
কিং স্ট্রিটে এখনো ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাড়ির হেডলাইট হাইবিমে না দিলে সামনে কিছু দেখা যাচ্ছেনা। রাস্তার দুপাশের মাঠ শাদা বরফে ঠাসা। গতকালই প্রচুর তুষার পরেছে। রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর কার্নিশ, মুল গেট, আর সামনের গাছগাছালি নানা রঙের আলোয় সজ্জিত। ঘরের ভিতরে বৈদুতিক বাতির শাদা আলো। জানালার পর্দা ভেদ করে চোখ একেবারে ঘরের ভিতরে চলে যায়।
ঘরের ভিতরে “শুভ্র রমনীরা” হাঁটাচলা করছে। বাচ্চাদের কেউ কেউ সোফায় বসে স্মার্টফোনে নানান কিছু ব্রাউজ করছে। নানান জাতের
কুকুর ঘেউ ঘেউ শোনা যাচ্ছে।
কয়েকদিন পরেই ক্রিষ্টমাস।
বাড়িঘর, হাটবাজারে হলিডে উৎসব চোখে পড়ার মত।
জিনিসপত্রের যে এত দাম বাড়িতে বাড়িতে এ আলোক সজ্জা দেখে তা মনে হচ্ছে না। করোনার কারনে জনগনকে আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করতে গিয়ে সরকারের কয়েশ বিলিয়ন ডলারের বাজেট ঘাটতি। বিরোধীদল সেটা নিয়ে সরকারের সমালোচনায় ব্যস্ত।
মিডিয়া ও সংসদ গরম করে রেখেছে তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, “চিন্তার কিছু নেই। বাজেট উইল বি ব্যালেন্সড বাই ইটসেল্ফ।” সেটার আঁচ কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। কারন যে টাকা ছড়ানো হয়েছিল গত দুবছরে ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে সে টাকা জনগনের কাছ থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে। হয়ত বাড়তি করারোপও করা হবে। তারমানে বাজেট এভাবেই ব্যালান্স হয়ে যাবে।
সন্ধার পরে বাসা থেকে যখন গাড়ি নিয়ে বের হই, রাস্তায় অন্ধকার দেখে কী রকম ঘাবরে গিয়েছিলাম। এত অন্ধকার!
নাকি দুদিন একটানা ঘরের মধ্যে থাকার কারনে এরকম মনে হচ্ছে?
মনে প্রশ্ন জাগল, ঠিকমত ড্রাইভ করতে পারবো তো? এ ঘুটঘুটে আঁধারে গন্তব্যে পৌছতে পারবো তো?
কয়েক মিনিট পরে যখন কিং স্ট্রিটে উঠলাম, তখন রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে চোখে পরল আলোর ঝলকানি। ওগুলো দেখে মনটা একেবারে ভালো হয়ে গেল।
অন্ধকারে আশার আলো।
বাড়িতে বাড়িতে জ্বালানো আলোকসজ্জ্বা সেলিব্রেট করতে লাগলাম। কারন একটার চাইতে আরেকটা সুন্দর।
কেমন যেন আমার পুরো অন্ধকার রাস্তা আলোকিত হয়ে গেল। মনের মধ্যেও।
এখন হেড লাইটের হাই বিম নামিয়ে মিডিয়ামে রেখেছি। কিন্তুু তারপরেও দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। অন্ধকারে আলোর রেখা চোখে পড়লে মনে যে ভরসা জাগে তার প্রমান পেলাম।
আমি অন্ধকারেও চলতে পারি। তবে কোন যানবাহনে নয়।
একা।
হেঁটে হেঁটে।
গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে আমার ভালোই লাগে। ভয় লাগেনা। হাঁটার সময় আমার পুরো দেহের নিয়ন্ত্রর আমার কাছে থাকে। কিন্তুু যানবাহন চালনান সময় তা থাকেনা। অন্ধকারে সারা শরীরের আলোক শক্তি এক সাথে কাজ করে।
আমি অন্ধকারে হাঁটি অন্ধমানুষেরা যেভাবে হাঁটে। সর্তকতার সাথে। সর্ন্তপনে।
“অন্ধজনে দেহ আলো।” এ কথা আমি বিশ্বাস করি। যাদের চোখে আলো নেই, তাঁরা দেহের আলোতে পথ চলে। আমিও অন্ধকারে দেহের আলোতে পথ চলা পছন্দ করি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমার অনেকগুলো বন্ধু ছিল যারা চোখে দেখতো না। তাঁদের সাথে আমার খুব সখ্যতা ছিল। ওঁদেরকে খুব কাছে থেকে দেখেছি।
মনের চোখ দিয়ে ওঁরা অনেক কিছু দেখতে পেত। তবে তাঁরা মানুষের মুখায়ববে ফুটেঁ ওঠা ভাষাগুলো পড়তে পারত না। মানুষের চোখের ভাষাও তাঁরা পড়তে পারতনা। ফলে অনেক সময় ভুলবোঝাবুঝি হত। হয়ত এটা ছিল তাঁদের একটা লিমিটেশন। কিন্তুু তাঁরা তা কল্পনায় ধরে নিত। কাজ চলে যেত। মানুষের সম্ভবনা তো অসীম। দুটো চোখ না থাকলেও চলে।
আলো ছাড়া মানুষসহ কোন প্রানীই বাঁচতে পারেনা। আবার অন্ধকারেই সব প্রানের সৃষ্টি। দুটোই সমভাবে প্রয়োজন।
মনে অন্ধকার থাকলে মানুষ চোখ থাকতেও সব কিছু অন্ধকার দেখে। কোথায়ও অন্ধকার থাকলে পাশেই আলো থাকে। আমাদের অনেকের হয়ত তা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগে।
কিং স্ট্রিট অনেক আগেই শেষ হয়েছে। গন্তব্যে পৌছতে আর কয়েক মিনিট বাকি। আলো দেখে মাঝ পথে ফোনে গান ছেড়ে ছিলাম। ব্লুটুথে গাড়ির ওডিওতে বেজে চলেছে। বারবার শুনে চলেছি:
“আলো আমার আলো ওগো, আলোয় ভুবন ভরা
আলো নয়ন ধোয়া আমার আলো হৃদয় হরা…”
টরন্টো, কানাডা