
১
আজকের দিনটা আমার কাছে একটি বিশেষ দিন। কেনো বিশেষ সেটা বলছি। এমন দিনেই এক সকালে টরন্টো পীয়ারসন এয়ারপোর্টে নেমেছিলাম আমরা চারজন। চোখ ভরা ছিল অনিশ্চয়তা। বুক ভরা ছিল স্বপ্ন। অচেনা দেশ, অচেনা শহর, অচেনা ভাষা, অচেনা কালচার। শিঁকড় উপরে চলে এসেছিলাম। মা, বাবা, ভাই, বোন, আত্মীয়, বন্ধুদের রেখে। সবাই যেমন আসে। ছোট্ট অর্ক, অরিত্রি স্কলাস্টিকা স্কুলে যাচ্ছে, আমি আর জেসমিন দুজনেই নিজেদের চাকরি, সংসার, নিয়ে তীব্র এক লড়াইয়ের ময়দান থেকে চলে আসলাম আর এক লড়াইয়ের ময়দানে। একটি আপাতঃ গোছানো সংসার ফেলে নতুন করে আবার শুরু করার চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। তারপর দেখতে অনেকগুলো বছর পার হয়ে গেলো। অচেনা শহর চেনা হলো। অচেনা মানুষ আপন হলো। নতুন করে শিঁকড় গজালো। সন্তানরা বড় হলো। তারা নিজ নিজ সংসার শুরু করল। দুজনে শুরু করেছিলাম, তারপর চারজনের সংসার। আবার হয়েছি দু’জন। জীবন এক ঘূর্ণায়মান চক্র।
২
আমার জীবনটাকে তিনভাগে ভাগ করা যায় অনায়াসে। প্রথমভাগ বরিশাল, দ্বিতীয়ভাগ ঢাকা এবং তৃতীয়ভাগ টরন্টো। প্রতিটা ভাগই প্রায় সমান সমান। তিন জায়গা মিলিয়ে বাষট্টি বছর পার করেছি। প্রথমভাগে বিশ বছর, দ্বিতীয়ভাগে বাইশ বছর আর তৃতীয়ভাগেও বিশ বছর। অৰ্থাৎ কিনা আজ ২৮ জুন, বিশ বছর পূর্ণ হলো আমার কানাডা জীবনের। দুই দশক পার করে এলাম! মনে হচ্ছে এইতো সেদিন আমার দুই সন্তানের ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখ, এক অনিশ্চিয়তা নিয়ে দূরের লেক অন্টারিওর দিকে জেসমিনের তাকিয়ে থাকা। আৱ ওদের নিয়ে আমি হাইওয়ে ৪০১ দিয়ে টরন্টো থেকে অটোয়ার পথে যাত্ৰা কৱেছি। দীর্ঘ প্লেন জার্নি করে আৱো চাৱ ঘন্টাৱ জাৰ্নি। তখনও জানিনা কোথায় থিতু হবো। কোথায় বেটার হবে আমাদের জন্য। অতপর অটোয়ায় থাকাই সব্যস্ত হলো। কিন্তু বছর পার করে চলে আসলাম টরন্টো। কানাডা আসাটা যেমন আমার একক সিদ্ধান্ত ছিল তেমনি অটোয়া থেকে টরন্টো থিতু হওয়াটাও তাই।
৩
অরিত্রি আর জেসমিন যেমন কানাডা আসার ঘোর বিরোাধী ছিল তেমনি অটোয়া থেকে টরন্টো আসারও বিরোধিতা করেছিল। ছোট্ট অরিত্রি কিছুতেই ঢাকার স্কুলের বন্ধু আর কাজের মেয়ে বিউটিকে রেখে কানাডা আসবে না। আবার অটোয়ায় স্কুলেও তার একজন ইরানী বন্ধু হয়েছিল। হাইডিয়া তার নাম। তাকে রেখে সে কিছুতেই টরন্টো আসতে পারবে না। বিশাল কান্নাকাটি তার। কিন্তু অর্ক এমন একজন মানুষ শিশুকাল থেকেই যে কিনা সবকিছু সহজেই মেনে নিতে পারে, যে কোনো জায়গায়, যেকোনো মানুষের সাথে, যে কোনো পরিবেশে সে ফীট। জেসমিন চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পায়। আমার উপর প্রচন্ড আস্থাহীন সারাজীবন। আমি অযোগ্য মানুষ তাই। আমি পূর্বাপর পরিণতি না ভেবে জীবনে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আত্মসম্মানের ব্যাপারে আপস করিনি। কারো কাছে মাথা নত করিনি। বরিশাল থেকে ঢাকা আসা বা ঢাকা থেকে কানাডা আসা কোনোটাই তেমন পরিকল্পনা করে করিনি। হুট হাট সিদ্ধান্ত নিতে কখনও দ্বিধা করিনি। ভবিষ্যতেও করব না। জীবনের চতুর্থ বা শেষ অধ্যায় হবে আবার বৱিশাল ফিরে যাওয়া..
কাকতালীয়ভাবে আজ ঈদেৱ দিন তাই সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা এবং অরিত্রি টু ডিকেডস উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বিশাল এক কেক নিয়ে এসেছে। বন্ধুদের আমন্ত্রণ রইল।
টরন্টো, কানাডা