
পাঁচ বছর আগে যৌন হেনস্থার শিকার হন অভিনেত্রী ভাবনা মেনন। এতদিন পরে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুললেন অভিনেত্রী এবং গর্জে উঠলেন। অভিনেত্রী ভাবনা জানান তিনি তার আত্মমর্যাদা ফিরে পেতে চান। দক্ষিণ ভারতীয় ভাষায় ৮০টি ছবিতে অভিনয় করা এবং অনেক সম্মানজনক পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাবনা মেনন একদল পুরুষের হাতে অপহৃত হয়েছিলেন ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে।
অভিনেত্রী বলেন, আামার আত্মসম্মান হাজার টুকরো ও ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়েছে। তবে অভিনেত্রী জানান তিনি এখন যে উঠে দাঁড়িয়েছেন তার নেপথ্য রয়েছে অদম্য মনের জোর। ওই ঘটনার পর একাকীত্ব গ্রাস করেছিল তাকে। যদিও ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর অনেক সহযোগীতা পেয়েছেন তিনি তার পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে।
ঠিক কী হয়েছিল?
ঘটনাটা ২০১৭ সালের। শ্যুটিং সেরে বাড়ি ফিরছিলেন অভিনেত্রী। সেই সময় একদল পুরুষ তার উপর চড়াও হয়। এবং তাকে কিডন্যাপ করে চালায় যৌন নির্যাতন। এই ঘটনার পেছনে প্রধান মাথা ছিলেন মালায়লম অভিনেতা দীলিপ, যিনি তার সঙ্গে অন্তত ৬টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। এই ঘটনার পর দীলিপকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে তিনি মাত্র তিন মাস পরই জামিনে ছাড়া পেয়ে যান।
অভিনেত্রী ভাবনা জানান, এই ঘটনার পরও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিনিয়ত হেনস্থা হতে হয় তাকে। এই ভয়ঙ্কর ঘটনার পর তিনি মালয়ালম ছবির ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করাই বন্ধ করে দেন। তবে অভিনেত্রীর কথায় যেসব পরিচালকরা তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তারা হলেন আশিক আবু, শিবাজী কৈলাশ, অভিনেতা পরিচালক পৃথ্বীরাজ এবং অভিনেতা জয়সূর্য।
অভিনেত্রী ভাবনার এই ঘটনা পৌঁছায় আদালত পর্যন্ত। কিন্তু আদালতে গিয়ে প্রতিদিন তাকে লড়াই করতে হয়েছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য।
ভাবনা মেনন বলেন, ‘আমি একজন সাধারণ আনন্দ-প্রেমী মেয়ে ছিলাম এবং তারপরে এই একটি ঘটনা আমার জীবনকে উল্টে দিয়েছিল। বেশিরভাগ লোকে আমার হাস্যোজ্জ্বল ছবিগুলো দেখে, যেগুলো আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করি, কিন্তু আমি নরকে ছিলাম’।
‘আমি বারবার নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি, ‘কেন আমাকে?’ আমি নিজেকে দোষারোপ করছিলাম এবং আমি এ থেকে বের হওয়ার উপায় খুঁজছিলাম’।
‘কিন্তু ২০২০ সালে, বিচার শুরু হওয়ার পরে, আমি আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণ দেওয়ার জন্য ১৫ দিন কষ্ট করেছি। এবং তখনই পরিস্থিতি বদলে যায়। আমি সবকিছু ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। আমাকে সবকিছু মনে রাখতে হয়েছিল, মামলার প্রতিটি ক্ষুদ্র বিবরণ’।
হামলাকারীরা তার ওপর যৌন নির্যাতনের ভিডিও তৈরি করেছিল জানিয়ে ভাবনা বলেন- ‘হয়তো তারা আমাকে পরেও ব্ল্যাকমেইল করতে চেয়েছিল’।
ওই ঘটবনা জানানোর পর অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় তাকে লজ্জা দেয়া শুরু করে। তারা প্রশ্ন করে, কেন তিনি সন্ধ্যা ৭টায় বাড়ির বাইরে ছিলেন। তারা তার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কেউ কেউ তাকে গালিগালাজ করেছেন এবং কেউ কেউ বলেছেন যে, ঘটনাটি সাজানো।
ভারতীয় আইন অনুসারে, যারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয় তাদের পরিচয় যে কোনও মূল্যে গোপন করতে হবে। কিন্তু মেনন বলেন যে, শুরু থেকেই এটি জানা ছিল যে তিনিই আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
‘আমি একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী ছিলাম এবং প্রাথমিক রিপোর্টে শুধুমাত্র বলা হয়েছিল যে আমাকে অপহরণ করা হয়েছে। তাই কিছু টিভি চ্যানেল আমার ছবি দেখায়। যৌন নিপীড়নের বিবরণ জানার পর তারা আমার নাম ও ছবি সরিয়ে ফেলে, কিন্তু ততক্ষণে সবাই জানতে পেরেছিল যে এটি আমি ছিলাম’।
পাঁচ বছর আগে তার ‘দুঃস্বপ্ন’ শুরু হওয়ার পর গত জানুয়ারিতে প্রথমবারের মতো মেনন প্রকাশ্যে একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্টে স্বীকার করেন যে তিনিই সেই হামলার শিকার ছিলেন।
‘এটি কোনো সহজ যাত্রা ছিল না। একজন ভিকটিম হওয়া থেকে বেঁচে থাকা পর্যন্ত যাত্রা। ৫ বছর ধরে, আমার নাম এবং আমার পরিচয় আমার উপর চাপানো হামলার নিচে চাপা পড়ে আছে’, তিনি লিখেছেন।
‘যদিও আমি অপরাধটি করিনি, আমাকে অপমানিত করার, নীরব করার এবং বিচ্ছিন্ন করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এমন সময়ে আমার পাশে কিছু লোক ছিল যারা আমার কণ্ঠকে বাঁচিয়ে রাখতে এগিয়ে এসেছিল। এখন যখন আমি অনেক কণ্ঠ শুনি, যারা আমার পক্ষে কথা বলছে, আমি জানি যে ন্যায়বিচারের জন্য এই লড়াইয়ে আমি একা নই’।
ভাবনা বলেন, ‘কমপক্ষে একশ বার আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার মত অনুভব করেছি। এমন অনেক বার ছিল যখন আমি আমার বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার এমনকি আমার আইনজীবীদের জিজ্ঞেস করেছি যে আমি সবকিছু পেছনে ফিরিয়ে নিতে পারি কিনা, ঘড়িটি পেছনে ফিরিয়ে নিতে পারি কিনা। দেশ ছেড়ে কোথাও গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করার কথাও আমি ভেবেছিলাম, আমি আত্মহত্যার কথাও অনেকবার ভেবেছি’।
‘তবে যতবারই আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবতাম, ২৪ ঘন্টা পরই আমি আমার মন পরিবর্তন করতাম। কারণ এটি আমার মর্যাদার বিষয়। আমাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে, আমাকে প্রমাণ করতে হবে যে আমি কিছু ভুল করিনি’।
সূত্র: বিবিসি