
আগের রাতে যত দেরী করেই আমার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন শেষ হোক না কেন, ঠিক ভোর পাঁচটায় নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যান এসে হাজির হয়ে যেতেন। আমি তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, কাচারী ঘর থেকে বাসার কাজের লোক এসে ভয়ে ভয়ে দরজায় টোকা দিচ্ছে, কাকা, নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যান এসেছে, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হতে বলছেন। আমি বিরক্তির সাথে উত্তর দেই, বসতে বলো, আসছি। বলেই পাশ ফিরে আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। খুবই ক্লান্ত শরীর, গতরাত বারটায় দুরের কোন এক গ্রাম থেকে উঠোন বৈঠক করে হয়তো ফিরেছি।
ঘন্টাখানেক পরে আবারও দরজায় টোকা। এবার স্বয়ং নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যানের গলা! আরে উঠে এসো তাড়াতাড়ি। বহুদুরের গ্রামে যেতে হবে। চরবেতকা, শীতলপুর, অনেকদুর। তাছাড়া এক ঘন্টা আগে বের হলে এক আলা বেশী মারা যাবে! অর্থাৎ এক ঘন্টা আগে বের হলে এক গ্রামের মানুষের কাছে ভোট চেয়ে শেষ করে অপর আরো একটি গ্রাম কাভার করা যাবে। আমরা নুতন প্রার্থী, অন্য প্রার্থীর চেয়ে আমাদের বেশী বেশী গ্রাম কাভার করতে হবে। যতবেশী মানুষের কাছে যেতে পারবো তত বেশী ভোট পাবার সম্ভাবনা থাকবে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যান এক নাগাড়ে কথাগুলো বলেই চলেছেন। ভোটে দাঁড়িয়েছি আমি, গরজ বেশী নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যানের।
বয়স তখন ২৬। কখনো গ্রামে থাকি নি, মানুষজন আত্মীয় স্বজন তেমন চিনি না। চিনলেও নাম জানি না। স্কুল জীবন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পুরোটা কেটেছে ফরিদপুর শহরে এবং ঢাকায়। মানুষের চাপে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে এসেছি। অকেল ব্যাপারি, নাজিমুদ্দিন চেয়ারম্যান, নুরু চেয়ারম্যান, মোহন মন্ডল, মজিদ ব্যাপারী, মনি ভাই সহ অনেকেই ছিলেন যাঁদের ছাড়া দৌলতদিয়ার অধিকাংশ জায়গায় ভোট চাইতে যাওয়া আমার জন্যে ছিল একরকম অসম্ভব ব্যাপার।
এই যে গ্রামের পর গ্রাম কখনো হেঁটে, কখনো মোটর সাইকেলে করে দুটো মাস মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোটের জন্যে গিয়েছি, হাত ধরেছি, কদমবুছি করেছি, কোলাকুলি করেছি শুধু তখন দেশে একটা ফেয়ার নির্বাচনী ব্যবস্হা ছিল বলে। সময়টা ১৯৯০ সালের মার্চ মাস। যদি আমরা জানতাম যে ভোট চেয়ে লাভ নেই, মানুষ ভোট দিতে পারবে না, ভোট দেবার আগেই ভোট হয়ে যাবে, তাহলে কি দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা এভাবে মানুষের কাছে যেতাম? মানুষের কাছে প্রতিদিন এটা করবো, সেটা করবো বলে জবাবদিহিতা করতাম? ভোট ছিল বলেই বিপুল ভোটে বিজয়ী হবার পরেও যখনই দুর দুরান্ত থেকে কোন সাধারণ মানুষ অফিসে কিংবা বাসায় দেখা করতে আসতো, তাদেরকে গুরুত্ব দিতে হতো! ভোটের পরে প্রতিদিন অফিসে যাবার আগে সকালে অন্ততঃ দু তিন ডজন মানুষকে নানারকম সাহায্য সহযোগিতা, তাদের অভাব অভিযোগের কথা মোকাবেলা করে তারপর বাসার চৌকাঠ পেরিয়ে অফিসের গাড়ীর সীটে গিয়ে বসতে পারতাম শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকে একটি ভোট নিয়েছিলাম বলে। পাঁচ বছর পর আবার যদি তাদের কাছে যেতে হয় সে কারণে মানুষকে ভোটের আগে এবং ভোটের পরে একই রকম গুরুত্ব দিতে হতো। এইযে ত্রিশ বছর বিদেশে থাকি, তারপরও যখনই দেশে যাই একইভাবে মানুষকে গুরুত্ব দেই শুধু তাদের কাছ থেকে ৩৩ বছর আগে একদিন একটি ভোট নিয়েছিলাম বলে।
কাজেই ভোট থাকলেই মানুষের গুরুত্ব থাকে, জনপ্রতিনিধির কৈফিয়ত থাকে, জবাবদিহিতা থাকে। নিরপেক্ষ স্বচ্ছ, সকলের অংশগ্রহণে যে নির্বাচন সেই নির্বাচন না হওয়া মানে বদ্ধ পুকুরে শেওলা জমা, সাপ পোকা মাকড়ের বাসা বাঁধা। আর মানুষের ভোট দিতে পারার নির্বাচন মানে স্রোতস্বিনী নদীর মত, স্বচ্ছ জলে দুর্নীতি, দুঃশাসন কচুরীপানার মত ভেসে যাওয়া। দেশপ্রেমিক সরকার ও জনগণের আশা আকাংখার বাস্তবায়ন করতে গনতন্ত্রে ভোট দেবার ব্যবস্হা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
স্কারবোরো, কানাডা