডলার এবং সর্বাধিক ৫ হাজার ডলার পর্যন্ত আদায় করত সাগরের ভুয়া কলসেন্টার। যে কর্মী সবচেয়ে বেশি অর্থ আদায় করতে পারতেন, তাকে মাসে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হত এক লাখ টাকা।

আদায় করা টাকা সরাসরি ভারতে আসত না। আমেরিকার নাগরিকরা ওই টাকা দিতেন আমেরিকার ব্যাংকেই। সেখানে সাগরের এজেন্ট ছিলেন। আদায় করা অর্থের ৩০ শতাংশ নিজেরা নিয়ে তারা বাকি টাকা অন্যের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতেন। দুবাই এবং চীন হয়ে অর্থ আসত ভারতে।

সেই টাকাতেই কোটিপতি সাগর এক সময় বিদেশি গাড়িতে গ্যারেজ ভরিয়েছিলেন। স্পোর্টস কার পছন্দ ছিল। ইতালি, জার্মানি থেকে গাড়ি কিনেছিলেন। এমনকি বিরাট কোহলির সংগ্রহ থেকেও তার প্রথম স্পোর্টস কারটি কিনে নিয়েছিলেন সাগর। আড়াই কোটি টাকা খরচ করেছিলেন ওই গাড়িটির জন্য।

তখন টাকায় ভাসছেন সাগর। তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, সে সময় বিদেশি নামি ডিজাইনার লুই ভিত্তোঁর স্যুট পরে ঘুরে বেড়াতেন। সপ্তাহের প্রতিদিন মুম্বাইয়ের অভিজাততম ক্লবে বসত তার সান্ধ্য আসর। বিদেশি গাড়িতে সাগরের সঙ্গে থাকত দু’জন দেহরক্ষী।

তাকে ধরতে বড়ই নাকানি-চোবানি খেয়েছেন গোয়েন্দারা। সফল হননি। আত্মগোপন করতে দুবাইয়ে চলে যান সাগর। তবে তখনও ভারতে তার ব্যবসা চলছে পুরোদমে। সামলাচ্ছেন বিশ্বস্তরা।

কিন্তু ২০১৮ সালে পুরোপুরি ধরা পড়ে যায় সাগরের কারবার। বিভিন্ন শহরে অভিযান চালিয়ে সাগরের ভুয়া কল সেন্টারের অন্তত ৬০০ জন কর্মীকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দারা। সাগরকে তখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে আচমকা সাগর নিজেই ধরা দেন। পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেন তিনি।

বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্ট বলছে, সাগরের অপরাধের কথা জানতে পেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন প্রেমিকা। সাগরের সঙ্গে তিনি সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দেন। পুলিশ জানিয়েছে, এই প্রেমিকার জন্যই আড়াই কোটি টাকা খরচ করে বিরাট কোহলির সংগ্রহ থেকে গাড়ি কিনেছিলেন সাগর।

আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন সাগর, তা স্পষ্ট নয়। তবে অনুমান প্রেমিকার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরই সাগর ওই সিদ্ধান্ত নেন।

মধ্যবিত্ত পরিবারে একটি মাত্র রুমে কষ্টে বড় হয়েছিলেন সাগর। বাবা ছিলেন ছোট ব্যবসায়ী মা গৃহবধূ। ক্লাস এইট পর্যন্ত কনভেন্টে পড়লেও পরে সরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। তবে কলেজে পড়ার সময় থেকেই প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই তরুণ।

কলসেন্টারে কাজ করা এক বন্ধুর সহযোগিতায় এই ব্যবসায়ে হাত পাকান। সেই ব্যবসারই শিকার হন সাড়ে ছ’ হাজারের বেশি আমেরিকান। ২০১৬ সালে আমেরিকার ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিসের ডার্টি ডজন তালিকার শীর্ষে জায়গা পায় সাগরের আর্থিক কেলেঙ্কারি। ৫ হাজার ৭৮৬ পাতার চার্জশিটে ৮০ জনের মধ্যে একজন ছিলেন সাগর।

চিবুকে সযত্ন লালিত হালকা দাড়ি। লুই ভিত্তোঁর পোশাক। ইতালিয়ান এবং জার্মান স্পোর্টস কার মুম্বাইয়ের অভিজাততম নাইট ক্লাবে যাতায়াত, সব সময়ের সঙ্গী বিশালদেহী দেহরক্ষী— ছেলেটিকে দেখে এক ঝলকে মনে হত জীবনে সাফল্যের শিখর ছুঁয়ে ফেলেছে। কিন্তু তারপরই নেমে এল অন্ধকার।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles