
জীবন একটি বহমান নদী। সে নদী কখনো হয় খরস্রোতা, কখনো শান্ত, কখনো সে নদী চলতে চলতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে মোড় নেয় অন্য দিকে, কখনো আবার সে নদী শুকিয়ে সৃষ্টি করে বালুচরের ।
জীবন শুরু করেছিলাম দু’জনে । কত আনন্দ কত সপ্ন, সংসার সাজানোর উত্তেজনা, উচ্ছলতা। নতুন নতুন রান্না শেখা । দিন কেটেছে হেসে খেলে। গান শুনে, কবিতা পড়ে, ঘুরে বেড়িয়ে । কত গল্প- কত গল্প , গল্পের যেন আর শেষ নেই । স্কুল কলেজের, বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প, বন্ধুদের গল্প, ছোটবেলার গল্প। একসাথে বসে টেলিভিশন দেখা, তাস খেলা, লুডু খেলা, দাবা খেলা, দাবায় হেরে গিয়ে গুটি এলো মেলো করে দেয়া । এভাবেই আনন্দময় জীবন কেটে যাচ্ছিলো ।
এক সময় মনে হোল আমাদের এই আনন্দময় জীবনে শাখা প্রশাখা আসার প্রয়োজন । সে পরিকল্পনাতে আমাদের দুজনের সংসারে আসলো শাখা প্রশাখা। এক ছেলে, এক মেয়ে। শিশুদের কলকাকলিতে ভরে উঠলো আমাদের দুজনের সংসার। জীবনে শুরু হোল অন্য রকম ভাবনা, অন্য রকম দায়িত্ব , অন্য রকম আনন্দ । ছেলে মেয়েকে স্কুলে পাঠাতে হবে, নানা রকম প্রশিক্ষণ দিতে হবে, নানা রকমের সুশিক্ষা দিতে হবে। কি যে ব্যাস্ততা সব কিছুর সাথে সন্তানদের অকৃতিম ভালোবাসা প্রদান করে তাদের মানুষের মতো মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা।
সে ব্যস্ততা এখন শেষ । আমাদের শাখা প্রশাখারা এখন নিজেরাই গাছে পরিনত হয়েছে। যার যার স্থানে তারা সফলতা অর্জন করেছে।
এখন আমরা আবার দু’জন। এখন আমরা আর আগের জীবনের দুজন নেই। এখন জীবনে উচ্ছলতার চাইতে নীরবতাই বেশী । স্বামী ব্যস্ত তাঁর শিক্ষকতার কাজকর্ম নিয়ে, কাজের পরে বাড়ি এসে সারাদিনের টুক টাক কথা বার্তা তারপর কম্পুউটারের সামনে বসা । আমিও আগের মতো তাঁকে এক রাজ্যর খবর দেবার উৎসাহ তেমন পাই না। নিজের মাঝে অনেক কথাই এখন রেখে দেই।
জীবন তরী ভাসতে ভাসতে মাঝ পথ ছাড়িয়ে গেছে সাথে সাথে তরীর গতিও যেন কমে গেছে। জীবনটা কেমন যেন বদলে গেছে। মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যেন দুজন দুজনের কাছে গুরু গম্ভির অংকের মাষ্টার । ভালোবাসার ভাণ্ডার আগের মতই পরিপূর্ণ আছে। নিয়ম মাফিক সবই চলছে- একসাথে বসে খাওয়া , ছুটির দিনে বাইরে খেতে যাওয়া , লং ড্রাইভে যাওয়া , অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া ছুতিতে নানা জায়গাতে ছুটি কাটাতে যাওয়া সবই আগের মতো ,তারপরও কোথায় যেন একটা শুন্যতা, একটা হাহাকার, একটা হারিয়ে ফেলার কষ্ট অনুভব করি। এখন অহেতুক কথার চাইতে প্রয়োজনীয় কথা বলাটাই অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। রেষ্টুরেন্টে বসেও যার যার মতো মুঠো ফোনে আঙুল চালাতে থাকি। মনে হয় যেন এত বছরে আমাদের অনেক কথাই ফুরিয়ে গেছে। খালি বাড়ি । ছেলে মেয়েদের কামরা গুলো একই ভাবে পরিপাটি করে সাজানো । ওদের ঘরে ঢুকলে মনে হয় ঘরময় এক নীরবতা স্তব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের ভেতর একটা কষ্টের ঝড় বইতে থাকে ।
আমাদের শাখা প্রশাখারা যখন তাদের ছোট ছোট c ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেড়াতে আসে বা আমরা যাই তখন মনে হয় পৃথিবী সব টুকু আনন্দ এই ছোট শিশুদের মাঝে লুকিয়ে আছে। এরাই যেন আমাদের আনন্দ আমাদের ভালোবাসা। এভাবেই ভালোবাসা নীচের দিকে নামতে থাকে। আমাদের প্রথম জীবনের সবটুকু ভালোবাসা যেন বিলিয়ে দিয়েছি এই শিশুদের মাঝে। আর আমাদের আগের ভালোবাসা সিক্ততা হারিয়ে শুষ্কতার দিকে এগিয়ে চলেছে । এখনকার ভালোবাসার মাঝে রয়েছে একের প্রতি অপরের নির্ভরতা । কেউ যেন কাউকে না জানিয়ে কিছু না করি। একে অপরকে আঘাত না করি।একে যেনো অন্যকে হারিয়ে না ফেলি সে আশঙ্কা ।এটাই মনে হয় ভালোবাসার আরেক রুপ। মনে হয় এটাই যেন জীবনের নিয়ম ।
ম্যাল্টন, অন্টারিও, কানাডা