
নরেন্দ্রনাথ দত্ত ওরফে স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) খ্যাতিমান বাঙালিদের মধ্যে প্রথম জাপান সফরকারী। জাপান-বাংলা সম্পর্কের ইতিহাসে জাপানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণের ঘটনা মনে রেখেও বলা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথ জাপান যান অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে প্রথম নোবেল বিজয়ীর শিরোপা নিয়ে ১৯১৬ সালে, আর নরেন্দ্রনাথ জাপান যান যখন তিনি বহির্ভারতে কোন খ্যাতিই অর্জন করেননি এমন সময়ে – ১৮৯৩ সালে। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের ২৩ বছর আগেই। তবে স্বল্প ক’দিনের সে সফরে জাপান নিয়ে বিবেকানন্দের যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী লক্ষ করা যায় তা বিশেষ মনোযোগ দাবী করে।
শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশ্যে ১৮৯৩ সালের ৩১ মে বিবেকানন্দ পেনিনসুলা জাহাজে বোম্বাই থেকে রওনা দেন। কলম্বো, পেনাঙ (মালয়), সিঙ্গাপুর, হংকং বন্দরে বিরতি দিয়ে দিয়ে জাহাজটি গিয়ে পৌঁছায় জাপানে। তাঁরা নামেন নাগাসাকি বন্দরে।
সে বিরতি ছিল মাত্র কয়েক ঘন্টার। কিন্তু যুবা পুরুষ বিবেকানন্দ সে সময়টাকেই ব্যবহার করেন সাধ্যমত। আর তাঁর তীব্র দৃষ্টি যে অভিজ্ঞতা লাভ করে তা বর্ণনাতীত। বিবেকানন্দ জানিয়েছেন, পৃথিবীর মধ্যে যত পরিষ্কার জাতি আছে জাপানীরা তাদের মধ্যে অন্যতম। এদের সবাই কেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। রাস্তাগুলো প্রায় সবই চওড়া সিধে ও বরাবর সমানভাবে বাঁধানো। খাঁচার মতো এদের ছোট ছোট দিব্যি বাড়িগুলো, প্রায় প্রতি শহর ও পল্লীর পশ্চাতে অবস্থিত চিড়গাছে ঢাকা চিরহরিৎ ছোট ছোট পাহাড়গুলো, বেঁটে, সুন্দরকায়, অদ্ভুত বেশধারী জাপ, তাদের প্রত্যেক চালচলন, অঙ্গভঙ্গি, হাবভাব – সবই ছবির মতো। জাপান সৌন্দর্যভূমি। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির পেছনে এক একখানি বাগান আছে – তা জাপানি ফ্যাশনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুল্মতৃণাচ্চাদিত ভূমিখণ্ড, ছোট ছোট কৃত্রিম জলপ্রণালী এবং পাথরের সাঁকো দিয়ে ভালরূপে সাজানো।
বিবেকানন্দ নাগাসাকি থেকে কোবে যান। কোবে গিয়ে জাহাজ ছেড়ে দেন তাঁরা। পরে স্থলপথে ইয়োকোহামায় যান – জাপানের মধ্যবর্তী প্রদেশসমূহ দেখবার জন্য। সে যাত্রায় তিনি জাপানের মধ্যপ্রদেশে তিনটি বড় বড় শহর দেখেন: শিল্পশহর ওসাকা, প্রাচীন রাজধানী কিয়াটো, এবং বর্তমান রাজধানী টোকিও । বিবেকানন্দের মতে টোকিও কলকাতার প্রায় দ্বিগুণ হবে। লোকসংখ্যাও প্রায় কলকাতার দ্বিগুণ। তিনি আরও জানান ছাড়পত্র ছাড়া বিদেশীকে জাপানের ভিতরে ভ্রমণ করত দেয় না। এ সকল বিবরণ পড়ে এটুকু নিশ্চিত হওয়া যায় যে বিবেকানন্দ ছিলেন অনেক খোলা চোখের মানুষ।
তিনি লেখেন: “দেখে বোধ হয় – জাপানীরা বর্তমান কালে কী প্রয়োজন, তা বুঝেছে; তারা সম্পূর্ণ জাগরিত হয়েছে। ওদের সম্পূর্ণরূপে শিক্ষিত ও সুনিয়ন্ত্রিত স্থলসৈন্য আছে। ওদের যে কামান আছে, তা ওদেরই একজন কর্মচারী আবিষ্কার করেছেন। সকলেই বলে, উহা কোন জাতির কামানের চেয়ে কম নয়। আর তারা তাদের নৌবলও ক্রমাগত বৃদ্ধি করছে। আমি একজন জাপানি স্থপতি-নির্মিত প্রায় এক মাইল লম্বা একটা সুড়ঙ্গ দেখেছি। এদের দেশলাই-এর কারখানা একটা দেখবার জিসিস। এদের যে-কোন জিনিসের অভাব তাই নিজের দেশে করবার চেষ্টা করছে। জাপানীদের একটি স্টীমার লাইনের জাহাজ চীন ও জাপানের মধ্যে যাতায়াত করে; আর এরা শীঘ্রই বোম্বাই ও ইয়োকোহামার মধ্যে জাহাজ চালাবে, মতলব করছে।” বিবেকানন্দ জাপানের মন্দিরও দেখেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে পুরোহিতকুল সাধারণত রক্ষণশীল ও পরিবর্তনবিরোধী, জাপানের মন্দির দেখে এবং পুরোহিতদের সাথে আলাপ করে তিনি বুঝেছিলেন যে এরা বেশ বুদ্ধিমান। সর্বত্রই যেন একটা উন্নতির জন্য প্রবল চেষ্টা দেখা যায়, তা পুরোহিতদের মধ্যেও প্রবেশ করেছে।
ইওরোপ থেকে শিক্ষালাভ অপেক্ষা জাপানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া ভারতের পক্ষে সহজ – এটি বিবেকানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর মতে জাপানীরাও এশিয়াবাসী এবং কিছুদিন পূর্বেও তারা আর্থিক সভ্যতা ও উন্নতির মাপকাঠিতে ভারতের তুল্য অথবা তদপেক্ষাও নিম্নতর স্তরে ছিল; তাহলে জাপানে তখন যেটি সম্ভব হয়েছিল তা ভারতের কেন হইবে না?
মনে মনে জাপান ও চিনের সাথে আরও তুলনা করে তিনি স্পষ্টই লিখেছিলেন, “জাপানীদের সম্বন্ধে আমার মনে কত কথা উদিত হচ্ছে, তা একটা সংক্ষিপ্ত চিঠির মধ্যে প্রকাশ করে বলতে পারি না। তবে এইটুকু বলতে পারি যে, আমাদের দেশের যুবকেরা দলে দলে প্রতিবৎসর চীন ও জাপানে যাক। জাপানে যাওয়া আবার বিশেষ দরকার; জাপানীদের কাছে ভারত এখনও সর্বপ্রকার উচ্চ ও মহৎ পদার্থের স্বপ্নরাজ্যস্বরূপ।”
যদিও বিবেকানন্দ তাঁর সংক্ষিপ্ত জাপান সফর নিয়ে কোন গ্রন্থ রচনা করেননি, কিন্তু তাঁর রচনাবলীর বিভিন্ন জায়গায় জাপান প্রসঙ্গে প্রশংসাসূচক মন্তব্য পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন জাপানিদের স্বদেশপ্রীতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ।