-2 C
Toronto
সোমবার, মার্চ ১৭, ২০২৫

পূর্ব দিগন্তে ঝকঝকে নতুন সূর্য

পূর্ব দিগন্তে ঝকঝকে নতুন সূর্য

সকালে কাজে বের হয়ে ইনেস রোডের পাশে বিস্তীর্ণ ফসলের ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখি পূর্ব দিগন্তে ঝকঝকে নতুন সূর্য উঠছে। সারা আকাশ জুড়ে উপচে পড়ছে হলদে-কমলা-লাল আভার ঝিলিক। এ সূর্যটাই প্রায় বারো ঘন্টা আগে বাংলাদেশের আকাশ রাঙিয়ে দিয়ে এসেছে।

- Advertisement -

আমাদের বিজয়ের, স্বাধীনতার সূর্য আরও সুন্দর!
সবুজের মাঝে টকটকে উজ্জ্বল লাল রক্তিম সূর্য। বিজয়ের আগের দু’টা দিন খুব খুব দুঃখের, ভয়াবহ ত্যাগ স্বীকারের দিন। নিশ্চিত পরাজয় বুঝতে পেরে বুদ্ধিজীবীদের ধরে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। নিরস্ত্র শ্রেষ্ঠ মানুষদের লিস্ট বানিয়ে, মিথ্যে বলে ডেকে নিয়ে এরকম নৃশংস হত্যাকান্ড আর কোনো দেশে দেখেছি কিনা সন্দেহ।

আর আমাদের বীর বুদ্ধিজীবীরাও বিনা বাক্যে নিশ্চিত মৃত্যুকে আলিংগন করেছিলেন। কি অকল্পনীয় তাঁদের সাহস, ত্যাগ, বীরত্ব! দেশের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মাত্র দুদিন পরের বিজয় থেকে বঞ্চিত করে একটা জাতিকে দাবিয়ে দেবার ভয়াবহ স্মৃতি আমাদের আজীবন কষ্ট দিয়ে যাবে। তাঁদের পরিবারের মুখ থেকে হাসি কেড়ে নিয়েছে চিরতরে। যে যন্ত্রণার গ্লানি বয়ে চলবে আরও বহু জেনারেশন ধরে।

শহীদগণ, তোমরা আমাদের সহজে ক্ষমা করো না।

আমরা স্বাধীনতা হাতে পেয়েও পারিনি তোমাদের মর্যাদা রক্ষা করতে। উল্টো আমরা হয়েছি বিভক্ত, দিনকে দিন বাড়াচ্ছি ভুল বুঝাবুঝি। স্বাধীনতাকে উপস্থাপন করে চলেছি এক প্রশ্নবিদ্ধ পরাধীনতার উদাহরণ হিসাবে।

আমরা কি আবেগ হারিয়ে ফেলছি?

শাহানাজ রহমতুল্লাহ’র সেই আবেগঘন গান; কিছু বছর আগেও শুনে কাঁদতাম। এখন চোখ ভিজতে সময় লাগে। আবেগ এখন হতাশার কাছে ম্লান। আপেল মাহমুদ, জব্বার, সাবিনা, রুনার গান? কেন আবেগগুলো এক বুক অভিমান নিয়ে পালিয়ে বেড়ায়? সহজে ধরা দিতে চায় না? কেন আমাদের বারবার পরীক্ষা দিতে হয় যে, দেশকে ভালবাসি? লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধা, লক্ষ মা-বোন, লক্ষ জনগণের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল আমরা কবে পুরোপুরি ভোগ করতে পারবো?

অথচ, আমরা সাধারণ আমজনতা সবাই দেশকে ভালবাসি। একেক মানুষের প্রকাশভঙ্গি একেক রকম। অমুক ভালবাসে না, তমুক ভালবাসে না; কথাগুলো উচ্চারণ করে আমাদের বিভক্তি বাড়াচ্ছে। মানুষের মাঝে যখন দলাদলি-রেষারেষি শুরু হয়, তখন সেখান থেকে শুরু হয় সন্দেহ, অনাস্থা, ঘৃনা। সন্তানেরা বিবাদ-হানাহানিতে যুক্ত হলে মায়ের যেমন কষ্টের সীমা থাকে না, তেমনি আমাদের দেশেরও অনেক কষ্ট।

তবে বিজয় দিবসে আমি খুব খুব খুশি থাকি, চাপা কষ্ট বুকে নিয়ে। কান্নামিশ্রিত হাসি বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ, অর্জন। দেশে থাকলে সে আনন্দ উৎযাপন করতে দিশেহারা হয়ে ঠিক হাঁটতে বের হতাম সারা শহর। যা দেখতাম, তাই ভালো লাগতো। সবকিছুর মাঝে খুঁজে নিতাম স্বাধীনতার সুবাস। রিক্সা করে লাল সবুজ শাড়ি-পাঞ্জাবি পরা মানুষজন, বাচ্চারা পটকা ফুটাচ্ছে, পাবলিক লাইব্রেরির সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রতিটা চেয়ার কানায় কানায় পূর্ণ। আবার রেলগেটের ফলমূল নিয়ে বসা দোকানদার, ডিম সেদ্ধওয়ালা কিংবা কোনো হতদরিদ্র মাছওয়ালা সন্ধ্যায় তেলের টিমটিমে ল্যাম্প জ্বালিয়ে বাকি ক’টা পুঁটি মাছ বেঁচে বাড়ি ফিরবার অপেক্ষায়।

এ সবই আমাদের স্বাধীনতার প্রতিচ্ছবি। স্বাভাবিক দুঃখ কষ্ট নিয়েই আমাদের পরিবার।
.
আমি এখনো ভরসা পাই খেটেখাওয়া মানুষের ওপর, এখনো স্বপ্ন দেখি চটি স্যান্ডেল পায়ে ময়লা সালোয়ার কামিজ পরে, শাড়ি পরা গার্মেন্ট কর্মীদের ওপর। আমার পূর্ণ আস্থা কৃষকের হাঁড়ভাঙ্গা খাটুনি, বাজার-হাটে সারাদিন কষ্ট করে সদাই বেচা মানুষের ওপর। ইট ভাঙা কিশোরী মায়ের কোলে মাতৃদুগ্ধ পানরত লিকলিকে রক্তশূন্য শিশুর ওপর।
দরিদ্র রিক্সাওয়ালার হ্যান্ডেলের সামনে গুজে রাখা ছোট্ট লাল সবুজের পতাকা আমাকে যেভাবে অনুপ্রাণিত করে, আর কিছুতে তা করে না।

“পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে
রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল..”

আহা, কি অর্থবহ, কতো ভালোবাসার গান!
বাংলাদেশের পাড়া-মহল্লায় কি মাইকে গানগুলো বাজছে?বারো হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ঠিক শুনতে পাই!

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা, ভালোবাসা।

- Advertisement -

Related Articles

Latest Articles